ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ২৮ পৌষ ১৪৩১

আমিনুল হক: মাঠের প্রহরী থেকে রাজপথের লড়াকু সৈনিক

প্রকাশিত: ১৪:৩৯, ১১ জানুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ১৪:৪০, ১১ জানুয়ারি ২০২৫

আমিনুল হক: মাঠের প্রহরী থেকে রাজপথের লড়াকু সৈনিক

ফুটবলার আমিনুল হক

বলছি সেই জাতীয় বীরের কথা, যে বীর মাঠে দেশের জন্য বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল, গোলবারের সামনে অতন্দ্র প্রহরীর মতো প্রতিটি আক্রমণ ঠেকিয়ে লাল-সবুজের পতাকাকে সমুন্নত রেখেছিল। তিনি আমাদের সর্বকালের সেরা গোলরক্ষক আমিনুল হক-যার হাত পেশাদার ফুটবলের গ্লাভস পরা, ওই হাতজোড়া আমাদের খুব আদরের, খুব আবেগের! অথচ আমরা তাকে দেখেছি সেই হাতজোড়ায় অন্যায়ভাবে হাতকড়া পরা অবস্থায়। রাজনীতির বিষাদতা তাকে আচ্ছন্ন করলেও দমিয়ে রাখতে পারেনি, কারণ আমিনুলদের রক্তে সাহসের শিখা জ্বলে। শত নির্যাতন, কারাবাস, এবং ফ্যাসিস্ট সরকারের নিষ্ঠুরতার মধ্যেও তিনি হার মানেননি, মাথা নত করেননি। আমিনুলরা জন্মায় লড়াইয়ের জন্য, দেশপ্রেমের অগ্নি হয়ে। তারা হারতে জানে না, তারা জানে কীভাবে উঁচিয়ে ধরতে হয় বাংলাদেশের প্রিয় লাল-সবুজ পতাকা।

ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা প্রতিটি ফুটবলারের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন একদম হাতের নাগালে পেয়েও তা বাস্তবে রূপ দিতে পারেননি বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা গোলরক্ষক আমিনুল হক। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব নিউক্যাসল ইউনাইটেডের মতো দলে সুযোগ পাওয়া বা সৌদি প্রো লিগের ক্লাব আল হিলালের মতো প্রস্তাব পাওয়া বাংলাদেশের কোনো ফুটবলারের জন্য স্বপ্নাতীত। কিন্তু শুধুমাত্র ভুল যোগাযোগের কারণে সে সুযোগ হাতছাড়া হয়েছিল তার। এমন দুর্ভাগ্য শুধু আমিনুলের নয়, পুরো দেশের ফুটবলের জন্য এক অমূল্য ক্ষতি। হয়তো তার ভাগ্যের চাকা ঘুরলে আজ বাংলাদেশের ফুটবলের গৌরবের গল্প ভিন্ন হতো।

আমিনুল হক ছিলেন এমন এক গোলরক্ষক, যিনি দক্ষতা এবং সাহসিকতায় বহুবার বাংলাদেশের পতাকা সমুন্নত করেছেন। জর্জি কোটান, যিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক কোচ, তিনি আমিনুলকে তার দেখা সেরা গোলরক্ষকদের একজন বলে অভিহিত করেছিলেন। মাঠে তার চওড়া কাঁধ আর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা বহু ম্যাচে প্রতিপক্ষের আক্রমণ ঠেকিয়ে দিয়েছিল। অথচ এমন একজন ফুটবলারের প্রাপ্য সম্মানও দিতে পারেনি বাংলাদেশ। মাঠে তার লড়াই যেমন দর্শককে মুগ্ধ করেছিল, তেমনি মাঠের বাইরে তার প্রতি অবহেলা এবং শোষণ আমাদের হৃদয়ে ক্ষত সৃষ্টি করে।

ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পর আমিনুল রাজনীতিতে যুক্ত হন। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির হয়ে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের দর্শনে। কিন্তু সেই রাজনীতি তাকে শুধু আঘাতই দেয়নি, বরং ফ্যাসিবাদী সরকারের হাতে শিকার হতে হয়েছে চরম নির্যাতনের। ভিন্ন মত প্রকাশ করার কারণেই তাকে বারবার কারাবরণ করতে হয়েছে। রিমান্ডে নিয়ে তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে, যা কোনোভাবেই মানবাধিকারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

অন্যায়-অবিচার সত্ত্বেও আমিনুল কখনো ভেঙে পড়েননি। তিনি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে বিএনপির চেয়ারপার্সন দেশনেত্রী খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে রাজপথে লড়াই চালিয়ে গেছেন। দেশের জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য তার ত্যাগ ও সাহসিকতা আমাদের সবার জন্য এক অনুপ্রেরণা। রাজনীতির করাল গ্রাসে ক্ষত-বিক্ষত হলেও তার দেশপ্রেমের প্রতি অটুট থেকে লড়াইয়ের মশাল জ্বালিয়ে গেছেন।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিশ্বস্ত হাতিয়ার আমিনুল হক কেবল একজন ফুটবলার ছিলেন না, ছিলেন একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক যোদ্ধা। মাঠে যেমন তিনি গর্বের সঙ্গে দেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন, তেমনি রাজনীতির আঙিনায় গণতন্ত্রের জন্য নিঃস্বার্থভাবে লড়াই করেছেন। তার জীবন আমাদের দেখিয়ে দেয়, কীভাবে সীমাবদ্ধতা, অন্যায়, এবং অবিচারের মাঝেও একজন মানুষ আদর্শের মশাল হয়ে জ্বলে উঠতে পারেন। আমাদের উচিত এমন মানুষের জীবনের গল্প থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং তাকে প্রাপ্য সম্মান দেওয়া।

আমিনুল হকের উপরে নির্যাতনের বিভীষিকা দেখে কেঁদেছে পুরো বাংলাদেশ। তবু তিনি হাটতে চান ভিন্ন পথে, তাঁর প্রতিশোধের বিন্দুমাত্র লেশ নাই। সবসময়ই বলেন, আমার উপরে যে অন্যায় হয়েছে তা যেন অন্য কারো উপরে না হয়। খেলার মাঠ থেকে রাজনীতির মাঠ, সবটাই তাঁর চেনা, প্রিয় জায়গা। তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক, এছাড়াও ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক। কিন্তু এই সকল কিছু ছাপিয়ে আমিনুল হক যেন মানুষের নেতা, দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার লড়াইয়ে নেমেছেন এই পরিবর্তিত বাংলাদেশে। 

ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত বাংলাদেশে দেশের ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে কাজ শুরু করেছেন আমিনুল হক। ক্রীড়াঙ্গনকে দলীয়করণ করা হবে না, এই কথাটি তাঁর মুখে বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। তারেক রহমানের একনিষ্ঠ সৈনিক আমিনুল হক ছুটে ছুটে যাচ্ছেন দেশের আনাচেকানাচে। আমাদের বাংলাদেশের খেলাধুলা সকল কর্মকাণ্ড যে শুধুমাত্র ঢাকা কেন্দ্রীক, তা প্রথম অনুধাবন করেছিলেন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের একজন প্রবাদপ্রতিম সংগঠন মরহুম আরাফাত রহমান কোকো। আমিনুল হক ঠিক সেই বিষয়টাকে অনুধাবন করেছেন, সারাদেশে বিভিন্ন জায়গায় খেলার আসর জমাতে ছুটে যাচ্ছেন। বিভাগীয় পর্যায়ে আয়োজন হয়েছে জিয়া ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, আরাফাত রহমান কোকো স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট। ঢাকায় চলছে ঢাকা উত্তর বিএনপির উদ্যোগে জিয়া আন্তঃ থানা ফুটবল টুর্নামেন্ট। 

এই টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমিনুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি ক্রীড়ামোদী দেশ। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে ক্রীড়াঙ্গনকে যেভাবে দলীয়করণ করা হয়েছে, রাজনীতিকরণ করা হয়েছে, সব খেলাধুলাকে দুর্নীতিগ্রস্ত, সেই ধংসাবশেষকে নিয়ে আমরা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে কাজ করে যাচ্ছি। বিভাগীয় পর্যায়ে আরাফাত রহমান কোকো ফুটবল টুর্নামেন্ট এবং জিয়া ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়েছে। ঢাকা উত্তরে জিয়া আন্তঃ থানা ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়েছে। আগামীতে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নামে নারীদের একটি ক্রিকেট অথবা ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হবে। উপস্থিত অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আপনারা আপনাদের সন্তানকে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলায় উদ্বুদ্ধ করবেন, খেলাধুলা করলে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকবে। আমরা কথা দিতে চাই দেশের ক্রীড়াঙ্গনে আর কোনোদিন কোনো জাতীয়করণ হবে না।’

আমাদের জাতীয় জীবনে আমিনুলদের খুব প্রয়োজন। আমরা যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, সেই বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে আমাদের আমিনুলদের মতো যোদ্ধাদের এগিয়ে দিতে হবে। তাঁরা সামনে এগিয়ে যাবে, কখনো হাতে গ্লাভস পরে ফুটবলের মাঠে, কখনো আঙুল উঁচু করে মিছিলে মিছিলে শ্লোগানে শ্লোগানে! তাঁদের হাত ধরে এগিয়ে আমাদের দেশের রাজনীতি, খেলাধুলা থেকে শুরু করে সবকিছু। এই লড়াইয়ে আমাদের একটাই কথা, আমরা চাই আমাদের বাংলাদেশটা মাথা উঁচু করে দাঁড়াক, আর আমিনুল হকের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই, ক্রীড়াঙ্গন সবার, কোনো দলের বা মতের নয় বরং পুরো দেশের!

লেখক: মাহবুব নাহিদ
রাজনৈতিক বিশ্লেষক 

এম হাসান

×