ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

যেমন চাই ঢাকা

রাকিব হাসান

প্রকাশিত: ১৯:৩৮, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪; আপডেট: ২০:২৬, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

যেমন চাই ঢাকা

ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ নগরী। একসময় মুঘলদের হাত ধরে শহরটির গুরুত্ব বাড়লেও সময়ের পরিক্রমায় এটি পরিণত হয়েছে এক অপরিকল্পিত নগরীতে। ঢাকার বর্তমান চেহারা এবং অবকাঠামোগত সংকট এর ইতিহাস এবং প্রশাসনিক দুর্বলতার ফল। এখানে ঢাকার অপরিকল্পিত নগরায়নের ঐতিহাসিক পটভমি, বর্তমান চ্যালেঞ্জ এবং এর থেকে উত্তরণের পথ নিয়ে আলোচনা করা হলো।

ঢাকা শহরের ইতিহাস প্রায় ৪০০ বছরের পুরোনো। ১৬০৮ সালে মুঘল আমলে শহরটি প্রথমবারের মতো গুরুত্ব পায়। মুঘল শাসকেরা এটি বাংলার রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন। তখন মুঘল সাম্রাজ্যের সামরিক বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে ঢাকায় দ্রæ উন্নয়ন ঘটে। কিন্তু এই উন্নয়ন মূলত প্রশাসনিক বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ছিল, শহরটির নাগরিক পরিকল্পনায় খুব বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়নি। মুঘল শাসনামলে শহরটি প্রসারিত হলেও এর অবকাঠামো প্রাথমিক পর্যায়েই রয়ে যায়। 

১৭৫৭ সালে ব্রিটিশরা বাংলা দখল করার পর ঢাকার গুরুত্ব কিছুটা কমে যায়। তবে ব্রিটিশ শাসনামলে কিছু আধুনিক উন্নয়ন ঘটে, যেমন রেলপথ স্থাপন এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভবন নির্মাণ। কিন্তু ব্রিটিশদের লক্ষ্য ছিল প্রশাসনিক কার্যক্রম, ফলে সাধারণ মানুষের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পর ঢাকা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হলে জনসংখ্যা হঠাৎ বৃদ্ধি পায়। নতুন শাসনব্যবস্থার জন্য কিছু অবকাঠামো উন্নয়ন হলেও এটি পরিকল্পিত ছিল না। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ঢাকা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে আরও গুরুত্ব পায়। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি নগর প্রশাসনের সীমাবদ্ধতার কারণে শহরের পরিকল্পিত উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। 

ঢাকার অপরিকল্পিত নগরায়নের জন্য একাধিক কারণ চিহ্নিত করা যায়। স্বাধীনতার পর থেকেই ঢাকার জনসংখ্যা দ্রæ বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রাম থেকে শহরমুখী অভিবাসনের ফলে শহরের ওপর বিশাল চাপ তৈরি হয়। ঢাকার মতো একটি শহর যেখানে মাত্র ৩০ লাখ মানুষের জন্য অবকাঠামো তৈরি হয়েছিল, সেখানে বর্তমানে প্রায় কোটির বেশি মানুষ বসবাস করছে। জনসংখ্যার এই চাপ সামাল দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। ঢাকার উন্নয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো সময়োপযোগী পরিকল্পনা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। শহরের জমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি অনুসরণ করা হয়নি। আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প এলাকা একত্রে মিশে গিয়ে এলোমেলো পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। পাশাপাশি মি ব্যবস্থাপনা একটি বড় সমস্যা। অনুমোদনহীন ভবন নির্মাণ, অবৈধ দখল, এবং সঠিক নকশা অনুমোদন ছাড়াই উন্নয়ন কর্মকাÐ পরিচালিত হয়েছে। ফলে শহরের রাস্তাঘাট সংকীর্ণ এবং খোলা জায়গার অভাব দেখা দিয়েছে।

ঢাকা একসময় নদী খালবেষ্টিত ছিল। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ এবং বালু নদী ঢাকার পরিবেশকে প্রভাবিত করত। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে খালগুলো দখল হয়ে গেছে, জলাশয় ভরাট করে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এতে করে জলাবদ্ধতা এবং বন্যার প্রকোপ বেড়েছে। নিয়ন্ত্রণ না থাকার ফলে রাস্তা-ঘাট অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠার ফলে যানজট একটি সাধারণ সমস্যা। গণপরিবহন ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় ব্যক্তিগত যানবাহনের ব্যবহার বেড়েছে। এতে করে পরিবেশ দূষণও বৃদ্ধি পেয়েছে।

ঢাকার বর্তমান সংকট গুলো ধীরে ধীরে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। সংকট গুলো নিরসন করা না গেলে ঢাকা হবে অবাসযোগ্য শহর। কয়েকটি সংকট নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই আসবে ঢাকার জবাব। ঢাকার বৃষ্টি বা বন্যার সময় জলাবদ্ধতা নিত্যদিনের সমস্যা। ড্রেনেজ ব্যবস্থা অকার্যকর এবং খাল-জলাশয়ের অভাবে পানি সহজে নিষ্কাশিত হয় না। অপরিকল্পিত নির্মাণকাজ, যানবাহনের ধোঁয়া, এবং শিল্প কারখানার বর্জ্য ঢাকাকে বিশ্বের অন্যতম দূষিত নগরী হিসেবে পরিচিত করেছে। শীতকালীন সময়ে বায়ুদূষণে রেকর্ড করছে তিলোত্তমা ঢাকা। যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

 মধ্যবিত্ত এবং নি¤œবিত্তদের জন্য পর্যাপ্ত বাসস্থান নেই। ফলে বস্তি এলাকা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য সামাজিক সেবার ক্ষেত্রে ঢাকার অবস্থাও করুণ। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে এই খাতে সঠিক বিনিয়োগ সম্ভব হয়নি। 

ঢাকার মতো একটি অপরিকল্পিত নগরীকে পরিকল্পিতভাবে সাজানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এই সংকট দূর করা সম্ভব। প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী নগর পরিকল্পনা। রাজউক এবং অন্যান্য সংস্থাকে ঢাকার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বাসস্থান, পরিবহন, এবং শিল্প এলাকার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি। ঢাকার জলাধার, খাল, এবং নদীগুলো পুনরুদ্ধার করে ড্রেনেজ ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। জলাবদ্ধতা দূর করতে পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।  সবথেকে কার্যকরী পদক্ষেপ হবে ঢাকার ওপর থেকে চাপ কমানো। প্রশাসনিক এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রম বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে এবং অন্য শহরগুলোতে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে যাতে ঢাকার জনসংখ্যার চাপ হ্রাস পাবে। 

যাতায়াতের উন্নতি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। মেট্রোরেল, বিআরটি (বাস ্যাপিড ট্রানজিট), এবং অন্যান্য পরিবহন প্রকল্প দ্রæ কার্যকর করে ঢাকার যানজট সমস্যার সমাধান করতে হবে। ভবন নির্মাণের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা মেনে চলা দরকার। দরকার জমি ব্যবস্থাপনায় সুষ্ঠু পরিকল্পনা। শহরের বাহিরে পরিকল্পিতভাবে নতুন শিল্পাঞ্চল বাণিজ্যিক এলাকা তৈরি। নগর উন্নয়নে দুর্নীতি বন্ধ এবং সঠিক প্রশাসনিক কাঠামো নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া নগরবাসীর জন্য নিরাপদ বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ এখনও যথেষ্ট নয়। পানি সরবরাহ লাইনগুলোতে লিকেজ এবং দূষণের সমস্যা প্রকট। 

"যেমন ঢাকা চাই" এর স্বপ্ন বাস্তবায়ন অসম্ভব নয়। পরিকল্পিত সমাধান এবং সকলের সমন্বিত উদ্যোগেই ঢাকা হতে পারে আদর্শ শহর। এরজন্য প্রয়োজন সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন বাস্তবায়ন, দুর্নীতি অব্যবস্থাপনা দূর করা, সরকারি বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ, নাগরিকদের দায়িত্বশীল আচরণ সচেতনতা বৃদ্ধি। ঢাকা শহর তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং অর্থনৈতিক সামর্থ্য সত্তে¡ একটি অপরিকল্পিত নগরী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই শহরের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে পরিকল্পিত নগরায়নের দিকে এগিয়ে যেতে হলে প্রশাসনিক সামাজিক উদ্যোগের প্রয়োজন। সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং সক্রিয় নাগরিক অংশগ্রহণের মাধ্যমেই ঢাকাকে একটি বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।

 

শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ

×