সমতার আদলে সমসংখ্যক নারীর কতখানি অধিকার অর্জন কিংবা খর্বিত হয় সেটার মীমাংসা কবে হবে তা ধারণার বাইরে। সার্বিক উন্নয়ন কাঠামোর মূল শক্তিই অসমতা বিলোপ নারী-পুরুষের তারতম্য ঘোচানো। কারণ সমাজে সমসংখ্যক নারী যদি উন্নয়নের মহা প্রকল্প থেকে বিচ্যুত কিংবা ছিটকে পড়ে তা হলে কাক্সিক্ষত কিংবা প্রত্যাশিত সমাজ এগিয়ে যেতে আরও সময় লাগবে। যে কোনো সমাজের প্রবৃদ্ধি কিংবা অধোগতি সার্বিক মানুষকে নিয়ে তৈরি হয়। যা পরিস্থিতি বিবেচনায় আগানো কিংবা পেছানোর আবর্তে পড়ে। সব যুগে ও কালের এটাই অলিখিত নিয়মবিধি। আমাদের গতানুগতিক সমাজ আধুনিকতার যাত্রাপথকে আলিঙ্গন করছে ঠিকই। কিন্তু কত অপসংস্কার ভেতরের শিকড়ে জিইয়ে থাকে তাও এক অবধারিত দুর্ভোগ। যেমন বাল্যবিয়ে এখনো থামানো যায়নি। নারী শিক্ষা অবারিত হলেও সংখ্যাটা সন্তোষজনক পর্যায়ে না আসা উন্নয়নসূচকের ক্রমবর্ধমান অধোগতি। আর অধিকারের প্রশ্নে নারীদের অবারিত গতিপথ দৃশ্যমান হলেও সেখানে রয়েছে হরেক বিপত্তি আর দুঃসময়। বৈষম্যহীন ছাত্র আন্দোলনের পরিণতিতে পুরনো সরকার পতন আর নব উদ্দীপনায় নতুন সময়ের উত্থান অনিবার্যতা। সেখানে পুনরায় সেই চিরন্তন বিধি নারী সমাজের পশ্চাদবর্তিতাও অধিকারের প্রশ্ন নিয়ে আলাপ আলোচনা, গোলটেবিল বৈঠক গণমাধ্যমে উঠে আসছে। আবারও উচ্চারিত হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীর অধিকার আর নির্বিঘ্নে পথ চলা কতখানি অবারিত; তথ্য উপাত্তে দেখা যাচ্ছে আজও প্রচলিত অপসংস্কার আর মান্ধাতা আমলের নানামাত্রিক বিধিতে নারীদের লাঞ্ছিত হওয়ার করুণ আখ্যান। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসের এক আলোচনা সভায় এমন সব অসমতার বিষয় তুলে ধরা হয়। সেখানে পুনরায় আলোকপাত করা হয় নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আজও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। যেখানে কোনো মতামত দিতে নারীকে হিমশিম খেতে সেখানে নেতৃত্বের পুরোভাগ আসা এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। বক্তারা অভিমত ব্যক্ত করছেন অধিকার নয় নারীরা পুরুষতন্ত্রের সঙ্গে সমঝোতায় এসে জীবন ও সংসার টিকিয়ে রাখে। হরেক বাধাবিঘ্নকে অতিক্রম করে দেশের যে অগ্রগতির নিশানা সেখানেও রয়েছে জিইয়ে থাকা বহু ক্ষতচিহ্ন। যা যুগ-যুগান্তরের অনধিগম্য এক কালো দাগ। উন্নয়নের গতিধারায় পথে পথে বণ্টন বিছানোর দুরবস্থা। নারী শিক্ষা প্রসারিত হচ্ছে সন্দেহাতীতভাবে। বৈচিত্র্যময় পেশায় নিজের অবস্থান নজরকাড়া করতেও পিছু হটছে না। ব্যবসা বাণিজ্যে নারীর ক্রমবর্ধমান অগ্রগতি আজ আর আড়ালে, আবডালে নেই। তবে একটা বড় সাংগঠনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীর পিছু হটা সত্যিই মান্যতা পায় না। রাজনৈতিক সচেতনতার ঘাটতি। ১৯৯১ থেকে ২০২৪ এর মাঝ অবধি লাগাতার নারী শাসন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অভাবনীয় অধ্যায় বলাই যেতে পারে। তবে ২০১৪ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত এক তরুণ শাসনের দুর্বিপাকে অতিষ্ঠ জনগোষ্ঠী লাগাতার ক্ষমতার দাপটে পুরনো সরকারকে বিদায় জানিয়ে একচ্ছত্র আধিপত্যের অবসান ঘটায়। যা কোনো স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্যও ছিল। এই আন্দোলনে অধিকার সচেতন ছাত্রীরাও বৈষম্যবিরোধী রক্তাক্ত পথের অনুষঙ্গ হয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের ছাত্রীরা ক্যাম্পাসজুড়ে যে প্রবল প্রতিবাদ আর প্রতিরোধে এগিয়ে আসে সেটাও জাতির জন্য বড় সাফল্যের সূচক। তবে কিছু সময় পার হওয়ার পর আবারও উঠে আসছে বৈষম্যের নিগড়। নারী শিক্ষার্থীরা পেছনে পড়ে থাকছেন আন্দোলনে সমান অংশীদার সত্ত্বেও। বলা হচ্ছে স্বীকৃতির জন্য কেউই সম্মুখ সমরকে আলিঙ্গন করেনি। বরং পরিস্থিতি বিবেচনায় ছাত্রীরাও সহযোদ্ধার মতো ছাত্রদের পাশে দাঁড়াতে মোটেও কার্পণ্য করেনি। তার পরও পুরুষতন্ত্রের অনাবশ্যক বেষ্টনী থেকে মুক্ত হতে না পারাও সমতার ওপর যেন বিষফোঁড়ার ক্ষত। এখনো প্রশ্ন তোলা হচ্ছে নারী নেতৃত্ব কতখানি জরুরি? শিক্ষার অগ্রগতিতে নারীর ভূমিকা কি যথেষ্ট? সেখানে উপদেশ-পরামর্শ আসছে নারী শিক্ষায় আরও বিনিয়োগ সময়ের দাবি। গত দুই দশক ধরে তা নিয়ে বহু আলাপ- আলোচনা, উঠান বৈঠক থেকে সভা-সমিতি বিভিন্নভাবে দৃশ্যমান হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা নাকি অপ্রতুলই। নারীরা অধিকার বঞ্চিত হয়েও তারা নিজের সক্ষমতায় এগিয়েছে বহুদূর। সামনে আরও জোর কদমে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতাকে উপড়ে ফেলতে হবে। বাধাবিপত্তি যে কোনো সমাজের সব মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সেখানে শারীরিকভাবে কোমল নারীরা যেভাবে বিভেদের আবর্তে পড়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষরা তেমন আশঙ্কায় পড়ে কম। পুরুষদের বেলায় কিন্তু লিঙ্গ বৈষম্য আসে না। বরং বিত্ত-নির্বিত্তের ফারাকে অপেক্ষাকৃত নিম্ন শ্রেণির পুরুষরাই বৈষম্যের আকালে নিপতিত হয়। যেমন কোনো শিল্প-কারখানায় শ্রমিকের শ্রম শক্তি উৎপাদনের নির্ণায়ক বিবেচিত হলেও সেখানে মালিক-শ্রমিকের দ্বন্দ্বে ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হওয়া এক অবাঞ্ছিত পর্ব। সেখানেও নাকি পুরুষ সহকর্মীর চাইতে নারী শ্রমিকের দৈনিক মজুরি অপেক্ষাকৃত কম। শ্রমের ধরন, সময় ও ঘণ্টার মধ্যে কোনো ফারাক নেই। তবে নারী শ্রমিকদের বেতন-মজুরি এত কম কেন তার কূল-কিনারা আজও হয়নি।
অপরাজিতা প্রতিবেদক
নারীর অধিকারে আজও প্রশ্ন
শীর্ষ সংবাদ: