বিশ্বায়নের সমসাময়িক পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রই গণতন্ত্রকে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত এবং প্রণিধানযোগ্য অনুষঙ্গ হিসেবে অধিকতর গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে আসছে। ধারাবাহিকতায় অধুনা উন্নয়নশীল দেশসমূহেও গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রায় প্রতিটি দল ও সরকারের আদর্শ-উদ্দেশ্য হিসেবে বিবেচ্য। ব্যক্তি মানুষের স্বাধীনতা এবং সৃজনশীলতার প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ প্রতিটি রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রের মৌলিক বিষয় হওয়া সত্ত্বেও এর প্রতিফলন কতটুকু বাস্তবসম্মত তা বিচার-বিশ্লেষণের দাবি রাখে। একবিংশ শতাব্দীর সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহের পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক শিখরের দ্যোতক বা আইনের শাসন এবং ক্ষমতার ভারসাম্যের চিন্তা-চেতনা ও ধারণার সমন্বিত প্রয়াস অনেকাংশে সংকুচিত।
স্বৈরতন্ত্রের নীতিমালা ধারণে বিগত সরকারের সময়কালে গণমানুষের ইচ্ছাশক্তি, ঋজুতা ও সৃষ্টিশীলতার প্রায়োগিক ক্ষেত্রে দীর্ঘকাল মানবতাবাদের চর্চা ছিল নিরন্তর বিপন্ন ও বিপর্যস্ত। সুশাসনের প্রধান নিয়ামকÑ সততা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সমৃদ্ধ বিবর্ধন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে সত্যনিষ্ঠতায় প্রচ্ছাদিত করবেÑ এতে কারও দ্বিমত করার অবকাশ নেই। কিন্তু বিগত পতিত সরকারের শেষ দশকে সুশাসনের পরিবর্তে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দুঃশাসনই ছিল অধিক মাত্রায় প্রোজ্জ্বল। এটি সুপ্রতিষ্ঠিত যে, মানুষ আত্মসম্মান, আত্মমর্যাদা ও আত্মবিশ্বাসের বিবর্ত অবস্থানকে সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নাগরিক স্বাধীনতা ও অধিকার ভোগ করার প্রায়োগিক শিক্ষার আরোপিত উপমা হচ্ছে ‘গণতন্ত্র’। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক মনীষী এরিস্টটল বিমোক্ষণ দৃষ্টিভঙ্গি ও বস্তুবাদী দর্শনের ঐতিহ্যিক জিজীবিষা জীবনের প্রয়োজনে নয়, বরং উত্তম জীবনপ্রবাহের উৎকর্ষতার প্রয়োজনে রাষ্ট্রের উৎপত্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এজন্যই রাষ্ট্র মানব বিকাশ ও পরিপূর্ণতার জন্য একটি অনিবার্য প্রতিষ্ঠান।
মানুষ, পরিবার ও সমাজের সর্বাঙ্গীন স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও মঙ্গল প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার সার্থকতা সর্বজনবিদিত। ব্যক্তি, শ্রেণি বা দলীয় স্বার্থরক্ষার যে ধারণা তথা স্বৈরতন্ত্র, অভিজাততন্ত্রের বিপরীতে মানুষ প্রতিষ্ঠা করেছে জনন্যায়তন্ত্র বা গণতন্ত্র। এখানেই সুসংহত আইনের শাসন, পরিচর্যা ও অনুশীলন অবধৌতিক মহিমায় রাষ্ট্র শাসনকে গৌরবদীপ্ত করে। স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রীর বিশ্বজনীন ধারণা ও চেতনায় ঊর্জস্বী ইউরোপের রেনেসাঁ বা ফরাসি বিপ্লব গণতন্ত্রের যে অবিনাশী শক্তির সোপান নির্মাণ করেছে তারই ভিত্তিতে রাষ্ট্র জনগণের চরিত্র, আশা-আকাক্সক্ষা, আর্থ-সামাজিক পরিবেশ, পারিপার্শ্বিক ও ভৌগোলিক অবস্থানের বিষয়সমূহ বিবেচনায় এনে মুক্ত সমাজ গঠনের প্রক্রিয়াকে সুস্পষ্ট করেছে। এটিই গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ইতিহাসের অনবদ্য বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য।
অতিসম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে অর্থ পাচার-দুর্নীতি-লুটপাটের যে চিত্র উন্মোচিত হয়েছে তাতে দেশের আপামর জনগণ হতভম্ব। জুলাই ২৪ ক্ষমতাচ্যুত সরকার রাষ্ট্রক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে দুর্নীতির অবিশ্বাস্য স্বরূপ উন্মোচন করে। নষ্ট রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি, ক্ষমতা ও আর্থিক দুর্বৃত্তায়ন এবং সুশাসন পরিচর্যায় দুর্ভেদ্য প্রতিবন্ধকতা জাতি-রাষ্ট্রের নৈর্ব্যক্তিক উন্নয়ন সমৃদ্ধিকে প্রচণ্ড চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল। ইতোমধ্যে চলমান অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ চমকপ্রদভাবে উঁচুমার্গে প্রশংসিত ও সমাদৃত। বাংলাদেশের সমগ্র নাগরিক বস্তু-সত্যনিষ্ঠ প্রক্রিয়ায় এসব দুর্বৃত্তায়ন রোধে প্রযুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ বা আদালত, দুদকসহ অন্য সকল সংস্থাকে যথাযথ কার্যকর অবস্থানে দেখতে চায়। এটি প্রত্যাশিত যে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান যেন নিপীড়ন-নির্যাতন-হয়রানি-চরিত্র হনন বা অনৈতিক প্রভাব-প্ররোচনা বা অর্থলিপ্সায় নিরীহ-নির্দোষ-মার্জিত-অসহায় ব্যক্তিদের ফাঁসিয়ে দিয়ে মিডিয়া ট্রায়ালের উদ্দেশ্যেই যেন পরিচালিত না হয়।
যথার্থ অর্থেই অভিযোগের সত্যতা নির্ধারণে প্রশিক্ষিত ও পারদর্শী কর্মকর্তাদের যোগ্যতাই মুখ্য। অকাট্য প্রমাণ নির্ধারণে সততার মানদণ্ডে চৌকস তদন্তকারীদের বিশ্বাসযোগ্যতাই প্রাধান্য পাবে। প্রহসন বা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে অথবা আদালতে পরাভূত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা পরিহার করেই যথাযথ প্রক্রিয়ায় আদালতে মামলা বা অভিযোগপত্র প্রদান একান্ত বাঞ্ছনীয়। নির্ধার্য পরাকাষ্ঠা আদালত বা দুদক কর্তৃক দৃষ্টান্ত স্থাপনে ব্যর্থ হলে দুর্বৃত্তায়নই জয়ী হবে। আইনের প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধাশীল জনগোষ্ঠী আদালতের নীতি-নৈতিকতায় পরিশুদ্ধ বিচার কার্যক্রমে এখনো পরিপুষ্ট।
এটি প্রমাণিত যে, বিগত পতিত সরকারের আমলে প্রভাবিত আদালত বা অন্যান্য সংস্থা কোনোভাবেই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারেনি। জাতিকে যার জন্য কালপরিক্রমায় কঠিন মূল্য দিতে হচ্ছে। স্মরণযোগ্য যে, বিশ্বব্যাপী আলোড়িত যুক্তরাষ্ট্রের একটি ঘটনা সঠিক বিচারহীনতার নির্মম অধ্যায় রচনা করেছে। ১৯৮৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য মেরিল্যান্ডের বাল্টিমোর শহরে একটি মাধ্যমিক স্কুলের চৌদ্দ বছরের এক শিক্ষার্থীকে গুলিবিদ্ধ করে হত্যার অভিযোগে তিনজন কিশোরকে ছত্রিশ বছর কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। ছত্রিশ বছর অমানবিক কারাভোগকারীরা বর্তমানে পঞ্চাশের অধিক বয়স অতিক্রম করেছে। দীর্ঘ ছত্রিশ বছর অতিক্রান্তে আদালত সম্পূর্ণ নির্দোষ সাব্যস্ত করে তাদের মুক্ত জীবন ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো ভুল তদন্ত ও প্রহসিত সিদ্ধান্ত এই কিশোরদের প্রতি নৃশংসতা এবং তাদের পুরো জীবন-যৌবন ধ্বংস করে প্রৌঢ়তাদানের দায়ভার কে বহন করবে?
বাংলাদেশেও কারণে-অকারণে বহু নিরীহ-নির্দোষ মানুষকে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধপ্রবণতায় উন্মাদ নষ্ট ব্যক্তিদের জিঘাংসার শিকারে অপরিসীম যন্ত্রণাকাতর কারাবরণ বা আত্মনিগ্রহে প্ররোচিত হওয়ার দৃষ্টান্তও প্রচুর। আদালত, দুদক বা অন্যান্য বিচারিক কার্যক্রম যাতে কোনোভাবেই উল্লেখ্য ঘটনার নৈত্যিক উদাহরণ না হয় সেদিকে রাষ্ট্রের মনোযোগ আকর্ষিত হওয়া আবশ্যক। রবিঠাকুরের ‘প্রশ্ন’ কবিতার পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করে সমস্বরে যেন আমাদের উচ্চারণ করতে না হয়Ñ ‘ভগবান, তুমি যুগে-যুগে দূত পাঠায়েছ বারে-বারে দয়াহীন সংসারে,/ তারা বলে গেল ‘ক্ষমা করো সবে’, ব’লে গেল ‘ভালোবাসো-অন্তর হ’তে বিদ্বেষ-বিষ নাশো।’/ বরণীয় তারা, স্মরণীয় তারা, তবুও বাহির-দ্বারে/ আজি দুর্দিনে ফিরানু তাদের ব্যর্থ নমস্কারে।/ আমি-যে দেখেছি গোপন হিংসা কপট রাত্রিছায়ে/ হেনেছে নিঃসহায়ে,/ আমি-যে দেখেছি প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।’ প্রচলিত ধারণা এই যে, শুধু লঘু ভুলের জন্য নিরীহ-অসহায় ব্যক্তিরাই শাস্তিপ্রাপ্ত হয়, কথিত প্রভাবশালী বড় মাপের অপরাধীরা কেন জানি বরাবরই অধরায় থেকে যায়।
প্রাসঙ্গিকতায় নবনিযুক্ত মাননীয় প্রধান বিচারপতি সম্প্রতি সর্বস্তরের বিচারকদের উদ্দেশে অসাধারণ বক্তব্য প্রদান করেছেন। প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত অভিবাসনে আদালতের কার্যক্রম সুসম্পন্ন করার লক্ষ্যে তিনি কিছু যৌক্তিক পরামর্শ উপস্থাপন করেছেন। আধুনিক যুগোপযোগী আদালত পরিক্রমায় সুবিচার নিশ্চিতকল্পে সুপারিশগুলো অতি তাৎপর্যপূর্ণ। পতিত কর্তৃত্ববাদী সরকারের মতো বা কোনো মহলের আদেশ-প্ররোচনায় রায় প্রদান বাধামুক্ত করার জন্য তাঁর বক্তব্য সুধীমহলের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। জাতির দীর্ঘ আকাক্সক্ষা পূরণে স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় প্রধান বিচারপতির ইতিবাচক ভূমিকা প্রত্যাশিত। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রথম ধাপ হিসেবে পৃথক সচিবালয় করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। তা ছাড়া সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রেও তিনি সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছেন। বিচার বিভাগে দুর্নীতির মূলোৎপাটনে তিনি জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। তিনি জানান জেলা জজ ও বিচারকদের দুর্নীতি দমনে ব্যর্থতা তাদের পেশাগত অযোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হবে। বিচার কাজে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে বিচারের গতি ও মানকে ত্বরান্বিত করতে দ্রুত ই-জুডিসিয়ারি প্রকল্প বাস্তবায়নে তিনি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর জোর দেন।
বিভীষণ বা ‘ভূতের মুখে রাম নাম’, অবৈধ পেশি ও অর্থশক্তি, বর্ণচোরা, তোষামোদকারী অথবা এতকাল বিভ্রষ্ট রাজনীতিকদের বেপরোয়া দাপট এবং ক্ষমতার বলয় সৃষ্টিকারীদের রুখে দেওয়ার জন্য সরকার বা দেশবাসীকে একতাবদ্ধ হতে হবে। একা সরকারের পক্ষে সকল ইতিবাচক উদ্যোগের সফল বাস্তবায়ন সম্ভব নয় যদি না জাতি-রাষ্ট্রের সকল জনগোষ্ঠীর সমন্বিত শক্তি জোরালো ভূমিকা পালন করে। আমাদের সকলের মনে রাখা উচিত ব্যক্তির চেয়ে দেশ এবং দেশের পবিত্র সংবিধানসম্মত আইনের শাসনের সুরক্ষাই হচ্ছে যে কোনো সরকার-আদালতের প্রধান দায়িত্ব। যে কোনো ধরনের আপোসকামিতা-অনৈতিক সমঝোতা কোনোভাবেই সুশাসনকে মর্যাদাসীন করে না।
‘আইন তার নিজস্ব গতিতেই চলে’ এই আরাধ্য বিধিবিধানকে পক্ষপাতদুষ্ট বা কূটকৌশলে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা মোটেও সমীচীন নয়। সরকারি-বেসরকারি-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহের স্ব-স্ব আইনি কাঠামো পর্যাপ্ত যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে অভিযোগ অনুসন্ধান কার্যকর করা একান্তই কাম্য। যে কোনো ধরনের হয়রানি-প্রতারণামূলক বা ফাঁসিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে মিথ্যা-বানোয়াট অভিযোগের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন বাঞ্ছনীয়। অভিযোগকারীকে সর্বপ্রথম নানামুখী প্রশ্নবাণে অভিযোগের উদ্দেশ্য নির্ধারণ করতে হবে এবং অঙ্গীকারনামা নিতে হবে যে, অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ হলে অভিযোগকারী যে কোনো আইনানুগ শাস্তির আওতায় আসবে। অন্যথায় দমন-পীড়ন-নির্যাতন-গুম-খুনের মতো অপরাধীদের উত্থাপিত অভিযোগ আমলে নিয়ে দুদকের অনুসন্ধান নির্দোষ ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করতে পারে। মোদ্দাকথা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিশ্রুতি হচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কারে সকল পর্যায়ে শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্যের অবসান। মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকার লঙ্ঘনের সকল অযৌক্তিক পন্থাকে সংহার করতে হবে। জনগণের সার্বিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্রতই হোক সরকারের প্রতিশ্রুতি রক্ষার প্রধান উদ্যোগ।
লেখক : শিক্ষাবিদ
সত্যনিষ্ঠায় জয়ী হোক দুদক কার্যক্রম
শীর্ষ সংবাদ: