ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

প্রবৃদ্ধির দেশে বৈষম্যের বিষফোঁড়া: ৫% হাতেই ৯০% সম্পদ!

ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম

প্রকাশিত: ০২:১০, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রবৃদ্ধির দেশে বৈষম্যের বিষফোঁড়া: ৫% হাতেই ৯০% সম্পদ!

ছবি: প্রতীকী

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিশ্বের অনেক দেশের কাছেই এখন উদাহরণ। মাথাপিছু আয়, রেমিট্যান্স, শিল্পখাতের সম্প্রসারণ – সবকিছুই ইতিবাচক। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধির ছায়ায় যেটা ঢেকে আছে, সেটাই সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ – ধনী-গরিবের মধ্যকার প্রকট বৈষম্য।

সম্প্রতি প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ১০% জনগোষ্ঠীর হাতে ৮০% সম্পদ কেন্দ্রীভূত। আশঙ্কার কথা হলো, এই প্রবণতা চলমান থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ৫% জনগোষ্ঠী পুরো ৯০% সম্পদের মালিক বনে যাবে। অর্থাৎ, বাকি ৯৫% মানুষ ভাগ বসাবে মাত্র ১০% সম্পদে। এটি কোনো সুস্থ অর্থনৈতিক কাঠামোর লক্ষণ নয়। বরং এটি একটি বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির ইঙ্গিত দেয়।

কেন এই বৈষম্য?
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সাধারণ জনগণের মাঝে সুষমভাবে বণ্টিত না হওয়া এর প্রধান কারণ। শিল্পপতি, বড় ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিকদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, যা একটি ‘সিন্ডিকেট’ তৈরি করেছে। দেশের বড় প্রকল্প, ব্যাংক ঋণ এবং সরকারি সুবিধাগুলো মূলত এই শ্রেণির হাতে কেন্দ্রীভূত। ফলে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠী উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।

বৈষম্য কমানোর পথ কী?
বৈষম্য কমানোর জন্য দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সঠিক নীতি এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ। আমরা যদি সত্যিই পরিবর্তন চাই, তাহলে কিছু কঠোর কিন্তু ন্যায়সঙ্গত পদক্ষেপ নিতে হবে।

১. ধনীদের উপর প্রগতিশীল কর নীতি:
ধনীদের উপর উচ্চ হারে কর আরোপ করতে হবে এবং এই করের অর্থ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক সুরক্ষায় ব্যয় করতে হবে।

২. ভূমি সংস্কার এবং কৃষিখাতের উন্নয়ন:
ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে জমি বিতরণ এবং কৃষিখাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি বৈষম্য কমানোর গুরুত্বপূর্ণ উপায়। কৃষির ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীকে টিকিয়ে রাখতে হবে।

৩. শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার সম্প্রসারণ:
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে রাষ্ট্রের বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা গেলে ভবিষ্যতে ধনী-গরিবের পার্থক্য কমবে।

৪. ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য সহজ শর্তে ঋণ:
ব্যাংক থেকে বড় ব্যবসায়ীদের ঋণ পাইয়ে দেওয়ার পরিবর্তে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা চালু করতে হবে।

৫. ন্যায্য মজুরি এবং শ্রম অধিকারের সুরক্ষা:
শ্রমিকদের জন্য ন্যায্য মজুরি এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। শিল্প খাতে শ্রমিকদের অংশগ্রহণমূলক মডেল তৈরি করতে হবে, যেখানে তারা লাভের একটি অংশ পায়।

রাজনৈতিক সদিচ্ছা কি আছে?
প্রশ্ন উঠছে, যারা ক্ষমতায় আছেন এবং যাওয়ার দৌড়ে আছেন, তারা কি সত্যিই বৈষম্য কমাতে চান? ইতিহাস বলে, ক্ষমতায় থাকলে রাজনৈতিক দলগুলো ধনীদের পক্ষেই নীতি প্রণয়ন করে। কারণ তারাই অর্থায়ন করেন, তারাই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বড় ভূমিকা রাখেন। বিএনপি, জামায়াত বা নতুন কোনো রাজনৈতিক শক্তি – কেউই এই বাস্তবতা থেকে মুক্ত নয়। কিন্তু জনগণের চাপ যদি বৃদ্ধি পায়, তাহলে বৈষম্য কমানোর প্রয়োজনীয়তা অগ্রাহ্য করা সহজ হবে না।

নতুন নেতৃত্ব এবং ছাত্রদের ভূমিকা:
বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বের বাইরে ছাত্র ও যুব সমাজের নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা প্রবল। সম্প্রতি ছাত্রনেতাদের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং তাদের নতুন দল গঠনের উদ্যোগ আশাব্যঞ্জক। ভবিষ্যতের বাংলাদেশ বিনির্মাণে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে, তাদের অবশ্যই দলীয় রাজনীতির সীমানা ছাড়িয়ে জাতীয় স্বার্থে কাজ করতে হবে।

একতা ও জাতীয় ঐক্যই শেষ ভরসা:
বাংলাদেশের জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি বিষয় জাতীয় ঐক্য। সব রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী, কৃষক-শ্রমিককে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমেই একটি সুষম সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।

দেশের জন্য এই বৈষম্য একটি দীর্ঘমেয়াদি হুমকি। এটি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, বরং সামাজিক অস্থিরতাও ডেকে আনতে পারে। আমরা যদি এখনই বৈষম্য দূরীকরণে যথাযথ পদক্ষেপ না নিই, তাহলে ভবিষ্যতে এ দেশের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য।

লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী গবেষণা কেন্দ্র

মেহেদী কাউসার

×