২০২৪ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচিত হয়। জনগণের দুর্বার আন্দোলনের ফলে ক্ষমতাসীন সরকারকে পদত্যাগ করতে হয়, যা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে এক বিশাল অর্জন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এই গণঅভ্যুত্থানকে দেশব্যাপী উৎসাহ এবং আশার বাতিঘর হিসেবে দেখা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, যে চাঁদাবাজি এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষ রাস্তায় নেমেছিল তা এখনও দেশটিকে তার কালো ছায়ায় ঢেকে রেখেছে। চাঁদাবাজি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক জীবনে এক দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। স্বাধীনতার পর থেকেই এ সমস্যা বেড়ে চলেছে। বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, এবং স্থানীয় গুন্ডারা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে জোর করে টাকা আদায় করে আসছে। এই চাঁদাবাজির ফলে ব্যবসায়ী এবং সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রা ক্রমাগত দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। গণঅভ্যুত্থানের পর সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল যে, নতুন সরকার চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেবে এবং একটি স্বচ্ছ ও সুশাসিত বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। চাঁদাবাজির চক্র এখনও সক্রিয় রয়েছে এবং নানা অজুহাতে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে যাচ্ছে। এটি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক ক্ষতি করে না, বরং সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা ব্যাহত করে। চাঁদাবাজির মূল কারণগুলির মধ্যে একটি হলো দুর্বল আইন প্রয়োগ এবং বিচার বিভাগের অকার্যকরতা। দেশে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে আইন থাকলেও তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে দেখা যায় বিশাল ফাঁকফোকর। অনেক সময় চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলে ধরা হলেও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে অপরাধীদের রক্ষা করতে সক্ষম হয়। এছাড়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে কিছু অসাধু কর্মকর্তা চাঁদাবাজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করে যা এই সমস্যা আরও জটিল করে তুলেছে।
চাঁদাবাজির আরেকটি বড় কারণ হলো অর্থনৈতিক বৈষম্য। দেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। তারা জীবিকার তাগিদে প্রায়শই চাঁদাবাজদের শিকার হয়। অনেক সময় তারা বাধ্য হয়ে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ দিতে বাধ্য হয় যাতে তাদের ব্যবসা বা কাজ চালিয়ে যেতে পারে। এই অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে না পারলে চাঁদাবাজি রোধ করা প্রায় অসম্ভব। সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে চাঁদাবাজি প্রতিরোধ করা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক ইচ্ছা এবং সুশাসনের। নতুন সরকারকে অবশ্যই চাঁদাবাজি রোধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও জবাবদিহিমূলক ও সৎ হতে হবে। চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কড়া আইন প্রণয়ন এবং তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। জনগণেরও ভ‚মিকা রয়েছে চাঁদাবাজি প্রতিরোধে। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সাহসী হয়ে দাঁড়াতে হবে। গণমাধ্যমকে আরও সক্রিয় ভ‚মিকা পালন করতে হবে, যাতে চাঁদাবাজির ঘটনা জনসমক্ষে আসে এবং অপরাধীদের মুখোশ খুলে যায়। সব মিলিয়ে চাঁদাবাজি একটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা, যা এক দিনে সমাধান সম্ভব নয়। কিন্তু সঠিক পদক্ষেপ এবং জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। গণঅভ্যুত্থানের যে আশা এবং উদ্দীপনা জাতির মধ্যে জাগ্রত হয়েছিল, তা কাজে লাগিয়ে একটি স্বচ্ছ, সুশাসিত এবং চাঁদাবাজিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব। আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব এ কালো ছায়া থেকে দেশকে মুক্ত করা এবং একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হওয়া।
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়