বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র প্রভাব দেখা গেছে সদ্য সমাপ্ত ২০২৪ সালে। বলা যায় পুরো বছরটাই পার হয়েছে এক প্রকার বৈরী আবহাওয়ার মধ্য দিয়ে। বছরটা শুরু হয়েছিল তীব্র শৈত্যপ্রবাহ দিয়ে। এর পর দেশের ইতিহাসে উষ্ণতা আর বন্যার রেকর্ডের সঙ্গে ছিল ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতও। এসব দুর্যোগ ও বৈরী আবহাওয়ায় আক্রান্ত হয়েছে কোটি কোটি মানুষ। বৈরী আবহাওয়ায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের কৃষি খাত। এতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে দেশের কৃষি অর্থনীতি তথা জাতীয় অর্থনীতির। ব্যাহত হয়েছে শিক্ষার পাঠদান কর্মকাণ্ড। রেড অ্যালার্ট জারি করে স্কুল বন্ধ রাখতে হয়েছে। সেইসঙ্গে তীব্র তাপপ্রবাহে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যগত সংকটও তৈরি হয়। ফলে দাবি ওঠে তীব্র তাপপ্রবাহকে জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণার।
এপ্রিলে রেকর্ড তাপপ্রবাহ
২০২৪-এর জানুয়ারিতে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৫ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে গিয়েছিল। তাপমাত্রা এত নিচে নামলেও শীত খুব স্থায়ী হয়নি। মার্চ মাস থেকে শুরু হয়ে যায় গ্রীষ্ম মৌসুম। তাপ বাড়তে বাড়তে ১৬ মার্চ থেকে শুরু হয় মৌসুমের প্রথম তাপপ্রবাহ। মাসের শেষ দিকে কিছুটা কমলেও এপ্রিলের প্রথম থেকে শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় দফা তাপপ্রবাহ। পুরো এপ্রিলজুড়ে টানা তাপপ্রবাহের কবলে পড়ে দেশ। এর আগে দেশের ইতিহাসে সর্বশেষ ১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাসে এত লম্বা সময় ধরে তাপপ্রবাহ অব্যাহত ছিল। গত বছরের গ্রীষ্মের টানা তাপপ্রবাহ ৭৬ বছরের রেকর্ড ভাঙে। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠে ৪৩.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। টানা ৩৭ দিন পর দূর হয় তাপপ্রবাহ। ৩১ মার্চ তাপপ্রবাহ শুরু হয়, আর শেষ হয় ৭ মে। মৃদু থেকে অতি তীব্র এই তাপপ্রবাহ প্রায় সারাদেশেই বিস্তৃত ছিল। এ সময় জনজীবনের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করে। তীব্র গরমে হিটস্ট্রোকে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক তখন জানিয়েছিলেন, ‘এর আগে ২০১৯ সালে চুয়াডাঙ্গায় টানা ২৩ তিন মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে গিয়েছিল। এরপর গত বছরই সর্বোচ্চ ব্যাপ্তিকালের তাপপ্রবাহ চলেছে। আলাদা করে এপ্রিল মাসে এত দীর্ঘ সময় ধরে তাপপ্রবাহ সচরাচর হয় না।’ একই কথা জানিয়েছিলেন আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক। তিনি বলেছিলেন, ‘অতীতে বাংলাদেশে এপ্রিল মাসে টানা এত ব্যাপ্তিকালের তাপপ্রবাহের রেকর্ড নেই।’ আবহাওয়া দপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৩১ মার্চ রাজশাহী ও পাবনায় মৃদু তাপপ্রবাহ শুরু হয়। এরপর ১৩ এপ্রিল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায় রাঙ্গামাটিতে। ১৬ এপ্রিল থেকে শুরু হয় তীব্র তাপপ্রবাহ। ওইদিন চুয়াডাঙ্গা ও বাগেরহাটে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পার হয়। এরপর সারাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চল বৃষ্টিহীন হয়ে পড়ে। কালবৈশাখীরও দেখা মেলে না। সর্বশেষ ঢাকায় বৃষ্টি হয় ১৭ এপ্রিল। সারাদেশের তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়তে থাকে। ২০ এপ্রিল বিভিন্ন জায়গায় দিনের তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করে অর্থাৎ তাপপ্রবাহ অতি তীব্র আকার ধারণ করে। ওইদিন ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পার হয়। মৃদু থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ প্রায় সারাদেশে বিস্তৃত হয়। দেশের আবহাওয়ায় বিরাজ করে মরুভূমির তাপ। বৃষ্টির বাতাস সরে যায় চীনের দিকে।
২৯ এপ্রিল ঢাকার তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়, যেটি ছিল সেই মৌসুমে ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। এছাড়া ৩০ এপ্রিল যশোরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠে, যা ছিল ১৯৮৯ সালের পর দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।
এই মাসে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠা-নামা করে ৪২ থেকে প্রায় ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। গরমের তীব্রতায় তৈরি হয় দুর্যোগকালীন পরিস্থিতি। তিন তিনটি হিট অ্যালার্টও জারি করে আবহাওয়া অফিস। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে সব স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা হয় ২১ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত। জনজীবন অতিষ্ঠ করে দেওয়া রেকর্ড তাপপ্রবাহে জীবন ও সম্পদের বড় ক্ষতি হয়, নিভে যায় ৯৫টি প্রাণ। বিপর্যয়ে পড়ে কৃষি, নেমে যায় পানির স্তর। বেঁকে যায় রেলপথ, বিটুমিন উঠে এবড়োখেবড়ো হয়ে পড়ে সড়ক। ৪ মের পর এক সপ্তাহ বিরতি দিয়ে ফের বাড়তে শুরু করে তাপমাত্রা, যা দফায় দফায় স্থায়ী ছিল জুলাই পর্যন্ত। মৌসুমি বৃষ্টিপাতের জেরে আগস্টে গরমের কষ্ট কিছুটা কমে। তবে সেপ্টেম্বরের প্রথম ও তৃতীয় সপ্তাহেও দেশের বিভিন্ন জেলার ওপর দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ প্রবাহিত হয়।
এপ্রিলে দেশব্যাপী বয়ে চলা তীব্র তাপপ্রবাহে বিপর্যস্ত ছিল রাজধানী ঢাকার জনজীবনও। এর কারণ ছিল ঢাকার তাপমাত্রা মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পাওয়া। দেখা গেছে গত ৭ বছরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা ছিল মহাখালী এবং গুলিস্তান এলাকার। বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকার গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। ২০১৭ সালে রাজধানীর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকায় গড় তাপমাত্রা ছিল ৩৩ দশমিক ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ২০২৪ সালে এসে দাঁড়ায় ৩৬ দশমিক ৫৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। অন্যদিকে এই সময়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে তাপমাত্রা বাড়ে প্রায় ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যেখানে ২০১৭ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকার গড় তাপমাত্রা ছিল ৩৩ দশমিক ৩৯ ডিগ্রি। ২০২৪ সালে সেটি এসে দাঁড়ায় ৩৭ দশমিক ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
৪৩ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে কালবৈশাখী
রেকর্ড তাপপ্রবাহের সঙ্গে এই বছরের এপ্রিলে ৪৩ বছরের রেকর্ড ভাঙে কালবৈশাখী। এই তাপপ্রবাহে ৪৩ বছরের মধ্যে এই মাসেই সবচেয়ে কম কালবৈশাখী হয়েছে। ২০২৪ সালে মাত্র একটি কালবৈশাখীর ঘটনা ঘটেছে। তাপপ্রবাহের মাসে বজ্রঝড় বা কালবৈশাখীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক আবহাওয়া ও জলবায়ু নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি ১৯৮১ থেকে গত বছরের এপ্রিল মাসের উপাত্ত তুলে ধরেছেন গবেষণায়। সেখানে দেখা যায়, এই ৪৩ বছরে এপ্রিল মাসে ৩৬৫টি বড় বজ্রঝড় হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ঝড় হয়েছিল ১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসে, ১৪টি। আর ১৯৯৯ ও ২০০৯ সালে সবচেয়ে কমÑ ৪টি করে ঝড় হয় এপ্রিলে। ২০২৩ সালের এপ্রিলে বজ্রঝড় হয়েছিল ৭টি। ২০২২ ও ২০২১ সালে হয় যথাক্রমে ৯টি ও ৮টি। ২০২৪ সালে হয়েছে মাত্র একটি।
দেশে সবচেয়ে বেশি বজ্রঝড় হয় মে মাসে। এরপর আছে জুন, সেপ্টেম্বর ও এপ্রিল মাস। কিন্তু গত বছরের এপ্রিলে দেশে মাত্র একটি বজ্রঝড় বা কালবৈশাখী হয়েছে। তাও হয়েছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে। সেটিও অস্বাভাবিক।
এপ্রিল মাসে ঝড় কমে যাওয়ায় অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহকেই কারণ মনে করেন বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম। তিনি জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) সঙ্গে যুক্ত। তিনি বলেন, বৈশ্বিকভাবেই তাপমাত্রা বেড়েছে। ভারতে এ বছরের এপ্রিল ছিল ১২২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উষ্ণ। আমাদের যে বায়ুপ্রবাহ তার সঙ্গে সীমান্তসংলগ্ন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ওডিশার সম্পর্ক আছে। এ সময় এসব অঞ্চলে সাগর থেকে আসা জলীয়বাষ্প বজ্র মেঘের সৃষ্টি করে। কিন্তু সেবার ভারতের ওইসব অঞ্চলেও প্রচণ্ড গরম পড়েছে। আর্দ্রতাপূর্ণ জলীয়বাষ্প জড়ো হয়ে বজ্রমেঘ সৃষ্টি করেনি। তাতেই এ বিড়ম্বনা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এ অবস্থা দেখছি আমরা। এপ্রিলে মাত্র একটি কালবৈশাখী আঘাত হানলেও মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু করে মাসজুড়েই দেশের বিভিন্ন স্থানে কালবৈশাখী ও শিলাবৃষ্টি আঘাত হানে। জুন, জুলাই ও আগস্টেও বিক্ষিপ্তভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে আঘাত হানে কালবৈশাখী। এসব ঝড়ে বিভিন্ন স্থানে ঘরবাড়ি ও ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও ঘটে হতাহতের ঘটনা। তবে তাপপ্রবাহের সঙ্গে মার্চের শেষ থেকে পূর্বাঞ্চলীয় বিভিন্ন জেলায় আঘাত হানে তীব্র শিলাবৃষ্টি। বৃষ্টির সঙ্গে হয় প্রচন্ড শিলাবৃষ্টি। বৃষ্টির সঙ্গে ঝরা কোনো কোনো বরফখণ্ডের ওজন ছিল ২০০ গ্রামের বেশি।
ব্যতিক্রমী ঘূর্ণিঝড় রেমাল
২০২৪ সালে চারটি ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়ে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে। প্রথম ঘুর্ণিঝড় রেমাল আঘাত হানে ২৬ মে। রেমালের পর অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে আরেকটি ঘূর্ণিঝড়। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ‘দানা’ নামের ঘূর্ণিঝড়টি ভারতের ওডিশা অঞ্চল দিয়ে উপকূল অতিক্রম করলেও এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলাগুলোয়। আগস্টে ঘূর্ণিঝড় ‘আসনা’ এলেও তেমন ক্ষতি হয়নি। বছরের শেষ দিকে ৩০ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় ফিনজালের প্রভাবে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হালকা ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়। এসব ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে রেমাল নামের ঘূর্ণিঝড়টির আঘাত ছিল দীর্ঘস্থায়ী। এটি বাংলাদেশে অবস্থানের ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে। খুব ভয়ংকর রূপ ধারণ না করলেও এটি দীর্ঘ ৫০ ঘণ্টা সময় ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করেছে। ফলে ঘূর্ণিঝড়টি বেশি সময় ধরে তাণ্ডব চালিয়েছে। এতে বৃষ্টি ও ক্ষতির পরিমাণও বেশি হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় রেমালে দেশের আট বিভাগেই রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে। আবার এটি সাগরবুকেও দীর্ঘ সময় অবস্থানের রেকর্ড করেছে। তবে ভয়ংকর আকার ধারণ না করলেও দীর্ঘ অবস্থানের কারণে বেশি শক্তি সঞ্চয় করার সুযোগ পেয়েছে। আবার বাংলাদেশে আঘাত হানার শুরু থেকে নিম্নচাপ ধারণ করে বিদায় নেওয়া পর্যন্ত ৫০ ঘণ্টার ঘুরপাক খায় দেশের ভূখণ্ডে। যা বড় ধরনের আবহাওয়া পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়ে গেছে। রেমালের তাণ্ডবে ছয় জেলায় প্রাণ হারিয়েছে ১০ জন।
পূর্বাঞ্চলীয় জেলায় প্রলয়ংকরী বন্যা
মৌসুমি বৃষ্টিপাত এবং ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে মে মাস থেকে শুরু করে আগস্ট পর্যন্ত দফায় দফায় বন্যায় আক্রান্ত হয় বিভিন্ন জেলা। ক্ষতিগ্রস্ত হন প্রায় এক কোটি মানুষ। মে মাসের শেষ সপ্তাহ ও জুনে কয়েক দফা আকস্মিক বন্যার সম্মুখীন হয় সিলেট। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে ফের বন্যার কবলে পড়ে ১৫-২০ জেলা। তবে ২০২৪ সালের সবচেয়ে প্রলয়ংকরী দুর্যোগ হিসেবে বিবেচিত হয় আগস্টের শেষ ১০ দিনে পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোয় হওয়া বন্যা। আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফামের তথ্যমতে বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফেনী, নোয়াখালীসহ ১১টি জেলা। বন্যায় এই জেলাগুলোর ৯০ শতাংশ মানুষ মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ে। ধ্বংস হয় ৪৮ শতাংশ বাড়িঘর। প্রলয়ংকরী এই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫৬ লাখ মানুষ। প্রাণ হারান ৫৯ জন। বন্যায় ১৪ হাজার ৪২১ কোটি ৪৬ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতির কথা জানায় বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি। এরপর অক্টোবরে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের তিন জেলায় বন্যায় ১০ জনের মৃত্যু হয়।
মুহুরী নদীর বাঁধ কেটে দেওয়া, অতি ভারি বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলই এবার দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ১১ জেলার এই ভয়াবহ বন্যার অন্যতম কারণ। লা-নিনা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এবার ভারতের ত্রিপুরা এবং তৎসংলগ্ম বাংলাদেশের ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর এলাকায় অতি ভারি বৃষ্টিপাত হয়েছে। ওই বৃষ্টির কারণেই এবার ওই অঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশে প্রবাহিত ৭টি নদীর পানিই বিপদসীমার সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। ওই অঞ্চলে এমনিতেই স্বাভাবিক বন্যা হতো। কিন্তু মুহুরী নদীর পানির বন্যার হাত থেকে ত্রিপুরা রাজ্যকে বাঁচাতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী ১৮ আগস্ট গভীর রাতে ফেনী-ত্রিপুরা সীমান্তে মুহুরী নদীর বাঁধ কেটে দেওয়ার কারণে পানির তীব্র চাপে বন্যা এক ভয়ংকর ও সর্বনাশা রূপ ধারণ করে। প্রবল পানির সর্বগ্রাসী স্রোতে রাতারাতি দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, নাঙ্গলকোট, লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলা, চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলা এবং চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলা প্লাবিত হয়। পরবর্তীতে ওই বন্যা দেশের ১১টি জেলায় বিস্তার লাভ করে। এসব জেলার মধ্যে ফেনী জেলার মানুষের কাছে এবারের বন্যা একদিকে যেমন আকস্মিক, অন্যদিকে অকল্পনীয়। শুধু ফেনী নয়, এর পাশের জেলা কুমিল্লা, নোয়াখালী এবং চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে বন্যা আগ্রাসী রূপ ধারণ করে। বহু জায়গায় বন্যার পানি ঘরের চাল ছুঁয়েছে কিংবা উপচে পড়েছে। এতে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফসলের মাঠ, বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, হাট-বাজারসহ বিস্তির্ণ জনপদ। স্মরণকালের এই বন্যা গত তিন যুগের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। বিশেষ করে ফেনী ও নোয়াখালী অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে।
কৃষিতে বড় ক্ষতি
আটটি আন্তর্জাতিক সংস্থার যৌথ উদ্যোগে গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত বিশ্ব ঝুঁকি প্রতিবেদনে দুর্যোগকবলিত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ নবম স্থানে ঠাঁই পেয়েছে। এতে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে দেশের ৪৬ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যাদের ৪৮ শতাংশের এ ধরনের পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর সামর্থ্য নেই। ওই জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগই গ্রামীণ ও কৃষক। একের পর এক দুর্যোগ ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে বাংলাদেশে চালের উৎপাদন আগের চেয়ে চার লাখ টন কম হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএ। এতে সবজি ও ফলের উৎপাদনের ওপরও প্রভাব পড়েছে। ২০২৪ সালে পাঁচ দফা বন্যার কারণে দুই লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। ফলে বন্যায় ২০২৪ সালে আউশ এবং আমন উৎপাদন যে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ফলে বাজারে চালের দাম ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সরকার চাল আমদানির শুল্কও প্রত্যাহার করে নিয়েছে, যাতে দেশে বেশি চাল আমদানি হয়।
তাপপ্রবাহকে দুর্যোগ ঘোষণার দাবি
কয়েক বছর ধরেই গ্রীষ্ম মৌসুমে দীর্ঘ সময় ধরে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে বয়ে যাচ্ছে তাপপ্রবাহ। প্রচণ্ড গরমে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে জনজীবন। হিটস্ট্রোকে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। গত বছর এই তাপপ্রবাহ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। অথচ প্রতি বছর বেড়ে চলা এ তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় সরকারের পরিকল্পিত কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। তাই গত বছরই দাবি উঠেছে তাপমাত্রা নির্ধারণ করে তাপপ্রবাহকে ‘দুর্যোগ’ ঘোষণার। চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য ও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা এই দাবি তুলেছেন। তারা তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় কর্মপরিকল্পনা নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। সর্বশেষ ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে দুর্যোগ ঘোষণা করা হয়েছে। তারই আলোকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন তাপপ্রবাহকে দুর্যোগ ঘোষণা করার জন্য। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেছেন, ‘তাপপ্রবাহের কারণে যদি কলেরা, অন্য কোনো মহামারি দেখা দেয়, জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, সেক্ষেত্রে দুর্যোগ ঘোষণা হতে পারে। তাপমাত্রা ঠিক করে দেয় এর বেশি হলে সেটা দুর্যোগ হিসেবে বিবেচিত হবে। দুর্যোগ ঘোষণা করে কর্মকৌশল গ্রহণ করা যেতে পারে।’ তারা বলেন, তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। দেখা দিচ্ছে স্বাস্থ্যগত সমস্যা। তাই এটি মোকাবিলায় কর্মপরিকল্পনার আওতায় দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। কাজকর্মের সময়ে পরিবর্তন আনাসহ কিছু ছোট উদ্যোগের মাধ্যমে তাপপ্রবাহের মধ্যেও কিছুটা সহনীয় রাখা যেতে পারে জীবনযাত্রা। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তৎকালীন পরিচালক মো. আজিজুর রহমানও বলেছেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছরই দেশে তাপপ্রবাহের তীব্রতা ও স্থায়িত্ব বাড়ছে। এটাকে দুর্যোগ ঘোষণা করে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।’
লেখক : দৈনিক জনকণ্ঠের নগর সম্পাদক ও প্রধান প্রতিবেদক এবং সভাপতি বাংলাদেশ
ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম