ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৬ পৌষ ১৪৩১

ইয়েমেন সংকট ॥ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তির দায়

ড. মো. মোরশেদুল আলম

প্রকাশিত: ১৯:৫৩, ২০ ডিসেম্বর ২০২৪

ইয়েমেন সংকট ॥ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তির দায়

আট বছর ধরে চলা ইয়েমেন-সৌদি জোট যুদ্ধ অবশেষে বন্ধ হয়েছে। এ নিয়ে ওমানের মধ্যস্থতায় হুতি বিদ্রোহী ও সৌদি আরব কাজ করেছে। ইয়েমেনের সীমান্তবর্তী দেশ ওমান বহু বছর ধরে যুদ্ধরত পক্ষগুলোর মধ্যে দূরত্ব কমানোর চেষ্টা করে আসছিল। এদিকে চীনের মধ্যস্থতায় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরব ও ইরান একটি চুক্তিতে সম্পর্ক পুনর্প্রতিষ্ঠা করতে সম্মত হওয়ার পর শান্তি উদ্যোগগুলো গতি পেয়েছে। আরব বিশে^র সবচেয়ে দরিদ্র দেশ ইয়েমেন। এটি আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত। ইয়েমেনের পশ্চিমে লোহিত সাগর এবং দক্ষিণে এডেন উপসাগর। এটি আফ্রিকা মহাদেশ থেকে বাব এল মান্দ প্রণালির মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন। দেশটির উত্তর ও উত্তর-পূর্বে সৌদি আরব এবং পূর্বে ওমান অবস্থিত। ২০১৪ সাল থেকে ইয়েমেনে যুদ্ধ চলছে। শিয়া মতাদর্শী হুতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে জাতিসংঘ ও পশ্চিমা সমর্থিত সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোট যুদ্ধ করছে। ২০১১-১২ সাল থেকেই মূলত ইয়েমেনি সংকট শুরু হয়। দুই দশক ধরে প্রেসিডেন্ট হিসেবে থাকা আলী আবদুল্লাহ সালেহকে অপসারণের জন্যই মূলত আন্দোলনটি শুরু হয়। সালেহ ক্ষমতা ত্যাগ করলে তার সাবেক উপরাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান মানসুর হাদি সরকার গঠন করেছিলেন। ইয়েমেন ১৯৯০ সালের পূর্বে দক্ষিণ ও উত্তর ইয়েমেনে বিভক্ত ছিল। উত্তর হলো শিয়া অধ্যুষিত এবং দক্ষিণ হলো সুন্নি অধ্যুষিত। ১৯৯০ সালে দুই ইয়েমেন একত্রিত হলেও গভীর বিভাজন চলমান ছিল। দেশটির মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ সুন্নি এবং ৪৩ শতাংশ শিয়া মতাদর্শী। নতুন প্রেসিডেন্ট মানসুর হাদি আরব উপদ্বীপের আল কায়দা এবং হুতি বিদ্রোহী উভয়পক্ষের হুমকিকে মোকাবিলা করতে চেয়েছিলেন। বিদ্রোহীদের পাশাপাশি মানসুর হাদিকে দরিদ্র ও খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধেও লড়তে হয়েছিল। দেশটির উত্তরাঞ্চলে একচেটিয়া সমর্থন থাকায় হুতিরা কয়েক বছর ধরেই বিদ্রোহ চালিয়ে যাচ্ছিল।
হুতিদের আনুষ্ঠানিক নাম আনসারুল্লাহ হলেও স্থানীয়ভাবে তাদের হুতি বলে ডাকা হয়। ২০০০ সালের গোড়ার দিকে ইয়েমেনে সংগঠনটি গড়ে উঠে। ২০১৪ সালে হুতিরা ইরানের সহায়তায় রাজধানী সানা এবং আশপাশের এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়। ২০১৫ সালের ২৬ মার্চ থেকে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট হামলা চালালে যুদ্ধ চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে। দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দর এডেন থেকে এপ্রিল মাসে প্রেসিডেন্ট হাদি পালিয়ে যান। হুতি আর নিরাপত্তা বাহিনীগুলো ছিল আগের প্রেসিডেন্ট সালেহের প্রতি অনুগত। এরপর তারা সমগ্র দেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। মূলত ইরান তাদের সমর্থন দিয়েছিল। সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন আরব সামরিক জোটই মূলত হুতিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়েছে। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে ইয়েমেনে জাতিসংঘ সমর্থিত ও আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃত সরকারের পুনর্প্রতিষ্ঠা করা। সংযুক্ত আরব আমিরাতও সৌদি আরব জোটের অন্যতম শরিক দেশ। হাদিকে ইয়েমেনে পুনরায় ক্ষমতায় বসাতে সৌদি আরব অন্য ৮টি সুন্নি দেশের সঙ্গে একজোট হয়ে ইয়েমেনে অভিযান আরম্ভ করে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ পশ্চিমা শক্তি সৌদি জোটকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করে। চার মাসের লড়াইয়ের পর সরকারপন্থি বাহিনী এবং দক্ষিণাঞ্চলের সুন্নি গোত্রগুলো বিদ্রোহীদের এডেনে আসা ঠেকিয়ে দেয়। তারা ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে হুতিদের এডেন থেকে তাড়িয়ে দেয়। প্রেসিডেন্ট হাদি নির্বাসনে থাকলেও তার সরকার অস্থায়ীভাবে এডেনে কার্যক্রম শুরু করে। বছরের পর বছর ধরে চলা এই লড়াইয়ের ফলে উভয় পক্ষই পর্যুদস্ত। একটি যুদ্ধবিরতির জন্য জাতিসংঘের প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছিল। তবে হুতিরা নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছে সানা এবং টিয়াজে। সেখান থেকেই তারা সৌদি আরবে মর্টার আর মিসাইল ছুড়েছে। দুপক্ষের এই বিরোধের সুযোগ নিয়েছিল আল কায়দা ইন দি আরব পেনিনসুলা এবং ইসলামিক স্টেট গ্রুপ। দক্ষিণে তারা বেশ কিছু অঞ্চল দখলও করে নিয়েছিল। ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে ইয়েমেনে মিসাইল পড়ার পর সৌদি আরব দেশটির চারদিকে অবরোধ জোরালো করে। ইয়েমেনে হুতিদের বিরুদ্ধে হামলার জেরে ২০২১ সালে সৌদি আরবের নিকট অস্ত্র বিক্রি কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এর তিন বছর পর এবার সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
জাতিসংঘ ২০২২ সালের ২ এপ্রিল ইয়েমেনে যুদ্ধরত পক্ষগুলোর মধ্যে একটি দুই মাসের যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতা করে। যার মধ্যে হুতি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় জ¦ালানি আমদানির অনুমতি এবং সানা বিমানবন্দর থেকে জর্ডান এবং মিসরে পরিচালিত কিছু ফ্লাইট অন্তর্ভুক্ত ছিল। যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষর হওয়ার ঘোষণাটি দিয়েছিলেন জাতিসংঘের বিশেষ দূত হ্যানস গ্রান্ডবার্গ। তিনি বলেছিলেন, যুদ্ধরত পক্ষগুলো ইয়েমেনের অভ্যন্তর এবং সীমান্ত স্থল, আকাশ ও সমুদ্রে সবধরনের সামরিক হামলা বন্ধ রাখার বিষয়টি মেনে নিয়েছে। কিন্তু জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় প্রতিষ্ঠিত যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে সৌদি নেতৃত্বাধীন আরব জোট ইয়েমেনের ওপর আবারও হামলা চালিয়েছিল। জাতিসংঘের এক হিসাব অনুযায়ী, ইয়েমেন যুদ্ধে ৪ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এর মধ্যে যুদ্ধের কারণে ঘটা খাদ্যাভাব ও রোগের কারণে মারা গেছে ৬০ শতাংশ মানুষ। ইউএনডিপির ২০২২ সালের নভেম্বর মাসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ইয়েমেন যুদ্ধ ও যুদ্ধসংশ্লিষ্ট কারণে নিহত ব্যক্তিদের ৭০ শতাংশই ৫ বছরের কম বয়সী শিশু। ২০২০ সালের এক হিসাব অনুযায়ী, তিন কোটি জনবসতির ইয়েমেন বর্তমানে ৫০ হাজার মানুষ দুর্ভিক্ষের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করছে। ৫০ লাখ মানুষ এই দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে বলে বিশ^ খাদ্য সংস্থা সতর্ক করেছে। দেশটির মোট ৪৫ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তায় ভুগছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সাল পর্যন্ত ইয়েমেনে ৪০ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ইয়েমেনের এই সংকটকে সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তার এবং ক্ষমতার লড়াই হিসেবে দেখছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
কৌশলগতভাবে ইয়েমেনের নিয়ন্ত্রণ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দেশটি বাব এল মানদেবের ওপর; যা রেড সি এবং গালফ অব এডেনের সংযোগস্থল। বিশে^র সবচেয়ে বেশি তেলের সরবরাহ এখান থেকেই হয়ে থাকে। ইরান সমর্থিত হুতিরা লোহিত সাগরের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য রুট দিয়ে যাতায়াতকারী ইসরাইল ও পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে যুক্ত জাহাজগুলোতে হামলা অব্যাহত রেখেছে। গাজায় ইসরাইলের আগ্রাসন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত তারা হামলা চালিয়ে যাবে বলে ঘোষণা করেছে। ভূ-রাজনৈতিক, ভূ-অর্থনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত কারণে লোহিত সাগর সংলগ্ন অঞ্চল আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এডেন উপসাগর হয়ে বাবএলমান্দেব প্রণালী পেরিয়ে লোহিত সাগর, এরপর সুয়েজ খাল ব্যবহার করে ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইউরোপ ও আমেরিকার সঙ্গে এশিয়ার বেশিরভাগ আমদানি ও রপ্তানি পরিচালিত হয়। হুতিরা রাজধানী সানাসহ ইয়েমেনের বিশাল অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। তাই বিশে^র সবচেয়ে ব্যস্ত শিপিং লেনগুলোর অন্যতম লোহিত সাগরে হামলা চালানো তাদের জন্য অনেকটা সহজ। লোহিত সাগর থেকে মিসরের সুয়েজ খাল হয়ে যেসব জাহাজ ইউরোপ যেত সেগুলোকে আফ্রিকা ঘুরে যেতে হয়। এর ফলে গ্লোবাল সাপ্লাই চেনগুলোর জন্য মারাত্মক ক্ষতি ও ক্রমবর্ধমান হুমকিস্বরূপ। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, বিশ^ব্যাপী সমুদ্রবাহিত বাণিজ্যের ১৫ শতাংশ পরিবহন হয় লোহিত সাগর দিয়ে। এর মধ্যে সমগ্র বিশে^র শস্যের ৮ শতাংশ, সমুদ্রজাত তেলের ১২ শতাংশ এবং বিশে^র তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের ৮ শতাংশ। পশ্চিমা বিশে^র সঙ্গে এশিয়ার প্রায় ৪০ শতাংশ বাণিজ্যই এই লোহিত সাগর দিয়ে হয়ে থাকে। নেদারল্যান্ডস, ইতালি, ফ্রান্সের মতো খনিজ তেল ও এলএনজি নির্ভর দেশগুলো তাদের জ¦ালানি আমদানির জন্য এই পথটি ব্যবহার করে। এনার্জি ইন্টেলিজেন্স গবেষণা গ্রুপের তথ্যমতে, হুতি আক্রমণের ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলারের বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং এর পরিমাণ ক্রমান্বয়ে আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। পেন্টাগন জানিয়েছে, তাদের এসব হামলার জবাব দিতেই পাল্টা অভিযান চালানো হচ্ছে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে বাণিজ্যিক ও নৌ জাহাজে ৪৫টির বেশি হামলা চালিয়েছে হুতিরা। যা বিশ^ অর্থনীতির পাশাপাশি আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। অস্ট্রেলিয়া, বাহরাইন, কানাডা, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস এবং নিউজিল্যান্ডের সমর্থনে হামলা চালানো হয় বলে জানানো হয়েছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি হামলার বিরুদ্ধে লোহিত সাগরে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা মিত্রদের একাধিক বাণিজ্যিক ও নৌজাহাজে হুতি বিদ্রোহীরা আক্রমণ করে আসছে। হুতি ইরানের ইসলামী বিপ্লবী গার্ড কর্পস এবং লেবাননের হিজবুল্লাহর ঘনিষ্ঠ মিত্র। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে হুতিকে সশস্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র তালিভুক্ত করে। এর ফলে লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এর আগে কানাডা লোহিত সাগরে হামলার প্রতিক্রিয়ায় ২০২৪ সালের শুরুতে হুতির বিরুদ্ধে ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের হামলাকে সমর্থন করে। ১০ নভেম্বরের আল জাজিরার প্রতিবেদন মতে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ইয়েমেনে বিমান হামলা চালিয়েছে। পেন্টাগন ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছে, লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরজুড়ে আন্তর্জাতিক জলসীমায় চলাচলকারী সামরিক ও বেসামরিক জাহাজগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করতে হুতির ব্যবহৃত বিভিন্ন অস্ত্র রয়েছে এমন বেশ কয়েকটি স্থাপনা লক্ষ্য করে তারা হামলা চালিয়েছে। আল জাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক বছরে হুতিরা লোহিত সাগরে শতাধিক হামলা চালিয়েছে।  ইয়েমেন থেকে ইসরাইলের উদ্দেশে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে হুতি যোদ্ধারা। এই অভিযানে ইয়েমেনি সৈন্যরা প্যালেস্টাইন-টু নামের একটি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে। যদিও ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) বলছে, ইসরাইলের সীমানার বাইরে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে সফলভাবে বাধা প্রদান করেছে। হুতি যোদ্ধারা ২০২৩ সালে গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানিয়ে ধারাবাহিকভাবে ইসরাইলে ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন নিক্ষেপের মাধ্যমে হামলা চালিয়ে আসছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ডেস্ট্রয়ার এবং মার্কিন নৌবাহিনীর ৩টি সরবরাহ জাহাজের ওপর ১৬টি শক্তিশালী ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এবং একটি ড্রোন দিয়ে হামলা চালিয়েছে বলে ইয়েমেনি সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইয়াহিয়া সারি জানিয়েছেন। ফিলিস্তেনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইহুদিবাদী ইসরাইল যে আগ্রাসন ও গণহত্যা চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে এই হামলা চালানো হয়েছে বলে তিনি জানান। পাশাপাশি ইয়েমেনের ওপর সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর আগ্রাসনেরও জবাব দেওয়া হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। ৩ ডিসেম্বর আল জাজিরা এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, কানাডা ইয়েমেনের ইরানপন্থি সশস্ত্রগোষ্ঠী হুতিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে যুক্ত করেছে। কানাডার এমন সিদ্ধান্তের কারণ হলো আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে অস্থিতিশীল করে এমন গোষ্ঠীর প্রভাবকে রোধ করা। হুতিদের লোহিত সাগরে এই সামরিক আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে। ইসরাইলের আগ্রাসন বন্ধ করা এবং যুক্তরাষ্ট্রকে তার আঞ্চলিক স্বার্থের বিবেচনায় ইসরাইলকে যাবতীয় সহযোগিতা প্রদান থেকে বিরত রাখা।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের রিয়েলিজম তত্ত্ব অনুযায়ী হুতিদের এই আক্রমণকে যদি আমরা দেখি, ইয়েমেনের ডি-ফ্যাক্টো বা প্রকৃত রাষ্ট্রীয় সত্তায় রূপ পরিগ্রহ করেছে। হুতিরা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থকে ইয়েমেনের জাতীয় স্বার্থ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। তাই মধ্যপ্রাচ্যের যে নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতি সেখানে নিজেদের বা ইয়েমেনের রাজনৈতিক স্বার্থ বা নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করতে সামরিক শক্তি প্রদর্শন করছে। আবার নিও-রিয়েলিজম বা কাঠামোগত রিয়েলিজমের ভাষায় লোহিত সাগরে হুতিদের সামরিক শক্তি প্রদর্শনকে আন্তর্জাতিক নৈরাজ্যপূর্ণ ব্যবস্থার প্রভাব হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। হুতিরা যে ইয়েমেনকে প্রতিনিধিত্ব করছে বলে দাবি করে সেটিও এই সিস্টেমের অংশ। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় শক্তিসাম্যের অংশ হতে ইরানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক করে। কারণ এই শক্তির ভারসাম্যই সিস্টেমের প্রতিটি দেশকে তাদের কাক্সিক্ষত রাজনৈতিক স্বার্থ অর্জনে সহযোগিতা করতে পারে। এদিকে লেবানন ও হিজবুল্লাহর সঙ্গে ২৭ নভেম্বর ইসরাইল যুদ্ধবিরতি চুক্তি করেছিল। ঠিক একই দিনে সিরিয়ার ইদলিব থেকে বাশার আল-আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)। মধ্যপ্রাচ্যের সর্বশেষ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের ৫৩ বছরের শাসনের অবসান হয়েছে। বিদ্রোহীদের মাত্র ১২ দিনের বিদ্যুৎগতির অগ্রাভিযানের মুখে বাশারের সামরিক বাহিনীর অবিশ^াস্য পরাজয় পশ্চিমা বিশ^সহ আন্তর্জাতিক সব মহলকে বিস্মিত করেছে। সিরিয়ায় বাশার আল- আসাদ সরকারের পতন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইয়েমেনকেও প্রভাবিত করবে এটাই স্বাভাবিক। লোহিত সাগরে হুতিদের সামরিক আক্রমণে সৌদি আরব কিন্তু কোনো পক্ষ অবলম্বন করেনি। যদিও গৃহযুদ্ধকালীন পশ্চিমা ও গালফভুক্ত সৌদি মিত্রদের সাহায্যে সৌদি আরব হুতিদের পরাজিত করার চেষ্টা করেছিল। যদিও বর্তমানে হুতিদের আক্রমণের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। কারণ ইসরাইলের ফিলিস্তিন আক্রমণের প্রেক্ষাপটে তারা আক্রমণ চালাচ্ছে। তাই সৌদি আরব তার ২০৩০ আঞ্চলিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে, জ¦ালানি সরবরাহ নিরাপদ রাখতে হুতিদের সঙ্গে শান্তি চুক্তিটি সফলভাবে বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে। ইয়েমেনের বৃহৎ অংশ নিয়ন্ত্রণকারী হুতিদের বিরুদ্ধে অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণের জন্য সহিংসতা এবং অন্য উপায় ব্যবহার করার অভিযোগ আনা হয়েছে; যা এই অঞ্চলে সংঘাত বৃদ্ধির পেছনে দায়ী।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×