লন্ডনে এখন শীত। হাড় কনকনে, গা হিম করা শীত। থেকে থেকে ঠান্ডা-নরক থেকে উড়ে আসা বাতাস। এর সঙ্গে দুর্দশা চরমে তুলতেই যেন যখন-তখন বৃষ্টি। আকাশের মুখ হাঁড়ি। সূর্যের মুখ দেখা অতি ভাগ্যের ব্যাপার। সকাল পাতে পড়তে না পড়তেই দুপুর। ওদিকে দুপুর গড়াতেই সন্ধ্যা নেমে পড়ে ঝুপ করে। বিকেল, গোধূলি-এসব আপাতত অতীতের ব্যাপার। রাতে কুয়াশার ছদ্মবেশে মৃদু তুষার পড়ে প্রায় দিনই। বেশিরভাগ সময় অবশ্য সকাল হওয়ার আগেই ওরা জলে-গলে মিলিয়ে যায় রাস্তার অতলে। এর মাঝে দুয়েকদিন সত্যিকারের তুষার পড়েছিল। লন্ডনে খুব একটা দাঁড়াতে পারেনি অবশ্য। তবে বাইরের কিছু কিছু শহরে সাদা রঙে ছয়লাপ করে দিয়েছিল। বৃষ্টি হলে ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’। তুষার পড়লে কিচ্ছু নড়ে না। অঝোরে ঝরে যাওয়া, অথচ এমন আশ্চর্য নৈশব্দ- না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
এ লেখা যখন লিখছি, উইকএন্ডের ভোরে, শুনতে পাচ্ছি জানালার খড়খড়িগুলো বাতাসের ধাক্কায় কাঁপছে। যেন কোনো অশরীরী ঘরে ঢুকে পড়তে চাইছে। বাড়ির পেছনের বাগানের গাছগুলোর ডালে ডালে বিচিত্র সব শব্দ উঠছে। বাইরে নিকষ অন্ধকার। কাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির জলধারা এখন জমে বরফ হয়ে রয়েছে যত্রতত্র। রাস্তার দুপাশে জ্বলতে থাকা সড়কবাতির ছিটকে আসা আলোয় বরফখণ্ডগুলোকে বিন্দু বিন্দু মুক্তার দানা বলে ভ্রম হয়। ঘরে হিটার জ্বালিয়ে নিজেকে চলনক্ষম রাখার যুদ্ধ এখন প্রতিদিনকার। আর গাছগুলো? রাস্তার দুপাশে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা আকাশমুখী গাছগুলোকে দেখে আপনার বোধ হয় মায়াই লাগবে। পত্রঝরার শোকসভা শেষে এখন কেবলিই নিজের কঙ্কালটিকে বাঁচিয়ে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টায় হাড়-পাঁজর বের করা ভূত যেন। অবিশ্রান্ত ঘাড় হেঁট করে ঝিমোচ্ছে অনাগত গ্রীষ্ম দিনের উষ্ণতার আশায়। রুক্ষ্ম শীত, বাতাসের তীব্র আঁচড়, হাড়-অব্দি ঢুকে পড়তে চাওয়া হিংস্র হিম- এর মাঝেই জীবনের তাগিদে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি। চুলের ডগা থেকে পায়ের পাতা অব্দি মোটা কাপড়ে বস্তাবন্দি কয়েকজনকে দেখলাম এই হিংস্র ভোরের শীতের কামড় উপেক্ষা করেও গুটি গুটি পায়ে বড় রাস্তার দিকে চলেছে। জীবনের দায় বলে কথা!
তবে এ ছবিটাই আসলে সবটা নয়। সময়টা এখানে এখন উৎসবেরও। রং, সংগীত, আলো। বছর ঘুরে এখানে আবার ক্রিসমাস। বিচিত্র ঝাড়বাতির সমারোহে ক্রমে সেজে উঠছে এ শহরের রাস্তাঘাট, বিপণি বিতান, অতি উৎসাহী কারও কারও ঘরবাড়ি। জানালায় জানালায় সান্তাক্লজের সফেদ দাঁড়ি আর ঘোরলাগা চোখ। পিঠে তার উপহারের বস্তা। প্রস্তুত রেইনডিয়ারের জাদুকরি গাড়ি। ‘এই যেন উড়াল দিবে’- ভঙ্গির দিকে মুগ্ধ হয়ে না তাকিয়ে উপায় নেই। ঘরে ঘরে ক্রিসমাস ট্রিতে জড়ানো আলোর বিচিত্র খেলা। শুরু হয়েছে উপহার কেনা-বেচার ভরা মওসুম। ক্রিসমাস সংগীত প্রতিটি দোকানে, শপিংমলে। প্রতিটি বিপণি বিতান উপচে পড়ছে রঙিন উপহার সামগ্রীর স্তূপে। দলে দলে সুবেশী নারী-পুরুষের পদচারণায় মুখর এ শহরের প্রতিটি কোণায় কোণায় কান না পাততেই ‘জিংগল বেল।’ সত্তর কিংবা আশির দশকের মনমাতানো সব ক্রিসমাস সংগীত ফিরে ফিরে আসে এ সময়টায়। লন্ডনে এই এক অদ্ভুত সুন্দর সময়। ছুটির আমেজ লাগতে শুরু করেছে ইতোমধ্যে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে কফি হাউসগুলোতে সকাল-সন্ধ্যায় উপচে পড়ে উষ্ণতালোভী পথচারীদের ভিড়ে। কফির মন মাতানো গন্ধ, হাতে হাতে গরম চকোলেটের ধোঁয়া ওড়া কাপ। চারদিকে ‘ধুম চলেছে বেচা-কেনা’।
গত সপ্তাহে এখানে ছিল ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এদেশে সদ্য আসা এই পুঁজিবাদী ‘গিমিকে’ মজে যাওয়া যুক্তরাজ্যবাসীর ব্ল্যাক ফ্রাইডে উদযাপনের উন্মাদনাটা কয়েকটা সংখ্যা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করা যাক। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি পাঁচজনের একজন পূর্ণবয়স্ক নাগরিক দিনটিকে কেন্দ্র করে কিছু না কিছু কিনেছেন। এসব জিনিসপত্র কিনতে যুক্তরাজ্যবাসী প্রতি মিনিটে দুইশত তেত্রিশ হাজার পাউন্ড খরচ করেন ব্ল্যাক ফ্রাইডের সময়টাতে। এত টাকা আসে কোথা থেকে? হিসাব বলছে, শতকরা ছাপান্ন ভাগ খরচ করা হয় ক্রেডিট কার্ড থেকে। সোজা কথায়- ধার করে। এ বছরের হিসাবটা এখনো হালনাগাদ হয়নি। মানে ব্ল্যাক ফ্রাইডে গত হয়ে গেলেও তার আমেজ এখনো চলছে। দিব্যি মনভোলানো ‘ডিল’ এবং কেনাকাটা চলমান। তবে ধারণা করা হচ্ছে এই ছোট্ট সময়টাকে ঘিরে অন্তত ৭.১ বিলিয়ন পাউন্ডের কেনাবেচা চলবে, যা গত বছরের তুলনায় ৩৭% বেশি। অথচ বাস্তবতা হলো, যত কেনাবেচা হয় দিনটিকে উপলক্ষ করে তার আশি শতাংশ জিনিসপত্র শেষ পর্যন্ত দুয়েকবার ব্যবহারের পর অদরকারী ঝঞ্জাল হিসেবে ঘরে পড়ে থাকে। না হলে বাইরে ফেলে দেওয়া হয়।
ফিরে যাওয়া যাক উৎসবের কথায়। লন্ডন শহরের মূল আকর্ষণ, অন্তত আমার কাছে, এর ঝলমলে বর্তমান নয়, এর রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো অতীত, অতি যত্ন করে রাখা অতীতের আঁকিবুঁকি, তুলির আঁচড়। হয়তো হাঁটছেন খুব সাধারণ একটা রাস্তায়, একই চেহারা আর বেশ-ভূষা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িগুলোর ওপর চোখ বুলাতে বুলাতে চোখ যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ছে দেখলেন কোনো একটা বাড়ির ওপর বেশ ছোট একটা সাইনবোর্ড- ‘এখানে ১৮৭০ সালে ডারউইন কয়েকমাস কাটিয়ে গেছেন।‘ কিংবা, দেখলেন, লেখা- ‘এ রাস্তা ধরে হাঁটতেন জন কন্সটেবল’। মুহূর্তে আপনার মধ্যে ঢুকে পড়বে এক অদ্ভুত অতীত, ঢুকে পড়বেন এক অবশ্যম্ভাবী ঘোরে, অচিরেই বুঝতে পারবেন আমরা কেউই আসলে বিচ্ছিন্ন কোনো সত্তা নই। সময় যদি হয় একটি লম্বা ফিতে আমরা প্রতিটি মানুষ তার একেকটা সুতো। অতীতকে মুছে ফেলে সামনে যে এগোনো যায় না, এগোনো উচিত নয়, এগোলে দশাহীন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে জাতি ও দেশের ভবিষ্যত তা লন্ডনের প্রতিটি রাস্তা আপনাকে শেখাবে। এ শহর আপনাকে শেখাবে কোনো অতীতই ফেলনা নয়। শেখাবে, পরিবর্তন দরকারি প্রক্রিয়া, কিন্তু তা যেন সেজে ওঠে অতীতের বিশ্বস্ত পরতের ওপরে। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় যার যা দায়, যার যা পাওনা, তা উদার মনে স্বীকার করতে না পারলে পর প্রজন্ম হয়ে উঠতে পারে বিলকুল দেউলিয়া। শেকড়হীন উপড়ানো বৃক্ষ।
হাড় কাঁপানো শীত। আলো ঝলমলে বছরান্তের উৎসব। আগামী কয়েকদিন আমাদের এখানে এমন। শেষ করা যাক বেশ কিছুদিন আগে পড়া লন্ডন আন্ডারগ্রাইন্ডের ট্রেনের গায়ে উৎকীর্ণ করে রাখা জনৈক কবির (কবির নামটা মনে পড়ছে না, লাইন ক’টির অক্ষম অনুবাদটি আমার), কয়েকটা রোমান্টিক লাইন দিয়ে- ‘... তোমার বাড়ির দিকে রওয়ানা হবে আজ রাত্রির শীত, তার জন্য এক চিলতে কবাট খোলা রেখো যেনো, আমি যে উষ্ণতা ছিলাম, ও ভিন্ন আর কে তোমাকে মনে করিয়ে দিতে পারে এ সত্যিটি...।’
১০ ডিসেম্বর ২০২৪
মড়ফফড়ংযধমড়ৎ@মসধরষ.পড়স