মানবজীবনে আদর শাসন লেখাপড়া পরবর্তীতে মানুষ গড়ার বিষয়টি একটি কঠিন বিষয়ই বটে। এর মধ্যে কোনো শিশু প্রকৃত মানুষ হয় আবার এ মানুষ হওয়ার পথেই অকালে হারিয়ে যায়। একটি গাছকে যেমন সার-পানি, আলো-বাতাস দিয়ে পুষ্টি জোগাতে হয়। মানবশিশুকেও তেমন আদব-কায়দা, শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে সভ্যতার উপাদান সরবরাহ করতে হয়। আগাছা তুলে না দিলে, বাড়তি ডালপালা ছেঁটে না দিলে চারাটি যেমন গাছে পরিণত হতে পারে না, তেমনি আদর- সোহাগের পাশাপাশি অনুশাসনের ছড়িটি না থাকলে মানবশিশুটিও ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে পারে না। তবে সার-পানি, আর ডাল ছাঁটার কথাই বলি কিংবা শিক্ষাদীক্ষা আর অনুশাসনের কথাই ধরি, প্রয়োগ করতে হয় সূক্ষ্ম কৌশলে ও সযত্ন প্রয়াসে। আজকাল বাসা-বাড়িতে, স্কুল-কলেজে, এমনকি দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাচ্চাদের ওপর শাসন নামের নির্যাতন চোখে পড়ে। সে শাসনের না আছে কোনো মাত্রা, আর না আছে শাসিতের প্রতি কোনো হিতকামনা।
শিশুদের এ পিছুটানের জন্য যখন কোনো শিক্ষককে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করা হয়, তখন অনেক শিক্ষক উল্টো প্রশ্ন করে বসেন, সন্তানের প্রতি অভিভাবকদের অতিরিক্ত শিথিলতা থাকার জন্য ছাত্রদেরকে শাসন করা যায় না। আর শাসন ছাড়া ছাত্র গড়া যায় না। তাহলে একটা ছাত্র যোগ্য হয়ে উঠবে কিভাবে? তারা তাদের এ উল্টো যুক্তি উপস্থাপন করে কেমন জানি নিজেদের ভারমুক্ত করতে চান। নির্দোষ প্রমাণিত করতে চান। যারা এ রকম প্রশ্ন করেন, তারা হয়তো এ ধারণাই করেন, বেত্রাঘাত ছাড়া ছাত্র গড়া যায় না। তারা মনে করেন, কোমলমতি শিশুদের একমাত্র শাসনই হলো ইচ্ছেমতো বেত্রাঘাত করা। তাদের কাছে বেত্রাঘাত ছাড়া শাসনের আর কোনো পদ্ধতিই যেন নেই। অথচ এ ধরনের চিন্তাধারা অনেকটাই ভ্রান্ত। ছাত্রদের অতিরিক্ত শাসনের ফলে হিতে বিপরীত হয়। শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া থেকে তো ছিটকে পড়ে, শিক্ষকদেরও এর জন্য দায়িত্বশীল ব্যক্তির অনেক কটু কথা শুনতে হয়। অনেক সময় ওই শিক্ষককে অভিভাবকদের দুর্ব্যবহারের মুখোমুখিও হতে হয়। কখনো প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চোখ রাঙানি এবং প্রশাসনিক আইনি ঝামেলাও পোহাতে হয়।
আদর্শ শিক্ষকের মাঝে যেসব গুণ থাকা জরুরি
বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ। এ সময়ে সামান্য কোনো ঘটনার সূত্রপাত হলেই পোস্টারিং বা মাইকিং করে কাউকে জানাতে হয় না। মুহূর্তেই তা সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে সর্বত্র ভাইরাল হয়ে যায়। সামান্য থেকে সামান্য বিষয় প্রশাসনের টেবিলে মহা-আকার ধারণ করে। যার জের ধরেই ওই শিক্ষককে আইনের গ্যাঁড়াকলে পড়ে লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়। তাই বেত্রাঘাত ছাড়া ছাত্র গড়ার কৌশল সম্বন্ধে সবার সচেতনতা কাম্য। আদর্শ শিক্ষক হওয়ার সব কর্মপদ্ধতি জানা চাই। মনীষীরা বলেছেন, একজন আদর্শ শিক্ষকের মাঝে কিছু গুণ থাকা জরুরি। তা হলো- ছাত্রদের প্রতি মুখে ডাক, চোখে পাক, ভাবে রাগ, মনে অনুরাগ থাকা। এর অর্থ হলো, ছাত্রদের প্রতি শিক্ষকের দায়িত্ব সচেতনতা বাড়াতে হবে। তাদের পড়ালেখার বিষয়ে সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। অন্যায় কিছু দেখলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে কাছে এনে সতর্ক করে দিতে হবে। এ আদরমাখা শাসনের কারণে ছাত্র খুব সহজেই তার অন্যায় ছেড়ে দেবে। কিন্তু যদি শিক্ষক কোনো অনর্থক কাজে ব্যস্ত থাকে কিংবা মোবাইল ব্যবহারে ব্যস্ত হয়, শিক্ষার্থী দুষ্টুমি করলে তার মাত্রাতিরিক্ত উগ্রতা প্রয়োগে তাকে অনর্গল বেত্রাঘাত করে, তাহলে সে শাসিত হবে দূর কি বাত, সংশোধনের বিপরীতে আরও নষ্ট হবে। ফলে শিক্ষকের ওপর অনেক বিপদ আসবে। জেলও খাটতে হতে পারে। সর্বশেষ আল্লাহর কাঠগড়ায় জবাবদিহি তো করতেই হবে।
আদর্শ শিক্ষকের শাসন এমন হবে, ছাত্র অপরাধ করলে, তাকে এমন কৌশলে শাসন করতে হবে, যেন ডাক দেওয়ার পর ছাত্র বোঝে, আমার আর দুষ্টুমি করা যাবে না। আমার শিক্ষক অনেক রাগী। কঠোর শাসনের মুখোমুখি করবে আমাকে। কয়েকবার এ রকম চোখ রাঙানি এবং ধমকানোর ভয়ে সে ঠিক হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। চোখ রাঙানির পর আবার মুহূর্তেই তার দিকে তাকিয়ে হেসে দেওয়া যাবে না; তাহলে শিক্ষকের এ টেকনিক বৃথা যাবে। বরং আগের মতো তার রাগান্বিত অবয়ব ধরে রাখতে হবে। কিন্তু এ রাগও যেন আবার সব সময়ের জন্য স্থায়ী না হয়। রাগের সময় যেন অন্তরে অনুরাগ, মায়া, আদর ও সোহাগ থাকে। এসব টেকনিক অবলম্বন করলেই তারা পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাবে না, আদর্শ শিক্ষার্থী হয়ে যাবে না। সময়-অসময়ে তাদেরকে পূর্বসূরিদের ছাত্রজীবনের শিক্ষামূলক ঘটনা শোনাতে হবে, সঙ্গে দোয়াও করতে হবে।
বলাবাহুল্য, জাগতিক ও ধর্মীয় কল্যাণ অর্জনে শিশুদের উত্তম শিষ্টাচারে অভ্যস্ত করানো অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব। কারণ প্রতিটি শিশুর শৈশবের জীবনটাই তার মেধা, মন ও রুচিশীল স্বভাব-প্রকৃতি গড়ে তোলার প্রকৃত সময়। কিন্তু অনেক অভিভাবককে এ ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির সীমাতিক্রম করতে দেখা যায়। ফলে সন্তান হয় একরোখা, বদমেজাজি ও আত্মপ্রত্যয়হীন। ইসলাম শাসনের ক্ষেত্রে সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছে। ইসলামী আইনশাস্ত্র মতে, সন্তানকে সুশিক্ষা দেওয়া পিতামাতার ওপর ফরজ। তাই কোরআন তিলাওয়াত, আদব ও ইলম শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে সন্তানকে বাধ্য করারও অধিকার আছে একজন পিতার। ইসমাইল বিন সাইদ (রহ.) বলেন, আমি ইমাম আহমদ (রহ.)-কে সন্তানের প্রহারের বৈধ কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম।
তিনি বলেন, সন্তানকে আদবের জন্য প্রহার করা যাবে। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, নামাজের জন্য কি প্রহার করা যাবে? তিনি জবাব দিলেন, ১০ বছরে উপনীত হলে তখন প্রহার করা যাবে।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব
[email protected]