বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার ‘নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন’ গঠন করেছে। কমিশনের কার্যপরিধিতে সর্বমোট দশটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই দশটি বিষয়ের মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থায় নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোনো কিছু অন্তর্ভুক্ত করা হয় নাই এবং একই সঙ্গে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্যদের মাঝে কোনো নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ না রেখে সামগ্রিক নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় ‘নিরাপত্তা’ সংক্রান্ত বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাস পর্যলোচনা করলে দেখা যায় প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে প্রান্তিক পর্যায়ে নিম্নলিখিতভাবে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে :
* ব্যালট বাক্স ছিনতাই
* ব্যালট পেপার ছিনতাই
* প্রিসাইডিং অফিসারকে মারধর
* রাতে এবং দিনে ব্যালট বাক্স ভরা
* ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধা
* ভুয়া ভোটার, ভুয়া ভোট এবং ভোট কারচুপি
* এজেন্টদের মারধর করে বের করে দেওয়া
* কেন্দ্র দখল
* ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনের অপব্যবহার
* ভোটারদের ভয়ভীতি
নিম্নলিখিত কারণে বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছেÑ
* কলুষিত রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি
* দুর্নীতিগ্রস্ত এবং নৈতিকতাবর্জিত প্রধান নির্বাচন কমিশনার : ব্যর্থ ও বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রধান নির্বাচন কমিশনারের জন্য প্রযোজ্য।
* নিরাপত্তা বাহিনীর দুর্নীতিবাজ, অপেশাদার এবং নৈতিকতাহীন নেতৃত্ব, যা বাংলাদেশের দুঃসময়ে এবং নির্বাচনকালীন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের সময় প্রমাণ হয়েছে।
* নির্বাচনে নিরাপত্তা বাহিনীকে ত্রুটিপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান
* নির্বাচনে নিরাপত্তা বাহিনীর ত্রুটিপূর্ণ মোতায়েন
* নির্বাচনে নিরাপত্তা বাহিনীর সীমাবদ্ধতা
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের পক্ষে উল্লিখিত সকল ক্ষেত্রে সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করা সম্ভব নয়। তবে তারা সংস্কার কার্যক্রমে উল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে পারে। প্রান্তিক পর্যায়ে নির্বাচন সামগ্রী এবং সকল ভোটারের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনকে অবশ্যই নিম্নলিখিত বিষয়ের ওপর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে :
নির্বাচন পরিচালনায় নিরাপত্তা বাহিনীকে সঠিক দায়িত্ব প্রদান
মাঠ পর্যায়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যগণ স্পষ্ট নির্দেশনার অভাবে তাদের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়। এই পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রত্যেক পর্যায়ে স্পষ্ট দায়িত্ব প্রদান করে মোতায়েন করা না হলে সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যর্থ হবে। জানা দরকার যে, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যগণ লিখিত নির্দেশনার বাইরে কোনো দায়িত্ব পালন করবে না। ফলে কাক্সিক্ষত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য উদ্দেশ্য অনুযায়ী স্পষ্ট দায়িত্ব বণ্টন করা অপরিহার্য।
নিরাপত্তা বাহিনীর কার্যকর মোতায়েন
বিগত নির্বাচনে বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনী আলাদা আলাদাভাবে মোতায়েন করা হয়েছে। বিচ্ছিন্নভাবে মোতায়েনের ফলে বাহিনীসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয় কঠিন হয়ে পড়ে এবং নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। নির্বাচনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের সকল নিরাপত্তা বাহিনী এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের একটি একক পরিকল্পনা এবং একক নেতৃত্বে মোতায়েন করতে হবে, যা বিগত দিনে উপেক্ষিত হয়েছে। এইক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে ও সামরিক কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচনের সামগ্রিক নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হলে সঠিকভাবে নিরাপত্তা বাহিনীর মোতায়েন সম্ভব হবে এবং কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যাবে।
নিরাপত্তা বাহিনীর সীমাবদ্ধতা
একদিনে সমগ্র বাংলাদেশে নির্বাচন পরিচালনা করা হলে নিরাপত্তা বাহিনীসমূহের পক্ষে কার্যকর এবং সমভাবে দেশের সকল স্থানে জনগণের নিরাপত্তা ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করা সম্ভন হয় না। এই পরিস্থিতিতে বিভাগভিত্তিক কয়েকদিনে দেশে নির্বাচন পরিচালিত হলে সকল নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের পক্ষে কার্যকরভাবে সকল স্থানে জনগণের নিরাপত্তা এবং ভোটাধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ তৈরির সুযোগ পেয়েছি। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ সংস্কারের পক্ষে। বাংলাদেশের বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের মাধ্যমে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করে বাংলাদেশে জনপ্রতিনিধিত্বশীল ও কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাচন ব্যবস্থার নিরাপত্তা অপরিহার্য। আমার বিশ্বাস, নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার কমিটি বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
লেখক : সাবেক সেনা কর্মকর্তা
[email protected]