কিছুদিন আগে কাওরান বাজারে কাঁচা মরিচ কেনার সময় লক্ষ্য করলাম, সেখানে লাইট জ্বালিয়ে রেখেছে। উক্ত দোকানে কয়েক ধরনের মরিচ থাকলেও বেছে বেছে ভালো সজীব মরিচ কিনে ব্যাগে রাখি। তৎপর অন্যান্য পণ্যদ্রব্য কিনে বাসায় এসে দেখি, দোকানে যে রকম তরতাজা মনে হয়েছিল অতখানি সবুজ ও সজীব নয়। বুঝলাম এটি ঐ দোকানে সবুজ লাইটের কারসাজি বৈ কিছু নয়। কয়েকদিন আগে রিক্সায় মগবাজার দিয়ে আসার সময় রিক্সাওয়ালা হঠাৎ অন্য একটি থেমে থাকা গাড়ির গায়ে লাগিয়ে দিলে গন্ডগোল লেগে যায়। এ প্রেক্ষাপটে রিক্সাওয়ালা বলে, আমার কোনো দোষ নেই স্যার। কেননা, রাস্তার বিজ্ঞাপনের লাইট এতো তীব্রভাবে জ¦লছে যে, ঐ সময় চোখে ভালো করে দেখিনি।
এ দুটি ঘটনার পর থেকে ভাবছি, এই ধরনের আলোকদূষণ নিয়ে কিছু একটা লিখলে মন্দ হয় না। মজার বিষয় হলো, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণসহ নানা ধরনের দূষণ নিয়ে অনেক কথা শুনি। কিন্তু আলোকদূষণ নিয়ে লিখলে মানুষ আবার কি মনে করে! কিন্তু ভাবলাম, এটি তো বাস্তব সত্য। তাই বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আলোকদূষণের প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহ করে কাগজ-কলম নিয়ে বসে যাই। আসলে আলোকদূষণ এমন কোনো বড় কিছু নয়। এটি অতিমাত্রায় ও অস্বাভাবিক উপায়ে কৃত্রিম আলো ব্যবহারকে বোঝায়। তথাপি এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতি কম নয়। বর্তমান বিশ^ এ ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য, মূলত কোনো আলোক উৎসের ঔজ্জ্বল্য বা দীপন তীব্রতা পরিমাপের একক হলো ক্যান্ডেলা। যদি বিষয়টি কিছুটা ব্যাখ্যা করে বলি, তাহলে এই দাঁড়ায় যে, কোনো ৫৪০১০১২ হার্জ কম্পাঙ্কের শুদ্ধ এক কম্পাঙ্ক আলোক উৎসের দীপ্তির বিকীরণ তীব্রতা ১/৬৮৩ ওয়াট/স্টেরাডিয়ান হলে তার ঔজ্জ্বল্য তীব্রতাকে এক ক্যান্ডেলা বলা হয়। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সাধারণ মোমবাতি এক ক্যান্ডেলার মতো আলো দিয়ে থাকে।
যাহোক, আলোকদূষণ রাতের আকাশের সৌন্দর্যই কেবল নষ্ট করে না, একইসঙ্গে আমাদের পরিবেশ এবং নিরাপত্তাকেও হুমকির দিকে ঠেলে দেয় এবং একইসঙ্গে প্রভাব ফেলছে মানুষসহ জীবজগতের স্বাস্থ্যের ওপরও। বাধাগ্রস্ত করে তুলেছে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার। বস্তুত কৃত্রিম আলোর উৎস বহুবিধ, যেমন- গাড়ির আলো, রাস্তার স্ট্রিট ল্যাম্প, অফিস ও ফ্যাক্টরির আলো, বিলবোর্ডের বিজ্ঞাপন, বাসাবাড়ির আলো ইত্যাদি। এদিকে রাতে কাজ করা মানুষের কাছে থাকে না দিন ও রাতের প্রভেদ। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৮০ ভাগের বেশি এই দূষণের আওতায় আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ানদের ক্ষেত্রে এটা ৯৯ ভাগ। রাতের আকাশের দৃষ্টিনন্দন মিটি মিটি তারকারাজি অনুরাগীদের কথা বাদই দিলাম। কৃত্রিম আলো মানুষ ও অন্য প্রাণীদের দেহের স্বাভাবিক ছন্দ নষ্ট করে দেয়। ক্ষতি করে শান্তিময় ঘুম। এতদ্ব্যতীত সার্কেডিয়ান রিদম বা দেহঘড়ি অকেজো হয়ে পড়ে। কেননা, এই দেহঘড়ি, সূর্য ওঠা ও ডোবার সঙ্গে সম্পর্কিত। দেহঘড়ি স্বাভাবিক অবস্থায় ২৪ ঘণ্টায় রাত ও দিনের তারতম্য অনুসারে সব প্রাণীর শরীরবৃত্তীয় কাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
মেলাটোনিন হরমোনের কথাই ধরা যাক। এটি নিঃসৃত হয় অন্ধকার পরিবেশে এবং সেটি ঘুমের সহায়ক। কিন্তু এটি বাধাগস্ত হয় আলোর উপস্থিতিতে। রাতের বেলায় আলোর আধিক্যে মেলাটোনিন প্রস্তুত হয় কম। এর ফলে তৈরি হয় ঘুমহীনতা, ক্লান্তি, মাথাব্যথা, মানসিক চাপ, উদ্বেগসহ নানা শারীরিক অসুবিধা। সাম্প্রতিক গবেষণায় মেলাটোনিনের ঘাটতির সঙ্গে ক্যান্সারের যোগসূত্র পাওয়া গেছে। বিশেষ করে নীল আলো মেলাটোনিনের বেশি শত্রু। সাধারণত সেলফোন ও কম্পিউটার থেকে আসে নীল রঙের আলো। এদিকে সাশ্রয়ী বলে ইদানীং বাসাবাড়ী, শহর ও শিল্পকলকারখানায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এলইডি লাইট। অথচ এর আলো ক্ষতিকর। আলোকদূষণের ফলে ক্ষতি হচ্ছে সামগ্রিক পরিবেশ ও প্রতিবেশের। উদহারণ স্বরূপ- আলোকদূষণের কারণে পশুপাখিদেরও হচ্ছে আচরণগত সমস্যা। তাদের অসুবিধা হচ্ছে স্থানান্তর, ঘুমানো ও জেগে ওঠার অভ্যাস ধরে রাখা এবং বাসস্থান নির্মাণে। উল্লেখ্য, সামুদ্রিক কচ্ছপ ও পাখিরা দূরে চলাচলের সময় চাঁদের আলোকে কাজে লাগায়। কিন্তু আলোকদূষণের কারণে তারা পথ হারিয়ে ফেলে। এমনকি পথিমধ্যে মারাও যায়। এদিকে পাখিদের খাদ্যের একটি বড় উৎস পতঙ্গ। কিন্তু কৃত্রিম আলোর দিকে ছুটে এসে পতঙ্গ মারা যায়, যা হয়তো অনেকেই দেখে থাকবেন। শুধু তাই নয়, পানির নিচে বসবাসকারী প্রাণীরাও কৃত্রিম আলোর ক্ষতির মুখে পড়েছে। এ বিষয়ে ওয়েলস উপকূলে একটি গবেষণার প্রাক্কালে প্রত্যক্ষ করা হয় যে, পানিতে নিমজ্জিত উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত প্যানেল সামুদ্রিক প্রাণীরা কি ধরনের প্রতিক্রিয়া করে। এতে দেখা যায়, প্রাণীরা আলো থেকে অনেক দূরে আবাস তৈরি করে এবং কাছাকাছি হাতে গোনা কিছু প্রাণী ঘর বানায়। এসবের প্রেক্ষিতে প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের বহু প্রজাতি ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে এবং হচ্ছে।
আলোকদূষণের ফলে বড় ক্ষতির মুখে জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণা। কেননা, এর জন্য টেলিস্কোপ দিয়েও নক্ষত্র ও ছায়াপথের পার্থক্য বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণেই পৃথিবীর টেলিস্কোপগুলো বসাতে হয় শহর থেকে অনেক দূরে। কেননা, মহাকাশের ছবিতে চলে আসে কৃত্রিম আলোর ঝলক যা সফটওয়্যার দিয়ে সরাতে গেলেও ছবির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হারিয়ে যায়। কৃত্রিম আলোর অদক্ষ বা অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারের কারণে আলোক দূষণ হয়। আলোকদূষণের নির্দিষ্ট শ্রেণিগুলোর মধ্যে রয়েছে আলোক প্রবেশ, অতিরিক্ত আলোকসজ্জা, একদৃষ্টি, হালকা বিশৃঙ্খলতা এবং স্কাইগ্লো। ঢাকাসহ সারাদেশের আলোকদূষণেরপেছনে সড়কবাতির পাশাপাশি বিলবোর্ডের প্রত্যক্ষ ভূমিকা আছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এসব বিলবোর্ড ও সড়কবাতির কারণে প্রচুর সড়ক দুর্ঘটনাও হয় বলে মনে করেন তারা। বিলবোর্ডের আলো ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হয় এবং তাতে চলে বিজ্ঞাপন। এতে ড্রাইভারদের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে। বিলবোর্ডগুলোতে এত উচ্চমানের কেলভিনযুক্ত আলো থাকে যে, দিনের বেলায়ও বিলবোর্ডগুলো স্পষ্ট দেখা যায় এবং রাতে তা আরও প্রকট হয়ে চোখে অস্বস্তি তৈরি করে। এগুলো দুর্ঘটনার জন্যও দায়ী বলে প্রতীয়মান হয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, উন্নত যে কোনো দেশে বিলবোর্ডের জন্যও একটা স্ট্যান্ডার্ড লুমেন থাকে। সেই অনুযায়ী তাদেরকে এসব স্থাপন করতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে আলোকদূষণবিষয়ক সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। সড়কবাতি বা বিলবোর্ডের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখনও কোনো নির্দেশনা নেই। মূলত বসবাসের জায়গায় উজ্জ্বল আলো দেওয়া যাবে না। তাতে মানুষের ঘুমের সমস্যা হয়। হাসপাতাল এরিয়াতে দেওয়া যাবে না, তাতে রোগীদের অসুবিধা হয়। উজ্জ্বল আলো লাইব্রেরিতেও থাকতে পারবে না। সেজন্যই লাইব্রেরিতে সাধারণত উজ্জ্বল আলো থাকে না। লাইব্রেরির বাতিগুলো এমনভাবে দেওয়া হয়, যা শুধু বইয়ের পাতার ওপরই পড়ে। অতি আলো চোখে পড়লে মানুষ বিরক্ত হয় ও অস্বস্তি বোধ করে। হয়তো সবাই অবহিত আছেন যে, শাস্তি দেওয়ার জন্য আসামিকে তীব্র আলোর মাঝে রাখা হয়। কারণ, এটা মারাত্মক যন্ত্রণাদায়ক। এদিকে শহরাঞ্চলে গাছপালা কমে যাওয়ায় এমনিতেই পাখিদের আবাসস্থলের পরিমাণ কমেছে। এর মাঝে বিভিন্ন ধরনের আলোর কারণে তাদের জীবনচক্র ব্যাহত হচ্ছে। আর আলো থেকে বাঁচতে ওরা যে গাছের পাতায় আড়াল নেবে, গাছ কমে যাওয়ায় সেই উপায়ও নেই। তাই ভবনের কোণায় কোণায় ওদেরকে আশ্রয় নিতে হয়। আসলে অতিরিক্ত আলোতে শুধু পাখি নয়, বিভিন্ন পোকামাকড়ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক সময়ই কোনো কোনো বিলবোর্ডের নিচে তাকালে দেখা যায় যে, নানারকম পোকামাকড় মরে পড়ে আছে। তাই লুমেন কন্ট্রোল করার পাশাপাশি রাত ১০টার পর অপ্রয়োজনীয় বাতি বন্ধ করা শ্রেয়। যাতে তা রাতের স্বাভাবিকতা ব্যাহত না করে।
বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন নিজেও হয়তো জানতেন না যে, মাত্র ২০০ বছরের কম সময়ের ব্যবধানে তার আবিষ্কৃত বৈদ্যুতিক বাতি এতটা সমস্যা তৈরি করবে মানুষসহ জীব জগতের জন্য। এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ যদি এখন থেকেই আলোর দূষণ না কমায়, তবে একসময় তা বায়ুদূষণের মতো জটিল আর বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। যদিও এই ধরনের দূষণ সারাদিন ধরে থাকতে পারে, কিন্তু রাতের অন্ধকারে এর প্রভাব বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে অনুমান করা হয় যে, বিশ্বের ৮৩ শতাংশ মানুষ আলোক দূষিত আকাশের নিচে বাস করে এবং বিশ্বের ২৩ শতাংশ ভূখণ্ড স্কাইগ্লো দ্বারা প্রভাবিত হয়। নগরায়নের একটি প্রধান পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে স্বাস্থ্যদূষণ, বাস্তুতন্ত্র ব্যাহত এবং নান্দনিক পরিবেশ নষ্ট করার জন্য আলোকদূষণকে দায়ী করা হয়। আলোক দূষণ এমন একটি বিষয়, যা প্রায়ই মানুষের নজরে পড়ে না। খেয়াল করলেও অনেক সময় অবহেলা করা হয়। তবে এই ধরনের দূষণ মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। আসুন এই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সম্পর্কে কিছু অন্তর্দৃষ্টি লাভ করি। আলোকদূষণ, সহজ ভাষায়, রাতের পরিবেশে অতিরিক্ত কৃত্রিম আলোর উপস্থিতি কমাতে আমরা সবাই এগিয়ে আসি। এর মধ্যে বিশে^ আলোকদূষণ ঠেকাতে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এর একটি হলো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ডার্ক স্কাই অ্যাসোসিয়েশন। তারা এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করছে। যেসব প্রতিষ্ঠান নিজেদের আলোকদূষণ তৈরি থেকে বাঁচিয়ে রাখছে, তাদের সনদ দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৭ সালে তারা ডার্ক স্কাই রিজার্ভ এলাকার অনুমোদন দিতে শুরু করে। ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে ২০১টি ডার্ক স্কাই জায়গা অনুমোদন পায়। ব্যক্তিগতভাবেও আমরা আলোকদূষণ ঠেকাতে অবদান রাখতে পারি। মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি নিতে পারি ছোট ছোট কিছু পদক্ষেপ। যেমন- বাইরে গেলে অপ্রয়োজনে আলো না জ্বালানো। জ্বালালেও সেটাকে আকাশের দিকে না দিয়ে নিচু রাখা। ঘরের ভেতরের আলো আটকাতে জানালা ও পর্দা বন্ধ করে রাখা ইত্যাদি। আসলে যে কোনোভাবে অপ্রয়োজনীয় আলো বন্ধ রাখতে হবে। আর তাই ছোট ছোট কিছু পদক্ষেপই হয়তো পৃথিবীকে আবারও সুন্দর ও বাস্তবানুগ করে তুলতে পারে।
লেখক : বিশিষ্ট গবেষক ও অর্থনীতিবিদ
[email protected]