বাংলাদেশের প্রতিবেশি দেশ মিয়ানমারের পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। সম্প্রতি জান্তা বাহিনীকে হটিয়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মি। রাখাইন রাজ্যের ৮০ শতাংশ নিজেদের দখলে রয়েছে বলে দাবি করছে সংগঠনটি। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকগন ধারণা করছে শীগ্রই একটি স্বাধীন সর্বভৌম আরাকান রাজ্য প্রতিষ্ঠার ঘোষণা নিয়ে আসতে পারে আরাকান আর্মি। রাখাইনে আরাকান আর্মির এই ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণ ও নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা বাংলাদেশের জন্য বহুমাত্রিক ভূ-রাজনৈতিক সংকট তৈরি করতে পারে। এই ধরনের ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের ভূমিকা কেমন হবে তা এখন বড় প্রশ্ন।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, বাংলাদেশের সঙ্গে রাখাইন রাজ্যের সম্পর্ক অনেক পুরোনো। ১৯৮৪ সালে বার্মিজ রাজাদের অধীনে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বর্তমান রাখাইন আরাকান নামে একটি স্বতন্ত্র রাজ্য ছিলো। বর্তমানে রাখাইনের জনসংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ যার প্রায় ৬০ শতাংশ বৌদ্ধ ধর্মাম্বলী ও ৩৫ শতাংশ রোহিঙ্গা মুসলিম। মিয়ানমারের স্বাধীনতার পর থেকেই রাখাইনে সংঘাতপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করছে। স্বাধীন আরাকান রাজ্য প্রতিষ্ঠার দাবী নিয়ে বহুদিন ধরেই আন্দোলন করছে স্থানীয় জনগণ। তারই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন আরাকান রাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে ২০০৯ সালের ১০ এপ্রিল রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড লীগ অফ আরাকানের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি যাত্রা শুরু করে। আরাকানের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের এই সংগঠনটি নিজেদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন নিয়ে বেশ কিছু বছর ধরে সরকার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। ২০২১ সালে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে জনগণ অভ্যুত্থান ঘোষণা করলে আরাকান আর্মি থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের অংশ হিসেবে জান্তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। মূলত মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যজুড়ে যুদ্ধ করছে আরাকান আর্মি। বাহিনীটিতে প্রায় ৩০ থেকে ৩৮ হাজার যোদ্ধা রয়েছে বলে দাবি করেছে সংগঠনটি। গত ৮ ডিসেম্বর মংডু দখলের মাধ্যমে স্বাধীন সর্বভৌম আরাকান প্রতিষ্ঠার পথে আরো একধাপ এগিয়ে গেছে আরাকান আর্মি। রাখাইন রাজ্যে তাদের এই নতুন দেশ প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশকে নতুন ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণে ফেলে দিয়েছে।
ঐতিহাসিকভাবে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক কখনোই সুখকর ছিলোনা। পাশাপাশি, বর্তমানে দু'দেশের মধ্যকার বাণজ্যিক সম্পর্ক অত্যন্ত সীমিত। এছাড়াও, স্পর্শকাতর রোহিঙ্গা ইস্যু, সমুদ্রসীমা বিরোধ, আকাশ সীমা লঙ্ঘন, বাংলাদেশের ভূখণ্ড নিজেদের বলে দাবি করা সহ আরো নানা ইস্যুতে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের অত্যন্ত শীতল সম্পর্ক বিরাজ করছে। এরই মাঝে বাংলাদেশের সীমান্তজুড়ে আরাকান আর্মির ক্ষমতা গ্রহন বাংলাদেশের জন্য বহুমুখী সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। যার মধ্যে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হতে পারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। প্রায় ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর ভারে নুয়ে আছে বাংলাদেশ। ইতোপূর্বে রাখাইনের রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে ২০১৭ সালেই মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছিল বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু নানা কারণে প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব হয়নি। বর্তমান উদ্ভুত পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রায় অনিশ্চিত। রাখাইন রাজ্যে একটি নতুন রাষ্ট্র গঠন হলে, এই সংকট আরো জটিল আকার ধারণ করবে। আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দিবে কিনা বা তাদের অবস্থান কি হবে, তা এখনো সুস্পষ্ট নয়। উল্লেখ্য যে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আরাকান আর্মির জাতিগত বিরোধ রয়েছে। ইতোপূর্বে মানবাধিকার সংগঠনগুলো আরাকান আর্মির উপর রোহিঙ্গা গনহত্যায় যুক্ত থাকা ও রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি লুটের অভিযোগ জানিয়েছে। এই অবস্থায় আরাকান আর্মি রাখাইনের ক্ষমতায় গেলে বর্তমানে রাখাইনে বসবাসরত ৩৫ শতাংশ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ কি হবে কিনা তা পরিষ্কার নয়। আরাকান আর্মি জান্তা বাহিনীর পথ অনুসরণ করে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন চালালে তা যে বাংলাদেশ সীমান্তে অতিরিক্ত রোহিঙ্গা শরনার্থীর চাপ সৃষ্টি করবে তা অনুমেয়। পাশাপাশি, এই পরিস্থিতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আরও কঠিন করে তুলবে।
রাখাইনে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ রোহিঙ্গা সংকটের পাশাপাশি বাংলাদেশের সীমান্ত নিরাপত্তা ও পার্বত্য অঞ্চলের নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের প্রায় ২৭০ কিলোমিটারের সীমান্ত রয়েছে। বিবিসির তথ্যমতে এই সীমান্তের পুরোটাই এখন আরাকান আর্মির দখলে, যা বাংলাদেশের সীমান্ত নিরাপত্তায় মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। বিশ্লেষকরা ধারনা করছেন বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত ব্যবহার করে অবৈধ মাদক, অস্ত্র চোরাচালান ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পূর্বের তুলনায় বহুগুন বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও, পার্বত্য অঞ্চলের সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে আরাকান আর্মির। রাখাইনে আরাকান আর্মি ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের।
রাখাইনে আরাকান আর্মি নতুন রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নিলে তা ভবিষ্যতে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করবে। স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্রের পক্ষে-বিপক্ষে আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলোর অবস্থান বাংলাদেশকে বৈশ্বিক কুটনৈতিক চাপে ফেলে দিবে। রাখাইন নিয়ে ইতোমধ্যে আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারত, চীন নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে মনযোগী হয়েছে। রাখাইনে ভারত ও চীনের কৌশলগত ভ‚-রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। ভারত ও চীনের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে এই অঞ্চলে। চীন রাখাইনকে ব্যবহার করছে বৈশ্বিক যোগাযোগের হাব হিসেবে। ভারত রাখাইনে বিনিয়োগ করেছে সেভেন সিস্টার্সের সাথে মূল ভুখন্ডের যোগাযোগের বিকল্প রুট হিসেবে। উভয় দেশই নিজ নিজ বিনিয়োগের স্বার্থে আরাকান আর্মির সঙ্গে পরোক্ষ যোগাযোগ গড়ে তুলেছে। এই অবস্থায় অনেক আন্তজার্তিক বিশ্লেষকগণ মনে করেন রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বিবেচনা করে বাংলাদেশের উচিত আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলা। এক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, বিদ্রোহীদের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ স্থাপন মিয়ানমার সরকারই বা কীভাবে দেখবে? এই বিষয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বতীকালীন সরকারকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে।
রাখাইনে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে নিজস্ব স্বার্থ বিবেচনায় বাংলাদেশকে কৌশলী হতে হবে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে অতিরিক্ত বিজিবি মোতায়েন ও আধুনিক নজরদারি ড্রোনের মাধ্যমে নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। নতুন করে যেন অবৈধ রোহিঙ্গা শরনার্থী প্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়ে নিরাপত্তা বাহিনীকে সচেষ্ট হতে হবে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ের জন্য বাংলাদেশকে আরো সোচ্চার হতে হবে। এক্ষেত্রে ভারত চীনের উপর নির্ভরতা কমিয়ে জাতিসংঘ, আসিয়ানের মত আন্তর্জাতিক সংস্থা গুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে সংকট সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে একমুখী না হয়ে মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মি উভয়ের সঙ্গে কৌশলগত আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে।
সীমান্ত নিরাপত্তা ও রোহিঙ্গা ইস্যুর পাশাপাশি অভ্যন্তরীন স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। রাখাইন সংকটের প্রভাব যেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোনো ধরনের উগ্রবাদ বা সন্ত্রাসী তৎপরতা সৃষ্টি করতে না পারে সেই বিষয়ে যথাযথ নজরদারি প্রয়োজন।
রাখাইনে নতুন রাষ্ট্র গঠনের গুঞ্জন উড়িয়ে দেয়া যায় না। আরাকান আর্মি নতুন রাষ্ট্রের ঘোষণা দিলে তা দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশকে অবশ্যই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকতে হবে। সীমান্ত নিরাপত্তা, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এবং আন্তজার্তিক ও আঞ্চলিক কুটনৈতিক সমীকরণ বাংলাদেশের জন্য যে জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে তা যথাযথ পরিকল্পনা, কৌশলী কুটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে মোকাবেলা করা সম্ভব। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অধীনে পরিচালিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত রাখাইনে উদ্ভুত পরিস্থিতিকে একটি ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহন করে দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করা। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে অবস্থানরত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরনার্থীদের প্রত্যাবাসন ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য মিয়ানমারের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়