সিডনির মেলব্যাগ
মহাদেশের আয়তনের সমান একটি দেশ অস্ট্রেলিয়া। একদিক থেকে একা ও নিঃসঙ্গ। তার কোনো স্থল প্রতিবেশী নেই। জলসীমা তথা প্রশান্ত মহাসাগর বেষ্টিত এই বড় দেশটির নিসর্গের সুনাম বিশ্বব্যাপী। দীপাকে সবসময় বলি, আমরা তো অস্ট্রেলিয়ায় এসেছি শুধু সিডনিতে নয়। চল বেরিয়ে পড়ি। যাব যাচ্ছি করে অনেক সময় যাওয়া হয় না।
আরেক প্রান্তে ক্যাঙ্গার আইল্যান্ড দেখতে যাব বলে টিকিট কাটা হয়েছিল। কিন্তু মহামারি করোনার কারণে তা হয়নি। সে টিকিট পিছুতে পিছুতে শেষতক গিয়ে থামল ক্রেইনস ভ্রমণে। সেই জায়গাটি যার প্রবাল দ্বীপ বিশ্ববিখ্যাত। বলা হয়, মহাকাশ থেকে যে সব স্থান চোখে পড়ে এর মধ্যে গ্রেট বেরিয়া রিফ অন্যতম। পানির তলায় প্রবাল ও সামুদ্রিক জীবের আশ্চর্য সুন্দর বাসস্থান।
আমরা উড়াল দিয়েছিলাম সকালে। কাকডাকা ভোরে ব্যাগ নিয়ে যাত্রা শুরু। এয়ারপোর্টে চা-কফি ও ব্রেকফার্স্ট খাওয়ার আলাদা একটা অনুভূতি থাকে। আপনি বাইরে বা অন্য জায়গায় যত দামি রেস্তোরাঁতেই খান না কেন, এই আবেশ ও আমেজ মিলবে না। সকাল সকাল ঘুম ভাঙা চোখে ব্যস্ত এয়ারপোর্টের চেহারাটা ভিন্ন। যা ভেবেছিলাম তার চাইতেও ঘটনা বড়।
মনে হচ্ছিল বিদেশে কোথাও উড়াল দিচ্ছি আমরা। শ’তিনেক যাত্রী বোঝাই করা সহজ বিষয় নয়। সে প্রায় ঘণ্টা খানেকের বিষয়। বিশাল উড়োজাহাজের পেটের ভেতর ঢুকে পড়ার পর জানা গেল টানা তিন ঘণ্টার উড়াল। বাংলাদেশ থেকে তিন ঘণ্টারও কম সময়ে আপনি অনেক দেশে পৌঁছে যাবেন। সে দৃষ্টিকোণে এটি বিদেশ ভ্রমণের সমতুল্য।
উড়োজাহাজের ভ্রমণ অবশ্য অতটা সুখকর কিছু না। অল্প জায়গা, গায়ে গা লাগিয়ে বসার মধ্যে আরাম থাকে না। তা ছাড়া পানিও কিনে খেতে হয়। কিন্তু এবার দেখলাম চা-কফি ফ্রি। এতে ভ্রমণে কিছু সুখ মিলে বৈকি। যখন উড়োজাহাজটি অবতরণের জন্য তৈরি তখন মনে হচ্ছিল আমরা সবুজে সবুজময় কোনো শৈলমালার শহরে নামছি।
ছোট ছোট ঘরবাড়ি আর যতদূর চোখ যায় নীল জলরাশি। এই সুন্দর দৃশ্যটি অন্তর্হিত হতে হতেই আমরা ডানা ঝাঁপটানো শব্দে কাঁপতে কাঁপতে স্পর্শ করেছিলাম এয়ারপোর্টের রানওয়ে। এসব দেশের সব এয়ারপোর্ট সিস্টেম আর দৃশ্য প্রায় এক ধরনের। ব্যাগ হাতেই ছিল। ফলে, কোথাও দাঁড়াতে হয়নি। সোজা বের হতেই আমাদের হাবভাব দেখে একসঙ্গে গোটা কয়েক সহায়তা কর্মী এসে ঘিরে ধরল। কোথায় যাব, কিভাবে যাব সে পথ বাতলে দিতে।
যথারীতি পৌঁছে গেলাম হোটেলে। সামনে ছোট্ট সুইমিং পুল। চারদিকে বাগান ঘেরা। সকালে পৌঁছে গেছি বলে দেরি করতে হয়নি। প্রথমদিন আমাদের যাত্রা সীমাবদ্ধ ছিল শহরে। যেটা চোখে পড়ার মতো যাদের আমরা আদিবাসী বলি, সেসব ইনডিজিনিয়াস আদিবাসীদের দেখা মিলতে শুরু করল।
বোঝা গেল তারা এখন এখানেই কেন্দ্রীভূত। হোটেলের সামনে হাত বাড়ালে ধরা যায় এমন দূরত্বে সারি সারি পাহাড়। সবুজের সীমায় মিশে গেছে নীল আকাশ। ফাঁকে ফাঁকে বাড়ি-ঘর। আমরা যাদের কটেজ বলি, তেমন সব সরকারি বাসা-বাড়িতে থাকে আদিবাসীরা।
ইতিহাস বলে অস্ট্রেলিয়ায় মানুষের বসবাস শুরু হয়েছিল প্রায় ৬৫,০০০ বছর আগে। বর্তমানের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে মানুষ ভূসেতু ব্যবহার করে এবং ক্ষুদ্র সমুদ্র পারাপারের মাধ্যমে এই মহাদেশে এসেছিল। আর্নহেম ল্যান্ডের মাজেদবেবে গুহা অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে মানবজাতির অস্তিত্বের সবচেয়ে প্রাচীন প্রমাণ। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে প্রাচীন মানব দেহাবশেষ পাওয়া গেছে লেক মুঙ্গোতে, যা প্রায় ৪১,০০০ বছর পুরনো। বর্তমান আদিবাসী অস্ট্রেলীয়দের পূর্বপুরুষ। আদিবাসী অস্ট্রেলীয় সংস্কৃতি পৃথিবীর প্রাচীন সংস্কৃতিগুলোর মধ্যে একটি।
ইউরোপীয়দের সঙ্গে যোগাযোগের আগেই বেশিরভাগ আদিবাসী অস্ট্রেলীয়র সমাজব্যবস্থা শিকারি পর্যায়ে ছিল এবং তাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল জটিল অর্থনীতি। সাম্প্রতিক প্রতœতাত্ত্বিক অনুসন্ধান অনুযায়ী তাদের জনসংখ্যা প্রায় ৭,৫০,০০০-এর কাছাকাছি ছিল বলে অনুমান করা হয়। আদিবাসী অস্ট্রেলীয়দের ভূমির প্রতি শ্রদ্ধা ও স্বপ্নের প্রতি বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ এবং মৌখিক প্রথা রয়েছে। [টরেস প্রণালির দ্বীপবাসীরা (জাতিগতভাবে মেলানেশীয়) মৌসুমি উদ্যান পালন এবং প্রবাল ও সমুদ্রের সম্পদ থেকে তাদের জীবিকা অর্জন করত। (সূত্র : আদিবাসী ইতিহাস)।
নানা টানাপোড়েনে সম্পর্ক একরৈখিক কিছু থাকেনি। বরং আদিবাসীরা বলেন, তাদের ভূমি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তাদের সন্তান-সন্ততিদের কেড়ে নেওয়া হতো। এর দুটো দিক আছে। যারা এই দেশকে উন্নত ও অগ্রগতির দেশ বানিয়েছেন, যাদের শাসনামলে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ এখানে এসে বসতি গেড়েছে, তাদের ভাষ্য ভিন্ন। আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও ইতিহাস আমাদের কাছে সবসময় কৌতূহল উদ্দীপক। বলছিলাম, শহর ঘুরে দেখার কথা।
বিস্মিত হয়েছি কয়েক লাখ মানুষের এই শহরে কি দারুণ এক জাদুঘর। যে জাদুঘরে সযতেœ রাখা আছে ইতিহাস। আছে এই দেশ এই শহর জানার যাবতীয় উপাদান। বিকেল না গড়াতেই আমরা গিয়েছিলাম শিল্পকলার জাদুঘরে। পেইন্টিং আর নানা জাতীয় ছবিতে ঠাসা এটি আমার জন্য অপার আনন্দের এক উৎস। ছবি বোঝার মতো মেধা আমার নেই। তারপরও কোনো কোনো ছবির তলায় দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল কাঁচা রং কাঁচা ফ্রেমের ছবিটি কথা বলতে চাইছে।
সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল পরের দিন কুমির দেখতে যাওয়া। এমন নয় যে আপনি গেলেন আর গোটা কয়েক কুমির দেখে ফিরে এলেন। সেই জায়গাটিতে সাপ, কুমিরসহ নানা ধরনের বৈচিত্র্যময় প্রাণীর সমাবেশ। সবার সময় ঠিক করে দেওয়া আছে। একবার টিকিট কেটে ঢুকলেই হলো। সাপের খেলা বা কোয়েলার গাঢ় ঘুম আগেও দেখেছি। সবুর করছিলাম জলযানে করে কুমির দেখার জন্য লেগুনের ভেতর ঘুরে বেড়ানো। কি এই লেগুন?
লেগুন হলো সমুদ্র বা মহাসাগর থেকে একটি বাঁধ বা দ্বীপ দ্বারা বিচ্ছিন্ন একটি অগভীর জলাভূমি। এগুলো সাধারণত উপকূলীয় অঞ্চলে পাওয়া যায়। তবে মিঠা পানির লেগুনও পাওয়া যায়। লেগুনগুলো বিভিন্ন উপায়ে গঠিত হতে পারে। কিছু লেগুন বরফ গলে যাওয়ার কারণে তৈরি হয়, যেমন গ্রিনল্যান্ডের লেক হুইলার।
অন্যান্য লেগুন বাঁধ বা দ্বীপ দ্বারা সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তৈরি হয়। উদাহরণস্বরূপ, ভেনিস লেগুন। এটি ইতালির ভেনিস শহরের কাছে একটি প্রবাল প্রাচীর দ্বারা সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন। লেগুনগুলো বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ এবং প্রাণীর আবাসস্থল। এগুলো মাছ, কাঁকড়া, কচ্ছপ এবং অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রজনন ও খাদ্যের উৎস। লেগুনগুলো পর্যটকদের জন্যও জনপ্রিয় আকর্ষণ।
লেগুনটিতে বারোটি কুমিরের বসবাস। জেনে অবাক হবেন কয়েক ছটাক মাংস পেলেই কুমির খুশি। কারণ, সে খাদ্য জমা রাখতে পারে। বিশ্বাস করা মুশকিল যে, আমরা সবুজ কচুরিপানা আচ্ছাদিত যে জলাশয়ে ঘুরছিলাম, তার ফাঁকে ফাঁকে আরামে শুয়ে আছে এরা। জলযানটির চালক বড়শিতে মাংস গেঁথে ছিপ ফেলতেই হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসছিল এক একটি অতিকায় কুমির।
কাঁচ দিয়ে ঘেরা আমাদের নৌযানটি এমনভাবে দুলে দুলে উঠছিল যে, মনে হচ্ছিল আমরা বোধহয় কুমিরের পেটেই সেঁধিয়ে যাব। কিন্তু ঝানু চালক জানত কোথায় থামতে হবে, কোথায় আমরা নিরাপদ। বারোটি কুমিরের দেখা না পেলেও অর্ধ ডজন কুমিরের দেখা মিলেছিল এবং তাদের লম্ফঝম্প বলে দিচ্ছিল মানুষ আসলে কত অসহায়। কুমির যাত্রার পর ফিরে আসতে আসতে মনে হচ্ছিল, না এলে এই বিচিত্র অভিজ্ঞতা হতো না। কুমিরের কান্না কিংবা কুমির কিভাবে গিলে খায় তা দেখা হতো না।
সব জায়গারই আলাদা একটা চেহারা থাকে। থাকে কিছু বৈশিষ্ট্য। ক্রেইনসের মূল বৈশিষ্ট্য তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। কোথাও কোথাও মাটির কাছাকাছি নেমে আসা আকাশে মেঘের আনাগোনা। তপ্ত রোদ চোখ ঝলসানো আলো আর গরমের শহরে আপনার কষ্ট ভুলিয়ে দেবে অসাধারণ কুমিরের স্যুপ। আপনি খেতে পারেন সামুদ্রিক মাছ গলদা চিংড়ির অসাধারণ সব পদ।
বলাবাহুল্য, চাইলে সাগরের বুকে বসেই পেয়ে যাবেন সব। এ যাত্রায় কিঞ্চিৎ শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছিল। না হলে টের পেতাম না কতটা দ্রুত আর নির্ভরশীল হতে পারে চিকিৎসা। আধ ঘণ্টার ভেতর ডাক্তার এসে হাজির। যাবতীয় চেকাপ করে গাড়িতে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল হোটেলে। ব্যবহার আর আন্তরিকতায় বোঝার সাধ্য ছিল না ওদের কখনো দেখিনি। বা চিনি না।
সব ভ্রমণেরই একটা স্মৃতি থাকে। যা মনে দাগ কেটে যায়। সে দাগ তখনই সুন্দর যখন তা হয় দৃষ্টিনন্দন ও সুখের। ক্রেইনস ভ্রমণে আগত দেশ-বিদেশের হাজার হাজার পর্যটকের আনাগোনার কারণ বুঝতে দেরি হয় নীল পরিচ্ছন্ন গোছানো এই শহরের জলে কুমির, ডাঙ্গায় মানুষ। মাথার ওপর সুনীল আকাশ, হাতের কাছে সবুজের হাতছানি। ঘুরে এলেই টের পাবেন।[email protected]