ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

পানির নিচে ডেটা সেন্টার

ড. এম. মেসবাহ উদ্দিন সরকার

প্রকাশিত: ১৯:৪১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

পানির নিচে ডেটা সেন্টার

ডিজিটাল অর্থনীতি ও প্রযুক্তি উন্নয়নের ফলে মানুষের সমস্ত কাজকর্ম আজ প্রযুক্তি, তথ্য, ইন্টারনেট এবং নেটওয়ার্কের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তিগত টেক্সট করা থেকে শুরু করে পড়াশোনা, গবেষণা, ব্যবসা-বাণিজ্য সবই এখন নিয়মিত কাজের অন্তর্ভুক্ত, যার পেছনে আছে এইসব ডিজিটাল  প্ল্যাটফর্ম। শুধু  ইউটিউবেই প্রতিদিন চার মিলিয়ন বা ৪০ লাখ ঘণ্টার ভিডিও আপলোড করা হয়। প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন (চারশ’ কোটি) মানুষ প্রতিদিন নেটওয়ার্ক ব্যবহার  করছে। আড়াই মিলিয়ন টেরাবাইট নতুন তথ্য তৈরি হচ্ছে প্রতিদিন। পুরনো তথ্যের সঙ্গে এই নতুন তথ্য রাখার জন্য প্রয়োজন বিশাল তথ্য ভাণ্ডার বা ডেটা সেন্টার।  বিশালাকার জায়গাজুড়ে শত শত সার্ভার নিয়ে তৈরি করা হয় একটি ডেটা সেন্টার। কিন্তু যে হারে তথ্যের সংখ্যা বেড়ে চলছে, এগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ করাও ততটা কঠিন হয়ে পড়ছে। সেজন্য ডেটা রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রক্রিয়া সহজতর করে তুলতে মাইক্রোসফট ২০১৮ সালে এক অভিনব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যা হয়তো ভবিষ্যতের ডেটা স্টোরেজ সিস্টেমই পাল্টে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। মাইক্রোসফটের এই পদক্ষেপ যেমন ব্যতিক্রম, তেমনি তাদের সফলতা ডেটা সেন্টারের চিন্তাধারায় অপার সম্ভাবনার মাত্রা যুক্ত করেছে। এটি হচ্ছে ল্যান্ড ডেটা সেন্টারের পরিবর্তে আন্ডারওয়াটার ডেটা সেন্টারের উদ্যোগ। প্রশ্ন আসতে পারে পানির নিচে ডেটা সেন্টারের এই উদ্যোগ কেন? আমরা জানি যেকোনো ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসই ধারাবাহিক ব্যবহারে তাপ উৎপন্ন করে, আর এই সার্ভারগুলো নিরলসভাবে চলতেই থাকে। এতে যে প্রচুর পরিমাণ তাপ উৎপন্ন হয় তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ডেটা সেন্টারগুলোতে ভালো রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন পড়ে, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এছাড়া বায়ুতে থাকা অক্সিজেন, ধূলিকণা ইত্যাদিও সার্ভারের জন্য ক্ষতিকর। সেজন্য সার্ভারগুলোকে যদি বদ্ধ পরিবেশে রেখে পানিতে রাখা যায় তাহলে শীতলীকরণের দায়িত্ব পানির উপরেই ছেড়ে দেওয়া যায়। অনেকেটা নিউক্লিয়ার সাবমেরিনের মতো, সমুদ্রকে তাপশোষক হিসেবে ব্যবহার করা।
ভূমিতে কোনো ডেটাসেন্টার তৈরি করার জন্য যে কয়েকটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্ব সঙ্গে বিবেচনা করতে হয়, তা হলোÑ ১. কমপক্ষে ২০ একর ফাঁকা ভূমি ২. পর্যাপ্ত পানিসম্পদ ৩. শক্তিশালী, নির্ভরযোগ্য এবং সাশ্রয়ী মূল্যের বিদ্যুৎ এবং ৪. তুলনামূলক কম প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রভাবিত এলাকা। সাধারণত: ডাটা সেন্টারগুলো বসতি থেকে দূরে হয়, যা ডেটা ট্রাভেলের (পিং) সময় বাড়িয়ে তোলে। অর্থাৎ, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ডেটা পৌঁছাতে বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যার বসবাস উপকূল থেকে ১২০ মাইলের মধ্যেই। তাই, ডেটা সেন্টারগুলো সমুদ্রে স্থাপন করা যায় তাহলে ডেটা ট্রাভেল টাইম তুলনামূলক কম আসবে। ফলে গেমিং, ব্রাউজিং আরও ভালোভাবে করা সম্ভব। এছাড়া, মাইক্রোসফটের এই ডেটা সেন্টারগুলো এক নাগাড়ে ৫ বছর ফুল-চেকাপ ছাড়াই চলতে সক্ষম এবং পানির নিচ কিংবা সমুদ্রের তলদেশ উপযোগী একটি ক্যাপসুল তৈরিতে সময় লাগবে মাত্র ৯০ দিন (ভূপৃষ্ঠে ডাটা সেন্টার তৈরি করতে সময় লাগে দুই বছর)। ফলে মার্কেটের চাহিদানুযায়ী খুব দ্রুতই এগুলো তৈরি করা যায়। সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে- এই ডেটা সেন্টারগুলো নবায়নযোগ্য। ডেটা সেন্টারটির কন্টেইনার ও অভ্যন্তরীণ সরঞ্জাম সবই তৈরি করা হয় পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপাদান দিয়ে। উল্লেখ্য, ভূমিতে অবস্থিত সার্ভারগুলো শীতল করার জন্য যে শক্তি ও অর্থ ব্যয় হয় তা কমানোর জন্য এবং নবায়নযোগ্য শক্তি দিয়ে চলতে সক্ষম কিনা এটি পরীক্ষার জন্যই প্রযুক্তি জায়ান্ট মাইক্রোসফট প্রায় দুই বছর আগে উত্তর স্কটল্যান্ডের অর্কনি আইল্যান্ডে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল।
যেহেতু আগামী দিনে তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ বজায় রাখতে প্রয়োজন পড়বে অধিক ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ডাটা সেন্টারের, সেজন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছে মাইক্রোসফটের পাশাপাশি বিশ্বের বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি মাইক্রোসফট সমুদ্রের ১০০ ফুট নিচে একটি পরীক্ষামূলক (প্রোটোটাইপ) ডাটা সেন্টার তৈরি করেছে। তাদের মতে সমুদ্রের নিচের ডাটা সেন্টারের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ অনেক সুবিধাজনক। মাইক্রোসফটের এই প্রকল্পের কোড নেম দেওয়া হয়েছে ‘প্রজেক্ট ন্যাটিক’। ২০১৪ সালে মাইক্রোসফটের এক ইভেন্টে, মাইক্রোসফটের দক্ষ প্রকৌশলীরা আন্ডারওয়াটার ডেটা  সেন্টারের আইডিয়া তুলে ধরেন এবং মাইক্রোসফটও সেই বছরেই এটি বাস্তবে রূপদানের জন্য নেমে পড়ে। ডেটা সেন্টারটি প্রায় ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যরে। এতে রয়েছে ১২টি র‌্যাক এবং সেখানে সর্বমোট ৮৬৪টি সার্ভার রয়েছে। ২০১৮ সালে সার্ভারটি স্থাপন করা হয় সমুদ্রের ১১৭ ফুট তলদেশে এবং ২ বছর সফলভাবে কাজ করার পর ২০২০ সালে এটি পুনরায় উত্তোলন করা হয়। এটি ছিল প্রজেক্ট ন্যাটিকের ফেজ-২ এর পরিচালনা। প্রজেক্ট ন্যাটিক ৩টি ফেজের সমন্বয়ে তৈরি। প্রথম ফেজ শুরু হয় ২০১৫ সালে, ক্যালিফোর্নিয়ার শান্ত পানিতে ডেটা সেন্টারটি ডোবানোর মধ্য দিয়ে। ১০৫ দিন ডুবন্ত অবস্থায় রেখে এর ভবিষ্যৎ সম্ভাব্যতা যাচাই করেন গবেষকরা। যার ফলে আশাবাদী হয়ে ২০১৮-তে ফেজ-২ শুরু করে। ফেজ-২ এর উদ্দেশ্য হচ্ছে আন্ডারওয়াটার ডেটা সেন্টারের ধারণাটি পরিবেশ ও অর্থনৈতিকভাবে কতটা যুক্তিযুক্ত তা যাচাই করা। ফেজ-২ এর জন্য মাইক্রোসফট ফ্রান্সের ‘নেভাল গ্রুপ’ নামক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়, যাদের কাজ ছিল সামুদ্রিক প্রতিরক্ষা ও নবায়নযোগ্য শক্তি নিয়ে কাজ করা। তারাই ডেটা সেন্টারটির জন্য ভেসেল ডিজাইন ও ম্যানুফ্যাকচার করে। ১২ মাস বিদ্যুৎ ব্যয়, আর্দ্রতার মাত্রা, তাপমাত্রা ইত্যাদি পরীক্ষার পর ২০২০ সালের ৯ জুলাই ডেটা সেন্টারটি আরও বিশ্লেষণ করার জন্য আবার উত্তোলন করা হয়। এর মাঝে ফেজ-২ সম্পন্ন হয়। পরবর্তী ফেজের উদ্দেশ্য ডেটা সেন্টারের স্থায়িত্ব পরীক্ষা করা, যা প্রক্রিয়াধীন।
প্রচলিত নিয়মের বাইরে অর্থাৎ, ল্যান্ড-বেজড ডেটা সেন্টারের পরিবর্তে সমুদ্রের তলদেশে ডেটা সেন্টার স্থাপনের ফলে সামুদ্রিক প্রাণীদের উপর কোনো প্রভাব ফেলে কিনা- এই প্রশ্ন আসতে পারে। উত্তর হচ্ছে- না। বরং বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণী ডেটা সেন্টারটির আশপাশে নিজেদের নিরাপদ আবাস্থল তৈরি করে বলে জানায় মাইক্রোসফট। এর সঙ্গে এই ডেটা সেন্টারগুলো কোনো গ্রিন হাউস ইফেক্ট তৈরি করে না, যা ভবিষ্যৎ জলবায়ুর জন্য এক বড় আশার বাণী। বলা যায়, মাইক্রোসফটের এই প্রজেক্ট শুধু প্রযুক্তিগত উপকারই করছে না, উপকৃত হচ্ছে পৃথিবীর পরিবেশ ও জলবায়ু। দুটি উল্লেখযোগ্য সুবিধা গবেষকরা চিহ্নিত করেছেন, তা হলো : প্রথমত সার্ভারগুলোতে কোনো মানুষের ছোঁয়া না লাগার কারণেও সেগুলো ভালো থেকেছে। দ্বিতীয়ত অক্সিজেনের পরিবর্তে ক্যাপসুলে প্রবাহিত করা হয়েছিল নাইট্রোজেন। মূলত নাইট্রোজেনসমৃদ্ধ পরিবেশের কারণে কনটেইনারের ভেতরের তাপমাত্রা ছিল কম এবং এতে যন্ত্রপাতি বেশির ভাগ সময়ই ঠাণ্ডা থেকেছে, নষ্টও হয়েছে কম। অপরদিকে কনটেইনারের ভেতরে থাকা ৮৫৫টি সার্ভারের মধ্যে বিকল হয়েছে মাত্র আটটি। সাধারণ ডাটা সেন্টারের তুলনায় এই হার অনেক ভালো। অর্থাৎ, পানিতে সার্ভার বিকল হয়ে যাওয়ার হার স্থলভূমির আট ভাগের এক ভাগের সমান। কিন্তু এজন্য ল্যান্ড-বেজড ডেটা সেন্টারগুলোও উধাও হয়ে যাবে এমনটি নয়। কারণ বিশ্বের প্রায় ৫০ শতাংশ জনসংখ্যার বসবাস উপকূলের ১২০ মাইলের আশপাশে হলেও বাকি ৫০ শতাংশের নির্বিঘ্ন সেবা নিশ্চিত করার জন্য ল্যান্ড-বেজড ডেটা সেন্টারের প্রয়োজন। অবশ্য ছোট স্টার্টআপগুলোর জন্য সমুদ্রের চেয়ে ভূমিতে ডেটা সেন্টার করা লাভজনক। চীন ইতোমধ্যে একটি পরীক্ষামূলক ডেটা সেন্টার জুলাইয়ে উদ্বোধন করেছে, যা দেখতে অনেকটা প্রজেক্ট ন্যাটিকের মতোই। পরিশেষে, ইন্টারনেটে ভিডিও স্ট্রিমিং, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ও মেইল আদান প্রদান যাই করি না কেন তার মূল শক্তি হচ্ছে ডাটা সেন্টার। আর এসব সার্ভারের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত তাপমাত্রায় সার্ভারগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেক্ষেত্রে সমুদ্রের নিচে ডাটা সেন্টারের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা অনেক সহজ হয়। ফলে আলাদা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির দরকার হয় না, এতে বিদ্যুৎ খরচও কমে আসবে। টারবাইন বা জলবিদ্যুতের মাধ্যমেও এই ডাটা সেন্টারে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে ভবিষ্যতে।

লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

×