গ্যাস সংকট রাজধানী ঢাকায় বেশ পরিচিত একটি ঘটনা। সারা বছরই গ্যাসের বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয় নগরবাসী। শীত মৌসুমে এই সমস্যা আরো কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়।এবার শীতের শুরু থেকে গ্যাস নিয়ে চরম ভোগান্তিতে আছে নগরবাসি। মরার উপর খারার ঘাঁ এর মত বছরের শুরুতেই এলএনজি সরবরাহ লাইন সংরক্ষণ এবং মেরামতের কারণে গ্যাস নিয়ে গোটা রাজধানীতে চলছে চরম ভোগান্তি। ভোর হতে না হতেই গ্যাসের লুকোচুরি শুরু হয়ে যায়। সারাদিনে গ্যাস নেই বললেই চলে। দিনের বেলা পানি ফুটাতেই ঘণ্টাখানেক সময় লেগে যায়। সন্ধ্যায়ও তেমন একটা থাকে না গ্যাস। রাত ১০টার পরে আসে গ্যাস। আবার কখনো বা মাঝরাতে। তাও তা স্থায়ী হয় ঘন্টাখানেক ।এতে বিপাকে পরছেন গৃহিণীরা।টানা কয়েকদিন যাবৎ এমন অবস্থা থাকায় ইট বসিয়ে কাঠ পুড়িয়ে জরুরি রান্না সারছেন কেউ কেউ। তাদের মধ্যে বাধ্য হয়ে অনেকে সিলিন্ডার গ্যাস কিনছেন। কেউ রান্না করছেন অবৈধ ইলেক্ট্রিক হিটারে, কেউ আবার রান্না বসাচ্ছেন তেলের চুলায়। কেউ কেউ আবার রেস্টুরেন্টে থেকেই খাবার-দাবার সারছেন। নিয়মিত রেস্টুরেন্টে খাওয়ার ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছে এ সকল মানুষেরা। প্রতিনিয়ত বাইরে খাবার খাওয়ার ফলে শিশু ও বৃদ্ধরা অসুস্থ হয়ে পরছে।
তীব্র এই গ্যাস সংকটে যেমন জনজীবন ব্যাহত হচ্ছে তেমনি কমছে রপ্তানিমুখী শিল্পের উৎপাদনও। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস মিলছে না শিল্প-কারখানায়। বেশ কিছুদিন ধরে চলা এ সংকটে কমে গেছে শিল্প-কারখানার উৎপাদন। সিরামিক, ইস্পাত, সিমেন্ট ও টেক্সটাইল খাতের মতো গ্যাস নির্ভর উৎপাদন খাতগুলোতে উৎপাদন কমেছে প্রায় ৪০%। এই সংখ্যাটা জনমনে সংকার উদ্ভব ঘটায়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখা গার্মেন্টস খাতেও গ্যাসের এই সংকটের প্রভাব বেশ জোরালো ভাবেই দেখা দিয়েছে। যার ফলে গার্মেন্টস কারখানায় গ্যাসের পরিবর্তে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে কিন্তু তাতে উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ পরিমাণে বাড়ছে। এতে হয়তো লোকসানের সম্মুখীন হতে পারে গার্মেন্টস শিল্প। সার কারখানা গুলোতে গ্যাসের সংকটে চাহিদা অনুসারে সারের উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না।
কৃষি খাতে এ অবস্থা অশনি সংকট বহন করে। ফিলিং স্টেশন গুলোতে ও গ্যাসের চরম সংকট। সিএনজি চালকরা তাদের প্রয়োজনীয় গ্যাস পাচ্ছে না। কেমিক্যাল শিল্পেও উৎপাদনে চরম ধীরগতি দেখা দিয়েছে।পরিস্থিতি সামাল দিতে বিকল্প পথ খোঁজা হলেও তাতে ভারী হচ্ছে ব্যয়ের পাল্লা। পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে রাজধানী ঢাকায় ৩৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। বিপরীতে গ্যাস বরাদ্দ আছে ২৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এবং গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে ১৫০০মিলিয়ন ঘনফুট। সংখ্যাটা চাহিদার তুলনায় বড়ই অপ্রতুল।
গ্যাসের এই অপ্রতুলতা শিল্প খাতে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে, যা দেশী- বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশী শিল্প পণ্যে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান দুর্বল হয়ে পরবে। সময় মত পণ্য সরবরাহ করতে না পারলে ক্রেতারা অর্ডার বাতিল করার ঝুঁকি রয়েছে এবং ক্রেতারা অন্য বিকল্প খুঁজতে বাধ্য হবে। এতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশী পণ্য বাজার হারাবে। আবার যথাযথ পরিমাণে গ্যাস না থাকায় যখন গ্যাস আসে তখন অল্প সময়ে অধিক উৎপাদন করতে গিয়ে উৎপাদনের গুণগত মান খুবই নি¤œমানের হচ্ছে। এক্ষেত্রেও রপ্তানি ক্ষেত্রে গুণগতমান ধরে রাখতে না পারলে বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশী পণ্য বিমুখ হবে। তাতেও বাংলাদেশে পণ্য আন্তর্জাতিক বাজার হারাবে। পাশাপাশি গ্যাস ও জ্বালানির স্থায়িত্বের এই সংকটের কারণে দেশে-বিদেশি বিনিয়োগকারী নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ হারাবে। যা আমাদের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। শুধু তাই নয় দীর্ঘমেয়াদী এমন গ্যাস সংকট চলতে থাকলে ছোট এবং মাঝারি (ঝগঊ) শিল্প গুলোর টিকে থাকা কঠিন হয়ে পরতে পারে। এগুলো বন্ধ হয়ে গেলে শিল্প খাতে বড় রকমের একটা ধাক্কার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। গ্যাসের সংকটে শিল্প পণ্যের উৎপাদন কমে গেলে বাজার পণ্যের চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্য নষ্ট হবে। এর ফলে সাধারণ ভোক্তাদের জন্য পণ্যের দাম বেড়ে যায়, যা মুদ্রাস্ফীতির চাপ সৃষ্টি করবে। গ্যাস সংকটের কারণে শিল্প উৎপাদন কমে গেলে রপ্তানি আয়ে ধ্বস নামে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ কমে যায় এবং সরকারের আমদানি ও রপ্তানি শুল্ক থেকে আয় কমে।
গ্যাস সংকটের ফলে উৎপাদন কমবে এবং শিল্প মালিক কর্তৃক শ্রমিক ছাঁটাই, মজুরি কমানোর মত সমস্যার উদ্ভব ঘটবে। এটি দেশের কর্মসংস্থানের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।শিল্প খাত না বাঁচলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি থেমে যাবে। তাই শিল্পের গ্যাস-বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে।উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা, দ্রæত এই সমস্যার সমাধান করা না গেলে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কমার পাশাপাশি রপ্তানি আয়ে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পরবে। এতে ডলার সংকট তীব্র হবে। যা আমাদের অর্থনীতির জন্য হুমকি স্বরূপ।
গ্যাস সমস্যা নিরসনে বিকল্প নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে শিল্প গুলোকে উৎসাহিত করতে হবে, গ্যাসের অপচয় রোধে সবাইকে সচেতন হতে হবে পাশাপাশি প্রয়োজন অনুসারে গ্যাসের অপচয় রোধে সরকারকে কঠোর আইন জারি করতে হবে। গ্যাসের সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নয়ন করতে হবে। কোন ধরনের লিকেজ থাকলে তা মেরামত করতে হবে এবং যাতে কেউ অসৎ উপায়ে গ্যাস সংযোগ নিতে না পারে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান করতে হবে এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্যাস ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন বৃদ্ধি করতে হবে। সর্বোপরি জনসচেতনতা এবং সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ ছাড়া গ্যাসের এই সংকট সমাধান করা কঠিন।
শিক্ষার্থী, ইডেন মহিলা কলেজ