ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ৫ পৌষ ১৪৩১

বিজয় ভাবনা ও সংস্কৃতির বিবর্তন

ফনিন্দ্র সরকার

প্রকাশিত: ২০:০৯, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪

বিজয় ভাবনা ও সংস্কৃতির বিবর্তন

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির জীবনে একটি ঐতিহাসিক দিন। পরাধীনতার শেকল ভেঙে ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধ করে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম ত্যাগের বিনিময়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি এক বিস্ময়কর অনুুষঙ্গ বিশ্ববাসীর কাছে। বীরত্বগাথা ইতিহাস সৃষ্টিতে বাঙালি জাতি যে ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল ঘটনা। ঐতিহ্যের অঙ্গীকারে আমরা যে পথ বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছি সে পথ যথেষ্ট কণ্টকাকীর্ণ। রাজনীতি, সমাজনীতির সমন্বয়ে যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তা বিবর্তনবাদের মধ্য দিয়ে উদ্্গিরণ করতে বাধ্য হচ্ছি। তবে হ্যাঁ, সংস্কৃতির পারস্পরিক আদান-প্রদানের ভাবটি মহৎ। বস্তুত এরকম আদান-প্রদানের ফলেই গড়ে উঠেছে আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতা। সেখান থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে অর্জিত বিজয়ের সাফল্য ধরে রাখার স্বার্থে। তাই কী ধরনের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এবং ঘাত-সংঘাতের পথ ধরে মহান সভ্যতা গড়ে ওঠে সে বিষয়ে কিছু আলোকপাত করা দরকার মনে করি।
উল্লেখ্য, গ্রিক চিন্তাধারা ইউরোপে প্রবেশ করে খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে। ততদিনে গ্রিস পরিণত হয়ে যায় একটা মৃত জাতিতে। দ্বিতীয় শতকের কাছাকাছি সময়ে গ্রিক রোমান সাম্রাজ্যের অধিকারে চলে যায়। তৃতীয় শতকে সে দেশ গ্রহণ করেছিল খ্রিস্টধর্ম, যা প্রাচীন গ্রিক সংস্কৃতির কাছে ছিল নেহায়েতই সম্পর্কহীন। সাধারণত দেখা যায়, খ্রিস্টধর্ম বা ইসলাম ধর্ম যেখানেই গেছে, সেখানেই তারা প্রাচীন সবকিছু পরিত্যাগ করেছে। প্রাচীন গ্রিক চিন্তাধারা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে কেবল পুস্তকের মধ্যে। পশ্চিম ইউরোপের অধিবাসীগণ ছিল অসভ্য ও গ্রিক চিন্তাধারা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। দানিয়ুব নদী পেরিয়ে রোমান সাম্রাজ্যের বাইরে অবস্থিত দেশগুলো ও জার্মানি সবই ছিল বর্বরের দেশ। পরবর্তীকালে রোমানরাও গ্রহণ করে খ্রিস্টধর্ম। কিন্তু জীবন সম্বন্ধে ওই ধর্মের দৃষ্টি ছিল সঙ্কীর্ণ। গ্রিক ও রোমানদের মহান অবদানের মূল্য সে ধর্ম অনুধাবন করতে না পেরে তাদের বলা হলো- ‘প্যাগান’ বা নিকৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। ফলে এসব সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে গেল। দ্বিতীয় দশক থেকে ১২৫০ খ্রি. পর্যন্ত এই মধ্যযুগকে ইতিহাসে অন্ধকার যুগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
পরবর্তীতে ইউরোপের যে মূল কেন্দ্র পূর্ব ও পশ্চিমের সংযোগ রক্ষা করত, সেই রোমান কনস্ট্যান্টিনোপল দখল করল তুর্কিরা। মুসলিম ধর্মাবলম্বী তুর্কিরা উত্তরোত্তর শক্তিশালী হয়ে নিকটবর্তী সব খ্রিস্টধর্মাবলম্বী দেশগুলো দখল করে নিল। ১৪৫৩ সালে রোমান কনস্ট্যান্টিনোপলের পতন হলে অনেক গ্রীক পণ্ডিত নিজের দেশ ছেড়ে বইপত্র সঙ্গে নিয়ে চলে যেতে আরম্ভ করেন পশ্চিম ইউরোপে। তুর্কির ভেতর দিয়ে ইউরোপীয়নদের পূর্বদিকে যেতে দেওয়া হলো না। ফলে ইউরোপ সব সংযোগ হারাল পূর্বের সঙ্গে এমনকি ভারতের সঙ্গেও। এই কারণে পশ্চিম বাধ্য হলো Cap of Good Hope- ‘উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে ভারতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের পথ খুঁজতে থাকে। অন্যরা ভারতের সন্ধানে পশ্চিমে অগ্রসর হতে হতে আমেরিকা পৌঁছে এবং এই আমেরিকাকেই ভারত মনে করল। এটা হচ্ছে ইতিহাস। ১৪৫৩ সালের কাছাকাছি সময়ে কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের সঙ্গে সঙ্গে গ্রীক চিন্তাধারা পশ্চিম ইউরোপে প্রবেশ করলে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি বিকশিত হতে থাকে। সেটা হচ্ছে- ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবতা ও উদারতা। আর এই দৃষ্টিভঙ্গিই ইউরোপীয় ইতিহাসে ‘রেনেসাঁ’ বা নবজাগরণ হিসেবে খ্যাত হয়। এরপর ষোড়শ শতাব্দী থেকে যা কিছু প্রগতি, সেসবই ইউরোপীয় মানসিকতায় ওই গ্রীক-রোমান সংস্কৃতির বীজ থেকে উৎপন্ন ফসল।
পরবর্তীকালে এলো সংস্কার প্রক্রিয়া। খ্রিস্টধর্ম কিছুটা ভেঙে পড়ল। এতে কিছু লোক নাস্তিক হয়ে গেল। নাস্তিকদের মধ্যে একজন ছিলেন ভল্টেয়ার। জার্মানি ও অন্য দেশের প্রজ্ঞাদীপ্ত বেশকিছু বুদ্ধিজীবীও নাস্তিক্যবাদ দর্শনে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। এর ফলে উত্থান ঘটে তারুণ্য-দীপ্ত ও উচ্ছলতায় ভরপুর নতুন ইউরোপের, যাকে আর তার নিজেদের মধ্যে বেঁধে রাখা গেল না। ঠিক যেমনটি ঘটেছিল প্রাচীন গ্রিসের ক্ষেত্রে। মাত্র আড়াই লাখ লোক নিয়ে গঠিত ছোট্ট শহর এথেন্স অসাধারণ প্রভাব বিস্তার করেছিল সমগ্র গ্রিসজুড়ে। ইউরোপীয় জাতি প্রচণ্ড শক্তি লাভ করে। কিন্তু সেই শক্তিতে সংহত করে রাখার উপায় না জানায় বেরিয়ে পড়ল বিভিন্ন দেশ জয় করতে। একটি দেশ জয় করত আর উপনিবেশ স্থাপন করত। সেইসঙ্গে অন্য জাতিদের শোষণ ও বিনাশ করত। অবশ্য তারা কিছু নতুন নতুন ভাব-ভাবনাও বিভিন্ন জাতির মধ্যে দান করেছিল। ইউরোপে তখন নতুন প্রাণ সঞ্চার হলেও তা পতনের মুখে পড়ে। আর ঠিক এ পর্বেই যুক্তিসিদ্ধ ও উদার ভারতীয় আধ্যাত্মভাবনা ইউরোপ ও আমেরিকায় পৌঁছে তাদের সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে শুরু করে। ব্রিটেন যখন ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার করল তখন তা ছিল পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে এক সংঘাতময় ঘটনা, যা বাঞ্ছনীয় ছিল না। তবে সেই সংঘাতই এখন সুখের সংঘাতে পরিণত হয়েছে। কেননা, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে এক চমৎকার ভাব বিনিময় চলছে বর্তমানে। এ দেশের মানুষ পশ্চিমের অনেক চিন্তাধারাকেই গ্রহণ করতে শুরু করেছে। আধুনিক পশ্চিমী সভ্যতা রোমের মতো মৃত্যুবরণ করবে না। রোমান সভ্যতার ধ্বংস অনিবার্য ছিল। খ্রিস্টধর্ম তার দখল নিল- কেবল চার্চই রইল আর রইল তার ক্ষমতা; বাকি সব মিলিয়ে গিয়েছিল। ঐতিহাসিক অধ্যাপক আর্নল্ড টয়েনবি উল্লেখ করেছেন, রোমান প্যাগানিজম (যার প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন রোমান সেনেটর সীম্বাখাস) এবং ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মের (যার প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন বিশপ অ্যাম্ব্রাজ) সঙ্গে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হয়। বিশপের মত তার খ্রিস্টধর্ম হচ্ছে- ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোর একমাত্র পথ। আর সিনেটর সীম্বাখাস প্যাগান মতকে তুলে ধরে বলেন, নানা পথে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানো যায়। এই মতভেদ চলতে থাকে। খ্রিস্টধর্ম চার্চ কিন্তু সেনেটর সীম্বাখাসের কণ্ঠরোধ করেন। কিন্তু টয়েনবীর সংযোজন সেই সিনেটরের কণ্ঠরোধ করা হলেও তিনি যে মত প্রকাশ করেন তাকে আজও লাখ লাখ হিন্দু সত্য বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে।
যা হোক, বর্তমানে এই উপমহাদেশের প্রায় প্রত্যেকটি দেশেই পুনর্জাগরণ ঘটেছে। এই জাগরণের সঙ্গে সঙ্গে সব পাশ্চাত্য দেশে নতুন ভাব-ভাবনা প্রবেশ করবে এবং তারা আবার নতুন যৌবন শক্তিতে সঞ্জীবিত হয়ে উঠবে। পাশ্চাত্যে আজ এমন অনেক মানুষ পাওয়া যায় যারা ‘খাও দাও আর মজা লুটো’- এই নীতিতে বিশ্বাসী। ভোগবাদী এই দর্শনের ভিত্তিতে গঠিত বর্তমান জীবনযাত্রা চায় না। এই মনোভাবের প্রথম প্রকাশ ঘটেছিল ‘হিপি’ আন্দোলনে বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে, পরে ফ্রান্সে। নতুন জীবন, নতুন সমাজ ব্যবস্থার প্রত্যাশা নিয়ে যে বাংলাদেশ রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি তার মর্যাদা যেন অক্ষুণ্ন রাখতে পারি। দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসটি স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে আমাদের মানসপটে। অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির ঐকমত্যের জাতি গঠনে সকলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করব- এটাই হোক বিজয়ের মাসের অঙ্গীকার। বর্ণিত ইতিহাসের আলোকে নতুন সমাজ গড়ে উঠবে-এ প্রত্যাশা সবার।   
লেখক : আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক
[email protected]

×