ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

িসডিনর েমলব্যাগ

তবলার জাদুকর

অজয় দাশগুপ্ত

প্রকাশিত: ১৯:৫৭, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪; আপডেট: ২০:০০, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

তবলার জাদুকর

কেমন পুরুষ কেমন মানুষ ছিলেন প্রয়াত জাকির হোসেন? তিনি কী নিছকই এক তবলাবাদক? ১৯৯৪ সালে এক সাময়িকী জরিপ করেছিল। নারী পাঠকদের বিচারে সেই জরিপে অমিতাভ বচ্চনের মতো তারকাকে পেছনে ফেলে ভারতের সেরা আবেদনময় পুরুষ হয়েছিলেন জাকির হোসেন! বিশ্বসেরা এক তবলাবাদক কিনা সেরা আবেদনময় পুরুষ! এটাও জাকির হোসেনের বহুমাত্রিক জীবনের একটা উদাহরণ। পৃথিবীব্যাপী নন্দিত সিডনি অপেরা হাউসের মূল মঞ্চে অনেকবার   তবলা বাজিয়ে গেছেন জাকির হোসেন।  অনেকবার তাঁকে দেখার সুযোগ নষ্ট হলেও গত জুলাই মাসে ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছিল। ভাগ্যক্রমে টিকিট জুটে গিয়েছিল। জাকির হোসেন কী শুধুই তবলা বাজান? দু’ঘণ্টা ধরে সবাইকে বুঁদ রেখে মঞ্চে উপবিষ্ট  বেহালা ও বীণা বাজিয়ে  কালা রামনাথ ও জয়ন্তী কুমারেশ দুই ঝানু দক্ষিণ ভারতীয় রমণীর বাদ্যযন্ত্রকে শাসন করে গেল তাঁর তবলা। তবলায় এত কিছু হয়, হতে পারে তাঁকে না দেখলে বোঝা অসম্ভব। তিনি তবলা বাজান বলে মনে হলো না, মনে হলো তবলা তাঁর শিশু। তাঁর চাটিতে তাঁর যত্নে তাঁর শাসনে সে কথা বলে। এলেন মঞ্চ সালাম করে, অতঃপর দু’হাত জোড় করে নমস্কার জানিয়ে শুরু।  জাকির হোসেন কোনো সাধারণ তবলা বাদক ছিলেন না ।
১৯৫১ সালে মুম্বাইয়ে তাঁর জন্ম। তবলায় হাতেখড়ি মাত্র তিন বছর বয়সে। ১২ বছর বয়সেই ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে পেশাদার বাদক হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করেন। তখন মঞ্চে বাজাতেন বাবার সঙ্গে। জাকির হোসেন ভারতের পাশাপাশি বিশ্ব সংগীতেও ছিলেন সুপরিচিত। তাঁর আসল পদবি ছিল কুরেশি। ‘হোসেন’ তাঁকে উপাধি দেওয়া হয়েছিল। তাঁর কাজের বেশিরভাগ জুড়ে ছিল ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীত। পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সংগীতেও দখল ছিল তাঁর। ভারতসহ অন্যান্য দেশের বহু চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন। জাকির হোসেন এক সময়ে তবলায় যাদের সংগত করেছেন, তারাও একেকজন কিংবদন্তি শিল্পী। পণ্ডিত রবিশঙ্কর, যাঁকে জীবদ্দশায় দীর্ঘকাল সংগত করেছেন তাঁর বাবা আল্লা রাখা। এছাড়া ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, ওস্তাদ আলী আকবর খান, পণ্ডিত শান্তা প্রসাদ, বিসমিল্লাহ খান, পণ্ডিত কিষাণ মহারাজ, শিবকুমার শর্মা, কত্থক নৃত্যশিল্পী বিরজু মহারাজকেও মঞ্চে সংগত করেছেন জাকির হোসেন।
আমরা অপেরা হাউসে গিয়ে দেখি, কানায় কানায় পূর্ণ মিলনায়তন। ভেতরে বাইরে মানুষের ঢল। খেয়াল করে দেখেছি সিংহভাগ মানুষই ছিলেন শ্বেতাঙ্গ । জাকির হোসেন যতবার সিডনি এসেছেন, ততবারই টিকিট পাওয়া ছিল ভাগ্যের বিষয়। এমন গুণী বাজিয়ে দুনিয়ায় বিরল। তবলা  সাধারণত একটি সাধারণ বা  জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্র। বাঙালির  ঘরে ঘরে বহুল প্রচলিত এই তবলা সাধারণ এক বিষয়। একটা সময়  বাংলাদেশের ঘরে ঘরে ছেলেদের তবলা শেখানোর হিড়িক ছিল। কেন জানি মেয়েদের বেলায় এটি অপ্রচলিত হলেও, ছেলে শিশু-কিশোরদের বাদ্যযন্ত্র চর্চার শুরু হতো তবলা দিয়ে । যে কালে গান বাজনা ধ্রুপদী ছিল, মানুষ হারমোনিয়াম আর সাধাশুদ্ধ গলায় গান গাইত, তখন তবলা ছিল অপরিহার্য । মূলত, তবলা ছাড়া বাংলা গান অচল। কিন্তু তবলা যে আলাদা করে তার মহিমায় উজ্জ্বল হতে পারে, সেটা এমনভাবে কেউ ভাবেনি। শুধু ভাবা নয়, করে দেখিয়েছিলেন জাকির হোসেন। জাকির হোসেনের স্ত্রী আনতোনিয়া মিনেকোলা একজন কত্থক নাচিয়ে।


খুব ছোটবেলায় তিনি যে তবলাবাদক হতে চাননি, এটা যেমন সত্যি, তেমনই এটা হওয়া ছাড়া অন্য বিকল্পও যে ছিল না, সেটাও কি অস্বীকার করা যাবে? তাঁর বাবা প্রখ্যাত তবলাবাদক ওস্তাদ আল্লা রাখা খাঁ, যিনি জন্মের পরই সন্তানের কানে দিয়েছিলেন সংগীতের মন্ত্র, যিনি বড়ই হয়েছেন তবলার সুর শুনতে শুনতে; তিনি তবলাবাদক ছাড়া আর কীইবা হতে পারতেন! বড় তবলা বাজিয়ে হলেও তাঁর জনপ্রিয়তার কারণ অনেক।  তাঁর মতো শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পীর জন্য যা খুবই বিরল। এর বড় কারণ বিজ্ঞাপনচিত্রের জিঙ্গেল। ১৯৮৮ সালে একটি চাÑকোম্পানির বিজ্ঞাপনচিত্রের জিঙ্গেল করেন জাকির হোসেন, যা সেসময় মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে।
যে জাকির হোসেনকে মৃত্যুর কয়েক মাস আগে দেখলাম, তিনি তখনো সতেজ। টানা দু’ঘণ্টার বেশি সময় তবলা বাজানো কি মুখের কথা? এই যে দেঢ় থেকে দু’ঘণ্টা সময়, এর ভেতর এক মিনিটের জন্যও তবলা থামেনি। তাঁর সঙ্গে সুর ভাঁজতে থাকা দুই সাউথ ইন্ডিয়ান রমণী থেমে গেলেন, জাকির হোসেন থামেননি। হাতের তালুতে দুনিয়ার ছন্দ আর মাত্রা ছিল তাঁর। সেগুলো এমন ভাবে পরিবেশন করছিলেন, শুনে মনে হয় তবলা কথা বলছে। সাধারণ কথোপকথনকে তিনি তবলার বোলে ফেলে যে ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন, তা আমার মতো বহু মানুষের সাধারণ জীবনে এক অসাধারণ ঘটনা। যা মনে থাকবে চিরকাল।
এত বিনয়ী এত ভদ্র মানুষ বিরল। যখনই সুযোগ মিলেছে, মাথা নত করে হাত জোড় করে প্রণাম জানিয়েছেন। অপেরা হাউসের এই হলটির চারদিকে দর্শক শ্রোতারা বসেন। ফলে, কিছু দর্শক শ্রোতা তাঁর বাজনা শুনলেও তাঁকে দেখেছিল পেছন থেকে। তাঁর মুখ বা হাতের ছন্দ ও তালের কাজ তারা দেখতে পাননি। কিন্তু বুঝতে ও শুনতে পেরেছিলেন। মজার বিষয় হচ্ছে, যখনই দাঁড়িয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করছিলেন, তখনই জাকির সাহেব একবার পেছন ফিরে তাঁদেরও  জানিয়েছিলেন সাদর সম্ভাষণ। তাঁর জীবনে তিনি অর্থের জন্য ক্লাব পার্টি বা ঘরোয়া কোনো অনুষ্ঠানে কোনোদিন তবলা বাজাননি।  তাঁর মতে, এসব জায়গায় মানুষ কিছু শুনতে যায় না। এটা মানুষের সামাজিক পারিবারিক আনন্দের জায়গা। এখানে শিল্প হয় না। এমন নীতিপ্রবণ সৎ মানুষ না হলে কি আর এত বড় হওয়া যায়? তিনি আজ নেই। কিন্তু রেখে গেছেন দুটি যোগ্য সন্তান। এই দম্পতির সংসারে রয়েছে দুই মেয়ে। দুজনেরই জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোতে। বড় মেয়ে আনিসা কুরেশির বয়স ৩৯ বছর। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে স্নাতকোত্তর আনিসা পেশায় একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও প্রযোজক। জাকির হোসেন ও আনতোনিয়া মিনেকোলার ছোট মেয়ে ইসাবেলা কুরেশির বয়স ৩৭ বছর। ইসাবেলা নৃত্যশিল্পী হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। নাচ নিয়ে ডিগ্রিও রয়েছে তার। জাকির হোসেন সব সময় চেয়েছেন, তাঁর সন্তানরা গৎবাঁধা অফিসের কাজের বাইরে সৃজনশীল কিছু করুক। বাবার চাওয়াতেই সৃজনশীল কাজে যুক্ত রয়েছেন আনিসা ও ইসাবেলা। পরপারে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।
[email protected]

×