আবহমানকাল থেকেই গোটা বিশ্বে কোনো না কোনো স্থানে হরহামেশাই সংঘাত লেগে থাকার ঘটনা দৃশ্যমান। সা¤প্রতিক সময়ও তার ব্যতিক্রম নয়। দুই বছর ১০ মাস ধরে চলমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ তারই এক উজ্জ্বল নিদর্শন। এ ছাড়া, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনের গাজা এবং অধিকৃত পশ্চিম তীর অঞ্চলে চলছে বর্বর ইসরায়েলি আগ্রাসন। ইতোমধ্যে এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের ফলে অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। পাশাপাশি, ধ্বংস হয়ে গেছে সংঘাতময় এলাকাগুলোতে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত অবকাঠামোগত স্থাপনা। ফলে যুদ্ধবিরতি ও শান্তি স্থাপন নিয়ে ‘মানবতার কাÐারি’ বলে খ্যাত বিশ্বমোড়লরা বিবদমান পক্ষগুলোর সঙ্গে দর কষাকষি করছে। কিন্তু আদতে সকল সংঘাত থেমে যাক— এটা কি আধুনিক রাষ্ট্রগুলো আসলেই মন থেকে চায়? এই উত্তর সন্ধান করতেই এই বিশ্লেষণ।
সংঘাত অব্যাহত থাকায় কিছু রাষ্ট্র লাভবান হচ্ছে
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, বিশ্বজুড়ে বেশ কয়েকটি অঞ্চলে সংঘাত চলমান থাকার কারণে কিছু কিছু রাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে সমর্থ হচ্ছে। পশ্চিমের অধিকাংশ প্রভাবশালী রাষ্ট্র এবং তাদের মিত্ররাই এই তালিকায় এগিয়ে রয়েছে। সংঘাতে লিপ্ত দেশগুলোর একটি নির্দিষ্ট পক্ষকে নিজেদের জোটের সঙ্গে রাখতে এবং প্রতিদ্ব›দ্বী জোটের সদস্যরাষ্ট্রের বিরোধিতা করতে পশ্চিমারা এ ধরনের কর্মকাÐ পরিচালনা করছে। আর এতে সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো শত্রæভাবাপন্ন দেশগুলোর ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুবর্ণ সুযোগ। এরপরও পশ্চিমারা মুখে যুদ্ধবিরতি ও শান্তির কথা উচ্চারণ করে নিজেদের কপটতারই শুধু বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে চলেছে অবিরত। যার জলজ্যান্ত প্রমাণ হলো একইসঙ্গে গাজা যুদ্ধে উভয়পক্ষকে যুদ্ধবিরতির আহŸান জানানো এবং উগ্র ডানপন্থী ইসরায়েলি বাহিনীকে নিরবচ্ছিন্নভাবে অস্ত্র সরবরাহ করা।
সহায়তার নামে নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়ন
পশ্চিমের ক্ষমতাধর রাষ্ট্র হোক, কিংবা প্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশ— সকলেই সংঘাতে লিপ্ত মিত্র দেশগুলোকে প্রতিনিয়ত সহায়তা করতে এগিয়ে আসছে। তবে এই সহায়তা যে একেবারে কোনো বিনিময় ছাড়াই করা হচ্ছে, তা ভাবার কোনো সুযোগ নেই। কারণ ভ‚রাজনৈতিক নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের অভিপ্রায় ছাড়া রুশ আগ্রাসনের শিকার হওয়া ইউক্রেন, গাজায় বর্বরোচিত গণহত্যা চালানো ইসরায়েল ও চীন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে ইচ্ছুক পুঁজিবাদী ভাবধারার তাইওয়ানের মতো তিনটি দেশকে সহায়তা দিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি দেশ কেন নিজেদের দেশের সাড়ে নয় হাজার কোটি ডলার ব্যয় করবে? একই ধরনের প্রশ্ন বিদ্যমান পশ্চিমা আধিপত্যবাদবিরোধী নীতির অনুসরণে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ও লেবাননের আধাসামরিক সংগঠন হিজবুল্লাহকে ইরান, চীন ও উত্তর কোরিয়ার মতো রাষ্ট্রের সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রেও।
যত সংঘাত, তত রমরমা অস্ত্র ব্যবসা
বিশ্বজুড়ে যখনই কোথাও সংঘাত বা যুদ্ধ শুরু হয়, তখনই হঠাৎ যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া পক্ষগুলোর বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামের প্রয়োজন হয়। ফলে অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম ক্রয়ের জন্য তারা প্রভাবশালী মিত্র রাষ্ট্রগুলোর শরণাপন্ন হয়। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতাধর দেশগুলো তাদের উৎপাদিত অস্ত্র রপ্তানি করে ব্যাপক পরিমাণে লভ্যাংশ আয় করার পথ তৈরি করে নেয়। চলমান ইউক্রেন ও গাজাযুদ্ধেও একই ঘটনাই ঘটছে। গত বছরেই বেশকিছু স্বনামধন্য মার্কিন সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের বিক্রি পূর্বের তুলনায় ৬ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল। সুইডিশ ও জার্মান অস্ত্রের চাহিদাও উত্তরোত্তর বাড়ছে ইউক্রেন যুদ্ধের খাতিরে। এ ছাড়া, ইরানের বিরুদ্ধে একইসঙ্গে রাশিয়াকে ড্রোন এবং ফিলিস্তিনের হামাস, লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের বিপুল পরিমাণ স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট সরবরাহ করার অভিযোগ রয়েছে। চীন ও উত্তর কোরিয়াও রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করছে বলে দাবি পশ্চিমাদের।
সংঘাতপূর্ণ এলাকা যুদ্ধপ্রযুক্তির পরীক্ষাগার
উন্নত রাষ্ট্রগুলো তাদের উৎপাদিত আধুনিক সমরাস্ত্রগুলো কখনও কখনও মিত্রদেশগুলোকে সরবরাহ করে সেগুলোর কার্যকারিতা যাচাই করে। তাই সংঘাতপূর্ণ এলাকাগুলোর সদ্য উদ্ভাবিত সামরিক অস্ত্র ও যুদ্ধপ্রযুক্তির পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সবচেয়ে বাস্তবধর্মী ক্ষেত্রে পরিণত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। ইসরায়েলের অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তথা ‘আয়রন ডোম’ সেরকমই এক বিশেষ প্রযুক্তি। বছরের পর বছর এই প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধন করে দেশটি হামাস ও অন্যান্য শত্রæগোষ্ঠীর ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেটকে আকাশেই ধ্বংস করে থাকে, যা পশ্চিমাদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। এ কারণে, পশ্চিমাদের কাছে চলমান গাজাযুদ্ধই আয়রন ডোমের কার্যকারিতা আরও একবার পরখ করে নেওয়ার মোক্ষম সুযোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একইভাবে, পশ্চিমা জোটের দাবি মোতাবেক রাশিয়া ইউক্রেনকে ইরানি ড্রোনশিল্পের সফল পরীক্ষাগারে পরিণত করেছে। এর পাশাপাশি, চীন এবং উত্তর কোরিয়াও তাদের অস্ত্রবাজারের বেশকিছু আধুনিক পণ্য রাশিয়ায় রপ্তানি করে নিজেদের পণ্যের মান যাচাই করে দেখছে বলে বিশ্বাস অনেক গবেষকের। ফলে সামগ্রিকভাবে এসব বহুমুখী দিক বিবেচনায় বিশ্বব্যাপী চলমান সংঘাত বন্ধ করতে বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো আসলেই কতটা কার্যকর ভ‚মিকা পালনে ইচ্ছুক— সেই প্রশ্ন অমীমাংসিতই রয়ে গেছে।
উত্তরণের পথ কোন দিকে?
অপর দেশ বা গোষ্ঠীর ওপর আধিপত্য বিস্তার করে কিংবা অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জনের উদ্দেশ্যে বিশ্বের নানা স্থানে সংঘাত জিইয়ে রাখার প্রবণতা যতদিন ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো আঁকড়ে থাকবে, ততদিন তাদের মধ্যে বিশ্বশান্তি ও মানবতাবোধ উন্নীতকরণে প্রকৃত আন্তরিকতার অভাব থেকেই যাবে। তবু এ পরিস্থিতি থেকে প্রকৃত অর্থে উত্তরণ সম্ভব হবে— নিজেদেরকে অন্য প্রভাবশালী রাষ্ট্রের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়ার পরিবর্তে যদি সংঘাতে লিপ্ত পক্ষগুলো তাদের বিরোধ নিষ্পত্তিতে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের সাহায্য গ্রহণ করে। এ ছাড়া, আন্তর্জাতিক অস্ত্র ব্যবসার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ, ভ‚রাজনৈতিক স্বার্থ ত্যাগ, এবং মানবিকতার প্রতি অঙ্গীকার জোরদার করতে হবে। একমাত্র এই পদক্ষেপগুলোই পারে বিশ্বের সংঘাত বন্ধ করে শান্তিপূর্ণ একটি বিশ্ব বিনির্মাণে কার্যকর ভ‚মিকা রাখতে। অন্যথায়, বিশ্বের মানবতাবাদীদের একটি সংঘাতমুক্ত কল্যাণ পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে!
শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়