ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ২৮ পৌষ ১৪৩১

অপ্রতুলতা দুর্নীতির অন্যতম চালিকাশক্তি

হুমায়ুন আহমেদ নাইম

প্রকাশিত: ১৯:১৩, ১১ জানুয়ারি ২০২৫

অপ্রতুলতা দুর্নীতির অন্যতম চালিকাশক্তি

দুর্নীতি আমাদের সমাজে একটি গভীর এবং বহুমুখী সামাজিক সমস্যা। এটি কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্তরায় নয়, বরং নৈতিকতার সংকটেরও প্রতিফলন। ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতির নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট। ন্যায়বিচার সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করে। দুর্নীতির পেছনে অনেক কারণ বিদ্যমান, তবে অপ্রতুলতাÑ অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় সম্পদের ঘাটতিদুর্নীতির অন্যতম প্রধান কারণ। এই অপ্রতুলতা শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থান এবং প্রশাসনিক সুযোগ-সুবিধার মতো মৌলিক ক্ষেত্রেও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।

অপ্রতুলতা সমাজে ন্যায্য অধিকারগুলোকে বাধাগ্রস্ত করে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল এবং কর্মসংস্থান ব্যবস্থার সংখ্যা অত্যন্ত কম। এই ঘাটতি জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে বাধা সৃষ্টি করে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে শূন্যপদ এবং প্রার্থীদের চাহিদার মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। ২০২৪ সালের ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারি চাকরির ১৯ লাখ পদের মধ্যে লাখ হাজার ৩৩৩টি পদ শূন্য ছিল। শূন্যপদগুলোর কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বজনপ্রীতি এবং ঘুষ দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। অনেক প্রার্থী চাকরি পাওয়ার জন্য ঘুষ প্রদান করতে বাধ্য হন অথবা রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেন। ফলে অপ্রতুলতা একটি দুর্নীতিপূর্ণ পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক মিকা পালন করে।

অপ্রতুলতার কারণে প্রশাসনিক সেবার মান উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। সরকারি হাসপাতালগুলোতে শয্যার সংখ্যা এবং চিকিৎসক-রোগীর অনুপাত জনসংখ্যার চাহিদার তুলনায় অত্যন্ত সীমিত। এতে রোগীরা প্রায়শই যথাযথ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হন এবং দ্রæ সেবা পাওয়ার জন্য ঘুষ দিতে বাধ্য হন। ২০২১ সালের এক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৭০. শতাংশ খানা সরকারি সেবাখাতে দুর্নীতির শিকার হয়েছে। এছাড়া মি রেজিস্ট্রেশন অফিসে বা অন্য কোনো সরকারি পরিষেবায় দেরি হলে অনেকেই ঘুষের মাধ্যমে তাদের কাজ দ্রæ করাতে বাধ্য হন। এই প্রক্রিয়াগুলো প্রশাসনের প্রতি জনগণের আস্থা হ্রাস করে এবং দুর্নীতির মাত্রা বৃদ্ধি করে।

অপ্রতুলতা আর্থসামাজিক বৈষম্যের পরিধি বাড়ায়। সম্পদের সুষম বণ্টন না হলে ধনী এবং দরিদ্র শ্রেণির মধ্যে ফারাক বেড়ে যায়। ধনী শ্রেণি অর্থ দিয়ে প্রয়োজনীয় সেবা পেতে সক্ষম হয়, কিন্তু দরিদ্র শ্রেণিকে তাদের মৌলিক অধিকার পাওয়ার জন্য কঠিন সংগ্রাম করতে হয়। কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে বাজেট সীমিত থাকলে তার সুবিধা সাধারণত প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই পেয়ে থাকেন। দরিদ্র মানুষ এই প্রক্রিয়ায় আরও বেশি বঞ্চিত হয়। ফলে সমাজে শ্রেণি বৈষম্য তীব্রতর হয় এবং দুর্নীতির শিকড় আরও গভীরে প্রোথিত হয়।

অপ্রতুলতা দূর করার মাধ্যমে দুর্নীতির এই চক্র ভাঙা সম্ভব। প্রথমত, জনসংখ্যার চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মৌলিক ক্ষেত্রগুলোতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং কর্মসংস্থানের মতো সেক্টরগুলোতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। চাহিদা এবং সরবরাহের ফারাক কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সরকারি চাকরির শূন্যপদগুলো দ্রæ পূরণ করতে হবে, যাতে মানুষের মধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে আস্থা সৃষ্টি হয় এবং দুর্নীতির সুযোগ হ্রাস পায়।

দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার দুর্নীতি প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ মিকা রাখতে পারে। প্রশাসনিক কাজ ডিজিটালাইজড করলে দুর্নীতিপ্রবণ প্রক্রিয়াগুলো কমে যাবে। উদাহরণস্বরূপ, সরকারি সেবা প্রদানে অনলাইন পোর্টাল চালু করা হলে ঘুষ দেওয়ার সুযোগ হ্রাস পায়। একইসঙ্গে, স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। ডিজিটাল পদ্ধতির মাধ্যমে জনগণের সেবা প্রাপ্তি সহজ এবং দ্রæ হলে প্রশাসনের প্রতি আস্থা বৃদ্ধি পাবে।

তৃতীয়ত, জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি দুর্নীতি দমনে গুরুত্বপূর্ণ মিকা পালন করতে পারে। জনগণকে তাদের অধিকার এবং দায়িত্ব সম্পর্কে অবগত করতে হবে। নৈতিক শিক্ষা এবং মূল্যবোধের চর্চার মাধ্যমে দুর্নীতির প্রতি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করা সম্ভব। দুর্নীতি বিরোধী প্রচারণা এবং আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে দুর্নীতির ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরতে হবে। সমাজের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

অপ্রতুলতা দুর্নীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। এই অপ্রতুলতা দূর না করা গেলে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন সম্ভব নয়। সুষম সম্পদ বণ্টন, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং জনসচেতনতার সমন্বিত প্রচেষ্টায় দুর্নীতির মূলোৎপাটন সম্ভব। সরকারের পাশাপাশি নাগরিক এবং সামাজিক সংগঠনগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগই একটি দুর্নীতিমুক্ত এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ার প্রধান চাবিকাঠি। অপ্রতুলতার বিরুদ্ধে লড়াই করাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রথম এবং প্রধান পদক্ষেপ। সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং কার্যকর উদ্যোগের মাধ্যমে একটি স্বচ্ছ এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন সম্ভব।

 

শিক্ষার্থীজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

×