ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

আকস্মিক বন্যা ও শহরাঞ্চলের প্রস্তুতি

লে. কর্নেল মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন, জি+, আর্টিলারি

প্রকাশিত: ২০:২০, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

আকস্মিক বন্যা ও শহরাঞ্চলের প্রস্তুতি

গত ২১ আগস্ট ২০২৪ তারিখে ফেনী জেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা। বিগত একশ’ বছরে এ ধরনের ভয়াবহ বন্যা দেখেছে বলে ফেনীর প্রবীণদের মধ্যে কেউ বলতে পারেনি। ফেনী  বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি জেলা। সীমান্ত সংলগ্ন জেলাটির পূর্বদিকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য অবস্থিত। এ বছর বৃষ্টির পরিমাণ এত বেশি ছিল যে, সম্পূর্ণ ফেনী জেলার ছয়টি উপজেলায় হঠাৎ করেই পানি বৃদ্ধি পেয়ে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করে। নদীমাতৃক এই দেশে যে সমস্ত মানুষ নদীর আশপাশে বসবাস করে তারা বন্যা পরিস্থিতি খুব সহজেই মানিয়ে নেয় এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পরে বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যায়। ফেনী জেলা এমন একটি ভৌগোলিক অবস্থানে অবস্থিত যেখানে সচরাচর বন্যা হয় না, কিন্তু কখনো কখনো অতিবৃষ্টির কারণে বড় ধরনের বন্যার আশঙ্কা থেকেই যায়। ফেনীর মতো অন্যান্য শহরের বাসিন্দারা যেহেতু বন্যার সঙ্গে তেমন অভ্যস্ত নয়, যার ফলে তারা খুব অল্পতেই দিশাহারা হয়ে পড়ে। এই আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির কারণে তাদের বিপদে পড়তে হয়। এ ধরনের আকস্মিক বন্যায় শহরাঞ্চল আক্রান্ত হলে তা মোকাবিলা করার জন্য একটি  সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা বা গাইডলাইন বা প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে। কেননা শহরাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষগুলো সচরাচর পানিবন্দি অবস্থায় বা পানিবন্দি পরিস্থিতি কিভাবে মোকাবিলা করতে হয় এ বিষয়ে তেমন  অভিজ্ঞ নয়। তাই ফেনীর মতো এ ধরনের শহরাঞ্চলে যদি আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি হয়, সেই সময় শহরবাসী কিভাবে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে তারই একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং আকস্মিক বন্যা মোকাবিলায় পূর্ব প্রস্তুতি সংক্রান্ত সুপারিশ থাকবে লেখার শেষ অংশে।
২। ২০ আগস্ট ২০২৪ পূর্ব থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে ক্রমশ ফেনী অঞ্চলের খাল-বিল,নদী-নালার পানি ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে। এভাবে চলমান বৃষ্টি কোনোভাবেই যখন থামছে না তখন ২১ আগস্ট ২০২৪-এ হঠাৎ করে পরিস্থিতির অবনতি হওয়া শুরু করল।  ধীরে ধীরে বৃষ্টির ফলে পানি বৃদ্ধি পেয়ে যখন ফেনী শহরাঞ্চল এবং ফেনী জেলার অন্যান্য উপজেলা প্লাবিত হলো ঠিক তখনই বন্যার পানিতে আটকে যাওয়া মানুষগুলোকে অন্যত্র স্থানান্তর করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল।  একদিকে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে সোশ্যাল, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় মানুষের দুর্দশার চিত্র ফুটে উঠেছিল। পানি বৃদ্ধির ফলে এক পর্যায়ে ছয়টি উপজেলায় অবস্থিত মোবাইল নেটওয়ার্কসমূহ যখন ক্রমশ অকার্যকর হয়ে পড়েছিল তখন মানুষ তাদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।  যার ফলে এই অসহায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোর প্রকৃত চিত্র সঠিকভাবে তাদের আত্মীয়স্বজন এবং প্রশাসন জানতে ব্যর্থ হয়। ইতোমধ্যে সীমান্ত এলাকায় পানি বৃদ্ধির ফলে নদীর বাঁধের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে বাঁধ ভেঙে দ্রুত পানি পরশুরাম উপজেলার নিজ কালিকাপুর দিয়ে ফেনী শহরে প্রবেশ করে। যার ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা, বৈদ্যুতিক সংযোগ এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
৩। এই অঞ্চলে পানি এমনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, উদ্ধারকর্মীরা এক স্থান থেকে মানুষজনকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে এনে পুনরায় ফেরত যাওয়ার মতো সময় ও দূরত্বের কারণে সম্ভব ছিল না। একই সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে কারও কোনো খোঁজখবর পাওয়া যাচ্ছিল না। পানি বৃদ্ধির এক পর্যায়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে সড়কটিও ক্ষতিগ্রস্ত  হয়। ন্যাশনাল লাইফলাইন নামে পরিচিত সড়কটি যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন দুই পাশে অসংখ্য যানবাহন আটকে যায় এবং উদ্ধার কাজও ব্যাহত হয়। রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে উদ্ধার কাজের জন্য আগত নৌকাসমূহ ফেনীতে আসতে ব্যর্থ হয়। তৎক্ষণাৎ ফেনী ব্যাটালিয়নের (৪ বিজিবি) সার্বিক পরিকল্পনায় বিজিবি সদস্যরা রাস্তার ওপরে পড়ে থাকা গাছ করাত ও কুড়াল দিয়ে কেটে রাস্তা পরিষ্কার করে রাস্তার ট্রাফিক জ্যাম দ্রুত নিরসন এবং উদ্ধার কাজে আগত নৌকাসমূহকে বন্যা কবলিত এলাকায় আসতে সহায়তা করে।
৪। সম্প্রতি এই বন্যায় বর্ডার অঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছে। কেননা, ত্রাণসামগ্রী এবং উদ্ধার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল দেশের অভ্যন্তর থেকে। কিন্তু বন্যার পানি এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধকতার কারণে দ্রুত তাদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তথাপি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ফেনী ব্যাটালিয়নের (৪ বিজিবি) সময়োচিত পরিকল্পনায় অধীনস্থ বিওপি থেকে তৎক্ষণাৎ উদ্ধার কার্যক্রম এবং ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করে খুব দ্রুত সীমান্ত এলাকার জনসাধারণের পাশে দাঁড়িয়েছিল। বিজিবি হেলিকপ্টারের সহায়তায়ও সরাসরি সীমান্ত এলাকায় ত্রাণ সরবরাহ করেছিল। সশস্ত্রবাহিনী, বিজিবি এবং স্বেচ্ছাসেবকরা সকলেই বিভিন্ন স্থানে, প্রতিটা উপজেলায়, ইউনিয়নে চিকিৎসা ক্যাম্পেন  আয়োজন করে।
৫। ফেনী জেলার পাশাপাশি নোয়াখালী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ এবং মৌলভীবাজারসহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় বন্যা পরিস্থিতির ওই সময়ে অবনতি হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সূত্র থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে আগস্ট ২০২৪- এ বন্যায় ১১টি জেলা, ৭৭টি উপজেলাজুড়ে ৪.৫ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়াও ১৭৮৪৮টি  গবাদিপশুসহ ১৯৩৮৬৪ জন  ৩১৭০টি আশ্রয়কেন্দ্রে ছিল। বন্যার ফলে সম্পদ, ফসল এবং অবকাঠামোর উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে এবং হাজার হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য শহরাঞ্চলে প্রস্তুতি
৬। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে ভবিষ্যতেও এ ধরনের বন্যা পরিস্থিতির মোকাবিলা করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। সে কারণে আমাদের এখন থেকেই একটি গঠনমূলক বাস্তবধর্মী এবং যথাযোগ্য পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। যদিও এই বিষয়ে কাজ করার জন্য আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় রয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে শহরাঞ্চলসমূহ এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে। সেক্ষেত্রে আমরা যদি নিম্নলিখিত প্রস্তুতিসমূহ আগে থেকে গ্রহণ করতে পারি তাহলে মানুষের দুর্ভোগ অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে করি।
ক। আবহাওয়ার পূর্বাভাসÑ সর্বপ্রথমে আমাদের আবহাওয়া অফিসে একটি আধুনিক সতর্কতা এবং মনিটরিং সিস্টেম প্রচলন করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যখনই ভারি এবং অনবরত বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে, আবহাওয়া অফিস আগে থেকেই সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রশাসন এবং উদ্ধার কাজে নিয়োজিত সংস্থাসমূহের মাধ্যমে অঞ্চলের মানুষজনকে পূর্বাভাস জানিয়ে দেবে। বৃষ্টির প্রবাভাস ও পর্যবেক্ষণ বর্ডার এলাকার বাইরে থেকে শুরু করতে হবে।
খ। পূর্ব প্রস্তুতিÑ ফেনীসহ যে সমস্ত শহরাঞ্চল সচরাচর বন্যা পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় ঐ সমস্ত অঞ্চলে ইউনিয়ন/ওয়ার্ডভিত্তিক কিছু আশ্রয়ণকেন্দ্র তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা  রয়েছে। যেহেতু শহরাঞ্চলে জলযান বা নৌকার অভাব রয়েছে, সেক্ষেত্রে কিছু জলযান বা নৌকা ও লাইফ জ্যাকেট আগে থেকেই আশ্রয়ণ কেন্দ্রভিত্তিক রাখা প্রয়োজন। আবহাওয়ার পূর্বাভাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে সমস্ত আশ্রয়ণকেন্দ্রে প্রয়োজনীয় রসদ, মেডিক্যাল সাপোর্ট এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্থানীয় প্রশাসন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
গ। যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করাÑ সম্প্রতি বন্যায় আমরা দেখতে পেয়েছি, অন্তত ৯২% মোবাইল টাওয়ারের পাওয়ার সাপ্লাই বা জেনারেটরসমূহ বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। যার ফলে সমস্ত এলাকার মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই যোগাযোগহীনতার কারণে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদের নিকট আত্মীয়স্বজনকে খুঁজে না পাওয়ার হতাশা সৃষ্টি হয়। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য ভবিষ্যতে মোবাইল টাওয়ারের পাওয়ার ব্যাকআপ বা জেনারেটরসমূহ নির্দিষ্ট উচ্চতায় স্থাপনের প্রক্রিয়া এখন থেকেই চলমান করা উচিত, যেন মোবাইল নেটওয়ার্কসমূহ সব সময় কার্যকর থাকে। যার ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিতের পাশাপাশি উদ্ধার কার্যক্রম সহজভাবে করা সম্ভব হয়।
ঘ। খাল খনন/পুনরুদ্ধার বা নদীশাসনÑ যেহেতু বাংলাদেশ ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে নিচের/ভাটির দিকে অবস্থিত, সেহেতু আমাদের উজানের পানি সহজে নিষ্কাশন হতে পারেÑ এর একটি ব্যবস্থা রাখতে হবে। বিভিন্ন কারণে খাল দখল থেকে শুরু করে নদীতে পলি জমার কারণে পানির এই সহজ প্রবাহ ব্যাহত হওয়ায় দ্রুত পানি নদীর বা খালের পাড়ের ওপর দিয়ে সমতল ভূমি তথা জনপদে চলে আসে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে চিহ্নিত খাল এবং নদীশাসনসহ নদীর বাঁধগুলোকে আরও বেশি সুসংহত করা প্রয়োজন।
ঙ। সাময়িক জলাধার সৃষ্টি করাÑ    কখনো কখনো অতিবৃষ্টির কারণে খুব দ্রুত পানি উজান থেকে ভাটিতে আসার সম্ভাবনা থেকে যায়। সেক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে হঠাৎ করে প্রবহমান পানি নির্দিষ্ট জায়গায় ধরে রেখে রেগুলেটরের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে পানি যেন নির্দিষ্ট খাল বা নদী দিয়ে সহজে চলে যেতে পারে তার একটি ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে করা প্রয়োজন।
চ। সেচ্ছাসেবক বা উদ্ধার টিম প্রস্তুতি ও অনুশীলনÑসুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে ইউনিয়নভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক এবং প্রশিক্ষিত বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করে একটি সমন্বিত টিম গঠন করা।  দুর্যোগ মোকাবিলার অনুশীলন হিসেবে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার লক্ষ্যে কি কি করণীয় তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
ছ। ত্রাণ সংগ্রহ ও বিতরণÑ আমরা বাংলাদেশীরা প্রায়ই এ ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়ে থাকি। যে কোনো পরিস্থিতিতেই জনগণ এবং প্রশাসন দ্রুত দুর্গত মানুষের পাশে এগিয়ে আসে। এত বড় পরিসরে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিছুটা সমন্বয়হীনতা পরিলক্ষিত হতে পারে, যা ত্রাণ সংগ্রহ ও বিতরণের কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে অসুবিধা হয়। তাই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় প্রশাসন নীতিমালা তৈরির মাধ্যমে ত্রাণ সংগ্রহ থেকে বিতরণ পর্যন্ত সুষম নীতিমালা করা প্রয়োজন। এই কাজটি শুধু দুর্যোগ সময়েই নয়, শান্তিকালীন সময়েও মাঝে মাঝে অনুশীলন বা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বাড়াতে হবে।
জ। জরুরি চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করাÑ সম্প্রতি বন্যার অভিজ্ঞতা থেকে যেটা পরিলক্ষিত হয়, এ ধরনের পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায় বৃদ্ধ, শিশু এবং গর্ভবতী মহিলারা। যেহেতু বন্যার কারণে চিকিৎসাসেবা সম্পূর্ণরূপে ব্যাহত হয়, সেক্ষেত্রে এ ধরনের সংবেদনশীল রোগীদের যথাযোগ্য চিকিৎসা দেওয়াটা অনেক বেশি কষ্টসাধ্য হয়। সম্প্রতি হেলিকপ্টারের সহায়তায় অনেক গর্ভবতী মহিলাকে উদ্ধার করে তাদের সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা প্রদান করা হয়।  এমনও পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে যে, হাসপাতালে নেওয়ার পথে নৌকায়, হেলিকপ্টারেও বাচ্চা প্রসব করার মতো ঘটনা ঘটেছে। তাই এরকম পরিস্থিতিতে ভাসমান কিছু অ্যাম্বুলেন্স বা হাসপাতালের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। যেন দ্রুত সংবেদনশীল ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া যায়।
ঝ। বন্যাপরবর্তী কার্যক্রমÑ বন্যাপরবর্তী কার্যক্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বন্যার পরপরই মহামারি আকারে বিভিন্ন রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ে। এর জন্য দ্রুত চিকিৎসাসেবা এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনাসমূহ নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি নিরাপদ পানি সরবরাহ গুরুত্বপূর্ণ। এর পাশাপাশি যে সকল ফসলের ক্ষতি হয়েছে সেসব ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে বীজ, কীটনাশকসহ কৃষি সহায়তা কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে দ্রুত দুর্গত স্থানে সরবরাহের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
ঞ। নিরাপত্তাÑ যেকোনো দুর্যোগে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। স্বার্থান্বেষীরা দুষ্টতে সব সময় এর সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে। সেক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনীসহ স্বেচ্ছাসেবকদের সক্রিয় থাকতে হবে, যেন কোনো অবস্থাতেই নিরাপত্তার ঝুঁকি দেখা না দেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মানুষের জানমাল রক্ষা করার দায়িত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
ট। বন্যা  মোকাবিলা ও নিয়ন্ত্রণে গবেষণা সেল গঠন করা। বাংলাদেশ নদীমাতৃক এবং বন্যাপ্রবণ দেশ। আমাদের প্রতিনিয়তই বন্যার সঙ্গে যুদ্ধ করে এগিয়ে যেতে হয়। বন্যা মোকাবিলা এবং বন্যানিয়ন্ত্রণ সংশ্লিষ্ট গবেষণা অথবা সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মনে করি।
পরিশেষে বলতে চাই, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, খরা, অগ্নিকাণ্ড  ইত্যাদি অথবা মনুষ্যসৃষ্ট যে কোনো দুর্যোগ আমাদের জীবনে আসতে পারে। যদি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতি থাকে যত বড় দুর্যোগই আসুক না কেন, বাংলাদেশের মানুষ তাদের মেধা, দক্ষতা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে তা মোকাবিলা করতে সক্ষম। আমরা নদী এলাকার বাংলাদেশীরা বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় অভ্যস্ত। তবে শহরাঞ্চলের মানুষ সহজে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে না। কেননা, তারা সচরাচর বন্যা পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করে না। যেভাবে নদী অঞ্চলের মানুষ বন্যার সঙ্গে অভ্যস্থ থাকে। তাই যে সমস্ত শহর বিভিন্ন সময় বন্যা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে সেই সমস্ত শহরে আমরা একটি সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা গ্রহণ এবং প্রস্তুতি নিয়ে যদি সামনের দিকে এগিয়ে যাই, তাহলে যে কোনো ক্ষয়ক্ষতি/দুর্ভোগ কমিয়ে সফলতার সঙ্গে সামনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করি।
    
লেখক : অধিনায়ক, ফেনী ব্যাটালিয়নের (৪ বিজিবি)

×