অপরাধ জগৎ এক বিচিত্র সম্মোহনি আঙিনা। উদীয়মান তারুণ্যের জন্য এক আবেগঘন মাহেন্দ্রক্ষণ। যেখানে ভালো-মন্দের ফারাক অপসৃত। ন্যায়-অন্যায় বোধ চাপা পড়ে যায়। সঙ্গত কারণে জঘন্যতম অপকর্ম থেকে নিকৃষ্টতম দুঃসময়কে মোকাবিলা করার চরম ক্রান্তিকাল। আর এমন কঠিন নিগড়ে আটকাপড়ে উদীয়মান সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্ম। সময়টা আবার বয়ঃসন্ধিকালের স্পর্শকাতরতার দোলাচল বলছেন জ্ঞানী-গুণী পণ্ডিতবর্গ। যা যুগ-যুগান্তরের এক অবিমিশ্র তারুণ্যের নতুন সময়ে অবগাহন। বাংলাদেশেও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে উচ্ছৃঙ্খল পথহারা কিশোর শক্তি। যা এক সময় সংঘর্ষ আর সংকটে আবর্ত হয়ে সমাজের পেশি শক্তির উন্মান তৈরিতে সক্রিয় হতে থাকে। স্বপ্নঘেরা ভবিষ্যতের জীবনতরী সুচিন্তিত পথযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার কথা সেখানে ভর করে এক উন্মত্ত উন্মাদনা আর তারুণ্যের অপশক্তি। শুধু বাংলাদেশ নয় সারাবিশ্বে কাঁপন তোলা তারুণ্যের অপঘাত দেশে দেশে-কালে কালে সব সময়ই বিদ্যমান ছিল। আজও তার কোনো বিরাম-বিরতি নেই। আলোচনা যখন কিশোর অপরাধীদের নিয়ে সেখানে বয়সটাও নির্ধারিত একপর্যায়ে। বলা হচ্ছে তারুণ্যের সুবর্ণকাল ১৪ থেকে ১৮ বছর। যা শুধু একবিংশ শতাব্দীর ধ্বংসাত্মক কর্মযোগ নয় বরং দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এক অসামাজিক ক্রিয়াকলাপ। আর কিশোর-কিশোরীদের কাছে শরীর ও মনের নানামাত্রিক দোদুল্যমান অসময়। নতুন এমন দেহ-মনের বিচিত্র অনুভব আগে যেমন মাতিয়ে দেয়নি পরবর্তী সময়েও সুস্থির মনোশক্তিতে জীবনের পর্ব পার আর এক নবযাত্রা তো বটেই। নিজেকে তৈরি করার দুর্লভ আরাধ্য স্বপ্নের দরজায় পৌঁছে যাওয়া। সেখানে থেকে সামাজিকভাবে প্রভাব, প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা যেন অন্য এক সাধনযজ্ঞ। তবে মহাপণ্ডিতরা যে স্পর্শকাতর বয়ঃসন্ধিকাল অতিক্রমের সময়কে যেভাবে আবেগাল্পুত হয়ে অনুভবই শুধু নয় চিরস্থায়ী ভাব কল্পনায় হৃদয়ের নিভৃতে গেঁথে রেখেছেন সেটাও কম স্মরণ দ্যোতনা নয় কিন্তু। ক্ষুদ্র পারিবারিক আঙিনা থেকে বৃহত্তর নানাবিধ সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ত হতে হয় অগণিত কিশোর-কিশোরীকে। বৃহত্তর সামাজিক আঙিনায় অনুপ্রবেশ উদীয়মান কিশোর-কিশোরীর জন্য নানামাত্রিক বৈচিত্র্যের অনুসন্ধান আহ্বানও। অবিবেচনার দোলায়িত এক অসময়।
জার্মান মহাকবি গ্যেটে এই ১৮ বছর বয়সে অনুভব করলেন তিনি যখন আঠারোয় পা দিলেন তার মনে হয়েছিল পুরো জার্মানি আঠারোতে ঝলমল করছে। অর্থাৎ তারুণ্যের এই দোলাচল ঝলমলে এক আলোকিত ভুবন। এমন নতুন চমক সম্ভাবনায় শক্তিকে কত ভাবে যে কাক্সিক্ষত-অনাকাক্সিক্ষত যাত্রাপথের শামিল করে তাই যেন জীবন চলার পথে বয়সের মোড় ঘোরানো। আর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ প্রিয় কবি গ্যেটের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বলতে দ্বিধা করলেন না নিজে যখন আঠারোর দোলাচলে মনে হচ্ছিল ভারতবর্ষও আঠারোকে আলিঙ্গন করছে সম্মোহনি চিত্তে। কবির উক্তিÑ নিজে যখন আঠারোয় পা দিলাম সারা ভারত যেন আঠারোর দীপ্ত আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে সবকিছু মাতিয়ে দিল। আর বিপ্লবী কবি সুকান্ত তো লিখেই ফেললেন আঠারোকে নিয়ে এক অজেয়, অমর কাব্যঝঙ্কার। চমৎকার ছন্দোবদ্ধ অনুরণনে কবিতাটি যেন আঠারোকে বরণ করে উজ্জ্বলতম অধ্যায়কে আলিঙ্গন করছে। উচ্চ শিক্ষায় অনুপ্রবেশের এমন সুবর্ণ সময়ে উদীয়মান শিক্ষার্থীদেরও নতুন আঙ্গিনায় বৈচিত্র্যিক স্পন্দন-শরীর মন উভয় দিক থেকেই। সেখানে বিপরীত স্রোতে ভালো-মন্দের ফারাক ফিকে হয়ে যাওয়াও অন্যরকম বিপন্ন আকাল। যা পরিবারসহ পুরো সামাজিক আঙ্গিনায় বিস্তৃত এক অশনি সঙ্কেত। একজন কিশোর-কিশোরী যেমন পারিবারিক, একইভাবে সামাজিকও। দায় কি শুধু অতি প্রাচীন সামাজিক ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান পরিবারের?
বিভিন্ন সময় প্রশ্ন ওঠা চিরায়ত এক সংস্কার। আবার উন্নয়ন মহাপ্রকল্পে সামাজিকভাবে গড়ে ওঠা অনাকাক্সিক্ষত কোনো পেশি শক্তির ক্ষমতার দাপট? সেখানে যুক্ত হচ্ছে অপরাজনীতির হানাহানি, ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গের চরম আস্ফালন, নেতৃত্বের বিবদমান সংকট সঙ্গে নতুন গজে ওঠা অপশক্তির প্রবল দৌরাত্ম্য। যা পরিবার থেকে পুরো সামাজিক বলয়ে চরম বিপন্ন, বিষণ্নতায় তাড়িয়ে বেড়ায়। শুরুটা সেই অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্প প্রযুক্তি যুগের পরম সুসময়ে। যে বিজ্ঞান সারা বিশ্বকে নতুন এক যন্ত্র সভ্যতার আঙিনা উপহার দিল তারই বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় সমাজ থেকে ব্যক্তিবর্গ আর এক দুঃসময়ের যাত্রাপথকে অনুষঙ্গ করল। পরিবেশ দূষণ থেকে শুরু করে সামাজিক অবক্ষয়, অপসংস্কৃতি, ভাঙনের খেলায় উন্মত্ত পৃথিবী যেন মেতে ওঠে। তবে এমন অপঘাতের সমূহ সর্বনাশকে অনুধাবন করতেও জগৎবাসীকে আরও এক দশক অপেক্ষমাণ থাকতে হয়। ততদিনে নারী নির্যাতন, কিশোর গ্যাংয়ের উত্থান, পেশি অপশক্তির দুর্দমনীয় প্রতাপ প্রতিপত্তি। সঙ্গে নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর শিল্প প্রযুক্তির কার্বন নিঃসরণে বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়া সবই যেন ভিন্নমাত্রার বিষাদঘন বিপন্নতা অষ্টাদশ শতাব্দীতে হয়ে যাওয়া শিল্পবিপ্লবের বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় ঊনবিংশ শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নে নৈসর্গ বিজ্ঞানীরা পরিবেশ সুরক্ষায় সতর্ক সাবধানতার বাণী বিশ্ববাসীর সামনে হাজির করলেন। ‘ধরিত্র বাঁচাও’ স্লোগনে নৈসর্গ বিজ্ঞানীরা আওয়াজ তুললেন কার্বন নিঃসরণে শিল্প প্রযুক্তির লাগাম টেনে ধরা জনস্বার্থেই জরুরি। প্রকৃতি সহায়ক প্রযুক্তি উদ্ভাবন ব্যতিরেকে পৃথিবীকে সংহার, সংকট থেকে মুক্ত করা একেবারেই অসম্ভব। আর তা করতে ব্যর্থ কিংবা পিছু হটলে আগামীর পৃথিবী বাসের অযোগ্য হতে সময় নেবে না। শিল্পবিপ্লব শুধু যে পরিবেশ দূষণকে নির্মল আবহে ছড়িয়ে দিচ্ছিল তা কিন্তু নয়। সঙ্গে ভয়ংকর কিশোর অপরাধ পাশ্চাত্যে মাথা চাড়া দেওয়া পরিস্থিতির বিরূপ চাপ। সেখানে সমাজ ও রাষ্ট্র বিশেষজ্ঞরা বলছেন শুধু যে প্রযুক্তির ছায়ায় চলমান সমাজ এগিয়ে যায় তা কিন্তু নয় বরং হরেক সামাজিক অব্যবস্থার শিকার হতে হয় জনগোষ্ঠীকে। যেখানে স্পর্শকাতর সময়ের উদীয়মান নতুন প্রজন্ম পড়ে চরম বিষণ্ন্ন আর বিপন্নতায়। আমরা শুধু যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আলিঙ্গন করছি সেটা যেমন অবধারিত সেখানে উল্টা রথও পথ হারানোর নেতিবাচক প্রক্রিয়ায়। তা ছাড়া গত জুলাই মাসের নতুন সমাজ গঠন জাতির জন্য আলোকিত ভুবন। যা উঠতি শিক্ষার্থী আর তারুণ্যের অবিস্মরণীয় জয়গানও বটে। বিজ্ঞানী নিউটনের সেই বিখ্যাত গবেষণা লব্ধতত্ত্ব। প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমাজ ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। তেমন সামাজিক পরিমণ্ডল ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার দোলাচল পরিস্থিতিতে নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্তই শুধু নয় যথার্থ পথ চিনতেও হিমশিম খাচ্ছে। সেখানে তথ্যপ্রযুক্তির নিত্যনতুন এগিয়ে যাওয়া বিশ্বে শ্রেণি বিভাজনও মারাত্মক পরিণতিতে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে যেন দুঃসহ প্রাচীর তৈরি করছে। অগণিত শিক্ষার্থীর শিক্ষা কর্মযোগ থেকে সাময়িক চ্যুত জাতির জন্য সত্যিই আর এক বিঘ্নতার দেওয়াল। যা ভাঙতে না পারলে কিশোর অপরাধই নয় বরং অনেক বিধি আর সমাজবহির্ভূত কর্মযোগ ও শাখা-প্রশাখা গজাবে। তাও উদ্ভূত পরিস্থিতির অনির্দিষ্ট পথ। শুধু বাংলাদেশ নয় পরিবর্তনের এমন দুর্বিপাকে বিশ্বজুড়ে নতুন প্রজন্মের দোলাচলের দুঃসময় জাতির জন্য আশঙ্কার বিষয়। তবে এমন যাত্রাপথ উত্তরণ কঠিন কিছু নয়। চিরস্থায়ী নীতি-নৈতিকতা ও গন্তব্য যদি স্বচ্ছ আর আদর্শিক হয় তার চেয়ে মঙ্গল অন্য কিছুর নয়। তার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য থাকা বাঞ্ছনীয় গভীর দেশপ্রেম আর জন্মভূমির প্রতি ভেতরের উজ্জীবিত বোধ যা ঠান্ডা লড়াইয়ে দেশমাতৃকার চরণে নিবেদিত হবে। প্রথমে ভাবা উচিত ‘বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।’ অর্থাৎ যার যেখানে যথাস্থান সেখানেই তাকে নিবেদিত হয়ে শুধু নিজের নয় দেশ ও জাতির শুভ কামনায় নিমগ্ন হতে অন্য কোনো দিকে ফিরে তাকালে চলবে না। উদীয়মান আগামী দেশ গড়ার অগণিত শিক্ষার্থীকে সবকিছু পেছনে ফেলে শিক্ষা কার্যক্রমকে অবারিত আর দেশ মাতৃকার জন্য উজাড় করে দিতে হবে। যে তারুণ্যের অনন্য শক্তি পুরনো শাসনামলকে উদাত্ত আহ্বানে ভিত নড়িয়ে দিয়ে নতুন সমাজ উপহার দেওয়া সত্যি এক কঠিন বিজয় নিশানা উড়ানো। দেশ নতুন সমাজ গঠন প্রক্রিয়ায় আধুনিক কর্মযোগকে সকলে উপযোগী করার সাধনাও যে পরিবর্তিত সময়ের অনুষঙ্গ হয়। এমন দোলাচল সময়ে আইনশৃঙ্খলাও কিছুটা বিঘ্নতার জালে আটকানো পরিস্থিতির ন্যায্যতা। সেখান থেকে বের হয়ে আসাও কঠিন চ্যালেঞ্জ। তবে তা অসাধ্য মোটেও নয়। যারা দেশের জন্য নিজের মূল্যবান সময় উৎসর্গ করেন তারা আমাদের অহঙ্কার, গৌরব। শুধু কি তা-ই? মৃত্যুকে আলিঙ্গন করাও যাদের পিছু হটায় না তারাই দেশের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ। রাষ্ট্র নীতি কিংবা শাসন প্রক্রিয়া এগিয়ে যাবে আদর্শিক পথপরিক্রমায়। ভূত ভবিষ্যৎও নির্ণীয় হবে চলমান উদ্ভূত পরিস্থিতির ন্যায্যতা আর যৌক্তিক অভিগমনে। যা লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে সুরক্ষার কবচে ঘিরে রাখবে। তবে সেই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০ এর নির্বাচন আর ’৭১ এর স্বাধীনতা অর্জনে ছাত্র সমাজের ঐতিহাসিক অবদান দেশ ও জাতির মঙ্গলেই শুধু নয়, বরমাল্যও বটে। আগামীর নতুন বদলে যাওয়া বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তার কোনো ব্যত্যয় কিংবা অন্যথা হবেই না।
কিশোর অপরাধ
শীর্ষ সংবাদ: