ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ২৯ পৌষ ১৪৩১

বেহাল বুড়িগঙ্গা নদী

মাহবুবউদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশিত: ১৯:৩২, ১২ জানুয়ারি ২০২৫

বেহাল বুড়িগঙ্গা নদী

বুড়িগঙ্গা নদীর বর্তমান অবস্থা শোচনীয়। নদীর দুই পাশ দখল হতে হতে নদী এখন খালে পরিণত হয়েছে। একটি নদী একটি শহরের প্রাণ। কিন্তু  শহর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নদীকে গিলে ফেলার অবস্থা তৈরি হয়েছে দেশের অধিকাংশ শহরে। ঢাকা শহরের চারপাশে বেশ কয়েকটি নদী। এর ভেতরে ছিল অনেক খাল-বিল। দখল দূষণে সবই এখন বিলীয়মান। আগে যখন বুড়িগঙ্গা নদী বর্ষাকালে পানিতে ভরপুর থাকত, তখন দূর হতে ঢাকা শহরকে দেখাত ভেনিসের মতো। তবে বুড়িগঙ্গার আগের ঐতিহ্য এখন আর নেই। কিন্তু নদীর আশপাশের খালগুলোর অস্তিত্ব এখন আর খুঁজে পাওয়া ভার। নদীগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। বুড়িগঙ্গা দখল দূষণে খুবই করুণ অবস্থায় রয়েছে। ঢাকা শহরের পরিবেশ সুরক্ষাই শুধু না ঢাকা শহরের মানুষের নিশ্বাস ফেলতে সচল বুড়িগঙ্গা একান্ত জরুরি। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা  নেবে, বুড়িগঙ্গার বর্তমান বেহাল অবস্থা হতে  প্রাণ ফিরে পাবে- এ প্রত্যাশা নগরবাসীর।  
বুড়িগঙ্গা নদী এখন শুধু দেশেরই নয়, বিশে^র অন্যতম দূষণাক্রান্ত নদী হিসেবে পরিচিত। দূষণের কারণে বুড়িগঙ্গা নদীর পানি তার স্বাভাবিক রং ইতোমধ্যে হারিয়ে ফেলেছে। বুড়িগঙ্গার দূষণ দেশের  অন্য সকল নদীর জন্যও কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে যা গভীর উদ্বেগজনক। বুড়িগঙ্গার এই বেহালদশা কারও কাম্য নয়। বুড়িগঙ্গাকে উদ্ধার করে হাতিরঝিলের আদলে প্রকল্প নেওয়া যেতে পারে। যা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও  নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় যৌথ উদ্যোগ নিলেও নিতে পারে। অথচ রাজধানী ঢাকার হৃদয় বুড়িগঙ্গা এ কথা সবার জানা। কিন্তু এ নদীকে বাঁচিয়ে রাখার যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে ইতোমধ্যে এ নদী তার প্রাণ হারাতে বসেছে। যদিও এ নদীর প্রাণ বাঁচাতে নেয়া হয় একের পর এক প্রকল্প, ঢালা হয় কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। মাঝেমধ্যে চলে উচ্ছেদ, বসে সীমানা পিলার। গত এক যুগে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করেও বদলানো যায়নি বুড়িগঙ্গার চেহারা। পানি হয়েছে আরও কালো। গড়ছে শিল্পকারখানা, ঢাকা ওয়াসা, সিটি করপোরেশন, গৃহস্থালী, হাটবাজার ও নৌযানের বর্জ্য। এখানেই শেষ নয়, সেই সাভারের হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্পনগরীর বর্জ্য ধলেশ্বরী নদী হয়ে মিশছে বুড়িগঙ্গায়। এখনো কয়েক ডজন কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান রয়ে গেছে হাজারীবাগে। নদী রক্ষায় সীমানা পিলার নির্মাণ হলেও এর ভেতরেই গড়ে উঠছে নিত্য নতুন  কারখানা ও দোকানপাট। বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে অভিযান চালিয়েও দমানো যাচ্ছে না দখলবাজদের। এখনো বেদখল হয়ে আছে শতাধিক একর জায়গা। নদীর জায়গায় কেউ কারখানা, কেউ বসতঘর, আবার মসজিদ-মাজার বানিয়েও চালাচ্ছেন দখলদারিত্ব। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় ও নির্দেশনা বাস্তবায়নেরও অগ্রগতি নেই। বিশাল খরচও কাজে আসছে না। সরকার ২০০৯ সালে বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধারে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা খরচ করে প্রকল্প হাতে নেয়। তবে ভুল পরিকল্পনার কারণে এক যুগের বেশি সময় পেরোলেও শেষ হয়নি প্রকল্পের মেয়াদ। সেই প্রকল্পের খরচ ১ হাজার ২০০ কোটিতে গিয়ে ঠেকলেও আদতে বুড়িগঙ্গার কোনো পরিবর্তন হয়নি। প্রকল্পটি চালু অবস্থায়ই ২০১৬ সালে ঢাকার চারপাশের চারটি নদীর অবৈধ দখল ঠেকাতে ৮৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) আরেকটি প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পটির খরচ বাড়িয়ে এখন ১ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা করা হয়েছে। ঢাকার বুড়িগঙ্গাসহ এর চারপাশের নদীর পানি দূষণমুক্ত করতে ২০০৪ সালে একটি সমীক্ষা করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো)। এর ছয় বছর পর ৯৪৪ কোটি ৯ লাখ ৭ হাজার টাকা ব্যয়ে নিউ ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ নদী খনন নামে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। লক্ষ্য ছিল যমুনা থেকে পানি এনে বুড়িগঙ্গাসহ চারটি নদীর দূষণ রোধ করা। তবে এখনো যমুনার পানি বুড়িগঙ্গায় গড়ায়নি। বর্তমানে ওই প্রকল্পের খরচ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১২৫ কোটি ৫৯ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। ওই চার নদী রক্ষায় বিআইডব্লিউটিএ ওয়াকওয়ে ও সীমানা পিলার নির্মাণসহ নানা কাজে ব্যয় করেছে ৮৪৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। চার বছরমেয়াদি এ প্রকল্পের মেয়াদ ২০২২ সালের জুনে শেষ হয়। এ ছাড়া ২২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল উদ্ধার ও খননকাজ করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এ বিষয়ে রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের তথ্যমতে, বুড়িগঙ্গা রক্ষায় প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা এরই মধ্যে খরচ করেছে সরকার। এই টাকার বেশিরভাগ দুর্নীতির মাধ্যমে গিলে শেষ করেছে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলা ও মন্ত্রীরা। তবে যতটা পরিকল্পনা করা হয়, সেখানে বাদ পড়ে গাজীপুর।
ফলে ওই জেলার কারখানার বর্জ্য অন্য নদী হয়ে বুড়িগঙ্গায় মিশছে। ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরের পর সব পরিকল্পনাই ছিল উচ্ছেদ নিয়ে। দূষণ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা হয়নি। উচ্ছেদ অভিযানও ছিল বিতর্কিত। এখনও ১০০ একরের মতো জায়গা বেদখল হয়ে আছে। নিরবচ্ছিন্নভাবে দখল চললেও তদারকি নেই। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, বুড়িগঙ্গার ড্রেনগুলো দূষণমুক্ত করতে মাত্র ২০০ কোটি টাকাই যথেষ্ট। স্যুয়ারেজ লাইনগুলোতে ‘ট্রিটমেন্ট প্লান্ট’ বসালে অনেক সুফল মিলবে। আমরা মনে করি, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন যেভাবে কর্ণফুলী নদীর প্রাণ ফিরানোর জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে, সেটা নিলে বুড়িগঙ্গা নদীও একদিন না একদিন তার প্রাণ ও ঐতিহ্য ফিরে পাবে।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী

×