ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ২৭ পৌষ ১৪৩১

স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভেষজ ও স্বচিকিৎসার গুরুত্ব

গোরা বিশ্বাস

প্রকাশিত: ২১:১৬, ৯ জানুয়ারি ২০২৫

স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভেষজ ও স্বচিকিৎসার গুরুত্ব

মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য যেমন খাদ্যের প্রয়োজন হয়, তেমনি দেহকে সুস্থ ও নিরোগ রাখার জন্য কতগুলো প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুন এবং উপাদানের প্রয়োজন হয়। খাদ্য না হলে আমাদের দেহ যেমনÑ দুর্বল হয়ে পড়ে, তেমনি ওই সকল উপাদানের ঘাটতি হলে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাই বেঁচে থাকার জন্য প্রকৃতি প্রদত্ত মানুষের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান হচ্ছে অক্সিজেন। খাদ্য না খেলেও মানুষ অনেকদিন বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু অক্সিজেন না হলে এক মুহূর্তও বেঁচে থাকা যায় না। অক্সিজেনের পাশাপাশি রয়েছে আরও কতগুলো প্রাকৃতিক উপাদান। যেমন- পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম, ফসফেট, ইউরিক এসিড ও সব ধরনের ভিটামিন। এই উপাদানগুলোর যে কোনো একটির ঘাটতি দেখা দিলে বা পরিমিত মাত্রার চেয়ে কম-বেশি হলে রোগ-ব্যাধিতে আল্ডান্ত হতে হয়। মানবদেহের ভেতরে এই সকল উপাদান কিভাবে পূরণ করা যায়, তার বিস্তর আলোচনা এখানে সম্ভব না হলেও সম্যক ধারণার প্রয়াস তুলে ধরার চেষ্টা করব। আমাদের সমাজে একটি বন্ধমূল ধারণা আছে, শরীরকে ঠিক রাখার জন্য নামি-দামি ডাক্তার, দামি খাবার ও প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। আসলে তা নয়। আমরা প্রতিদিন স্বাভাবিকভাবে যে খাবারগুলো খেয়ে থাকি, তা দিয়েই এর চাহিদা মেটানো সম্ভব। কারণ মানব দেহ তাই-ই যা আমরা খাই-ই। অর্থাৎ মানুষের খাদ্য তালিকা কেমন হবে, তা নির্ভর করে তার দৈহিক অবস্থা, খাবার-দাবারের চাহিদা ও রুচিবোধের স্বরূপ কেমন তার ওপরে। খাবারের এ স্বরূপ নির্ণয় করতে গিয়ে প্রকৃতিবাদীরা প্রাকৃতিক চিকিৎসা ও স্বাভাবিক নিয়মের ওপর জোর দিয়েছেন। তাঁদের মতে, মানবদেহ স্বয়ংল্ডিয়ভাবে গড়ে ওঠে এবং বেড়ে ওঠে। এই গড়ে বা বেড়ে উঠার পেছনে ভূমিকা রাখে প্রকৃতি প্রদত্ত কতগুলো সহযোগী খাবার ঔষধি গাছপালা, লতাপাতা ও শিকড়-বাকড়। তাঁরা আমাদের  দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় যেসব খাবার থাকে তার উপরেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। সেদিক থেকে খাবারগুলোকে মৃত এবং জীবন্ত এই দুই শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। এবার আমাদেরকে চিনতে হবে মৃত ও জীবন্ত খাবারগুলো কী সাধারণ জ্ঞানে আমরা সবাই জানি, টাটকা ফল-মূল, শাক-সবজি, মাছ-মাংস, দুধ, ডিম, ঘি, মাখন এসব খাদ্যের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি, ভিটামিন ও খাদ্যপ্রাণ রয়েছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই খাবারগুলো কতটা বিষমুক্ত ও বিশুদ্ধ মানবদেহের জন্য নিরাপদ কি না। জীবন্ত খাবারের ধরন কেমন হবে, তা বর্ণনা করতে গিয়ে সব ধরনের ফল, শাক-সবজির মধ্যে গাজর, মুলা, শালগম, টমেটো, ঢেড়স ও অর্ধ-সিদ্ধ সবজি, তেল, চর্বি ও কোলেস্টরেল মুক্ত খাবারকে বুঝিয়েছেন। এগুলো রান্নার চেয়ে কাঁচা খাওয়া উত্তম।
অতিরিক্ত তৈল মসলা দিয়ে রান্না করে খেলে এর পুষ্টিগুণ ও অন্য উপাদানগুলো নষ্ট হয়ে যায়। যার ফলে শরীরের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ তো দূরের কথা বরং দেহকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়। এ কারণে তৈলাক্ত চর্বিযুক্ত আঁশবিহীন, ফাস্টফুড, কোমল পানীয় এ জাতীয় খাবারগুলোকে মৃত খাবার বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ এসব খাদ্য এসিডিক বা অম্লধর্মী খাবার বিধায় সহজে হজম হয় না। প্রাকৃতিক চিকিৎসায় সকল প্রকার কৃত্তিম ও নিষিদ্ধ খাদ্যই যে রোগব্যাধির মূল কারণ তা প্রমাণিত হয়েছে। রোগের আরোগ্যতা অনেকটা নির্ভর করে দেহের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর। রোগ সারাতে জীবাণু ধ্বংসের ড্রাগ প্রয়োগ না করেও শরীরকে টক্সিন মুক্ত করে সুস্থ রাখা যায়। তাই কৃত্রিমতা পরিহার করে প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক জীবন যাপনই সুস্থ থাকার শ্রেষ্ঠ উপায়। এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞানীরা আরও বিচার বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, প্রকৃতি থেকে আমরা ছয় জন ডাক্তারকে পেয়ে থাকি। যারা আমাদের পরম বন্ধু। যেমন- ভোরের সূর্য কিরণ, নির্মল বায়ু, বিশুদ্ধ পানি, নিয়মিত ও পরিমিত আহার, ঘুম ও ব্যায়াম। ব্যায়ামের মধ্যে সবচেয়ে উপকারী হচ্ছে- হাঁটা। কথায় আছে, সব ব্যায়ামে মিলে যত, হাঁটায় মিলে তার শত। তাই হাঁটার কোনো বিকল্প নেই। প্রতিদিন একজন সুস্থ মানুষের ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা হাঁটা প্রয়োজন। সেইসঙ্গে যোগ ব্যায়াম, মেডিটেশনতো রয়েছেই। স্ব-চিকিৎসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে সস্তা ও সহজ উপায় হচ্ছে- হালকা গরম পানি ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে বাসি মুখে খালি পেটে খেলে ক্ষুধামন্দা, গ্যাস্ট্রিক ও কোষ্টকাঠিন্য দূর হয়। আবার খাওয়ার ১ ঘণ্টা পর হালকা গরম পানি পান করাও স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। বিপরীতে অতিরিক্ত ঠান্ডা পানি বা কোমল পানীয় পান করলে শরীরে নানা ধরনের বিল্ডিয়া ঘটতে পারে। এরপর রয়েছে ডাবের পানি। ডাবের পানি সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর। এতে কোন প্রকার চর্বি নেই। আছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালোরি, প্রাকৃতিক চিনি, মিনারেল ও ফাইবার। ডাবের পানি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, রক্তে কোলেস্টোরলের মাত্রা কমায়। যার ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি কম থাকে।
এরপর রয়েছে লেবু। লেবু খেতে কে না ভালোবাসে। রান্নাঘর থেকে বিয়ে বাড়ি পর্যন্ত যে কোনো অনুষ্ঠানে লেবুর ব্যবহার হয়ে থাকে। লেবুর মধ্যে রয়েছে লোহা, ভিটামিন-সি, সাইট্রিক এসিড। লেবু দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত একটি উপাদান হচ্ছে মধু। পবিত্র কোরানেও মৌমাছি ও মধুর কথা উল্লেখ রয়েছে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, মধু চিনির চেয়ে মিষ্টি কিন্তু সুগার নয়। তাই সব বয়সের মানুষই নির্বিঘ্নে মধু খেতে পারেন। আদা যাকে বলা হয় সর্ব রোগের দাদা। গ্রাম-গঞ্জে প্রচুর পরিমাণে আদা পাওয়া যায়। আমাশয়, জন্ডিস, সর্দি-কাশি, পেটের পিরা, রক্তশূন্যতা ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আদা অদ্বিতীয়।
বাংলাদেশের সবচেয়ে উপকারী ঔষধি গাছ হচ্ছে নিম। নিমের পাতা, ছাল-বাকল, বীজ, তৈল, নিমের বাতাস মানবদেহের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এজন্য নিম গাছকে গাঁওগ্রামের দাওয়াখানা বলা হয়। এরপর আছে বিভিন্ন জাতের শাক-সবজি। যেমনÑ সজনে পাতা, ধনে পাতা, পুদিনা, লাল শাক, থানকুনি এসব দেহের পুষ্টি সাধনে বিরাট ভূমিকা রাখে। এরকম শত শত শাক-সবজি, গাছপালা, লতাপাতা এই বাংলার মাটিতে রয়েছে যা এখনো অধিকাংশ মানুষের অজানা। এই অজানা, অজ্ঞতা এবং সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না বলেই চিকিৎসা বিজ্ঞানের আধুনিকায়ন উন্নয়ন অগ্রগতি হওয়া সত্ত্বেও মানুষের রোগ-ব্যাধি ল্ডমান্বয়ে বেড়েই চলেছে।
বাংলাদেশে ২ কোটির ওপরে রয়েছে কিডনি রোগী। ক্যান্সার, স্ট্রোক ও লিভার সিরোসিসের মতো রোগে প্রতি বছর মারা যাচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। এসব জটিল কঠিন রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে শত শত পরিবার। চিকিৎসা খাতে সরকার কোটি কোটি টাকা ব্যয় করলেও দেশের মানুষ সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যত্রতত্র গড়ে উঠছে অননুমোদিত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। হরহামেশা ব্যবহার হচ্ছে এন্টিবায়োটিক। ফলে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ল্ডমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। যার ফলে পরিবর্তনশীল পৃথিবীর গতিধারা ও ভাবনার সঙ্গে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার পথে অন্তরায় হতে পারে। আমাদের দেশে চিকিৎসার ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে একটি প্রচলিত কথা আছে। দেশে সুচিকিৎসার বড়ই অভাব। যে কারণে দেশে এত ভালো ভালো প্রথিত যশা, বিশেষজ্ঞ ডাক্তার থাকা সত্ত্বেও মানুষের একটি অংশ পাশের দেশ ভারত ও সিঙ্গাপুরে চলে যাচ্ছে। এর একটি বড় কারণ হিসেবে অনেকেই মনে করেন, রোগীদের সঙ্গে ডাক্তারদের আন্তরিকতা, আস্থা ও সুসম্পর্কের ঘাটতি রয়েছে। কেননা প্রতিটি রোগী ও তার অভিভাবকদের রোগ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানার অধিকার রয়েছে। সম্প্রতি জাতীয় চিকিৎসক ফোরাম আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা চিকিৎসার মতো মহান পেশায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও সততার সঙ্গে সেবা দেওয়ার জন্য তাঁদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। দেশের মানুষকে সুস্থ রাখার দায়িত্ব যেমন রাষ্ট্রের, তেমনি চিকিৎসকদের। সঠিকভাবে সে দায়িত্ব পালন করলেই চিকিৎসা ক্ষেত্রের মান আরও বাড়িয়ে নেতিবাচক ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে। এ ছাড়াও বিদ্যমান চিকিৎসার পাশাপাশি স্বচিকিৎসা ও ভেষজ চিকিৎসার ওপর গুরুত্ব আরোপ সময়ের প্রয়োজনেই শুরু হয়েছে। ভারত এবং চীনে আমাদের অনেক আগেই প্রাকৃতিক চিকিৎসা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে চীনের ওয়াটার থেরাপি ও আকুপাংচার খুবই জনপ্রিয়। ইতোমধ্যে সরকার ভেষজ চিকিৎসায় অল্টারনেটিভ মেডিসিন কেয়ার (অগঈ) নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে।
ইউনানী, আয়ুর্বেদের অতি প্রাচীন চিকিৎসা হিসেবে সুনাম রয়েছে। আধুনিক চিকিৎসায় ভেষজ ও উদ্ভিদের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে গাছপালা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ডাক্তার আলমগীর মতি মর্ডান হারবাল নামে একটি প্রতিষ্ঠান নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন। যার মাধ্যমে দেশের মানুষ উপকৃত হচ্ছে। আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে যখন আধুনিক চিকিৎসার প্রসার ঘটেনি তখনো মানুষ এই প্রাকৃতিক বা স্বচিকিৎসার মাধ্যমে শতায়ু হয়েছেন। প্রাকৃতিক চিকিৎসকগণ ডাক্তার, ড্রাগ ও ডায়াগনস্টিক এই তিন ‘ডি’-কে পরিহার করার কথা বলেছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের নীতিশাস্ত্রেও বলা হয়েছে- প্রিভেন্টিভ ইজ বেটার দ্যান কিউর। অর্থাৎ, রোগ ব্যাধিতে আল্ডান্ত হওয়ার আগেই দেহের ভিতরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলা শ্রেয়। এরপরেও একটি কথা থেকে যায় রোগ শোক মৃত্যু এগুলো অবশ্যম্ভাবী। যেসব কারণে রোগ বালাই হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তা পরিহার করে চলা, মানুষের খাদ্যাভ্যাস, জীবনাচরণের পরিবর্তন, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা, সচেতন থাকা এবং নিষিদ্ধ কাজ ও খাবারগুলো থেকে বিরত থাকা। এ প্রসঙ্গে সৃষ্টির প্রথম মানব সন্তান হযরত আদম (আ:) ও বিবি হওয়ার (রা:) কথা স্মরণ করা যায়। তারা শয়তানের কুমন্ত্রণায় আল্লাহর আদেশ অমান্য করে নিষিদ্ধ গন্দম ফল ভক্ষণের ফলে বেহেস্তের সুখ থেকে বঞ্চিত হয়ে মাটির পৃথিবীতে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। আমরা যেন তেমনিভাবে নিষিদ্ধ, ক্ষতিকর, অনিরাপদ খাবার ও জীবনঘাতী ওষুধ প্রয়োগে অকালমৃত্যুতে পতিত না হই- সেটাই হোক বড় শিক্ষা।
লেখক :  পরিবেশ কর্মী

×