বাংলাদেশে নিম্নতম মজুরি বোর্ড নামে একটি সংস্থা আছে, যাদের কার্যক্রম সম্পর্কে মূলত জানা যায় গার্মেন্টস শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির দাবি নিয়ে মাঠে নামলে। এই বোর্ড শিল্প খাতের সব কর্মক্ষেত্রে যে মজুরি নির্ধারণ করে, তাতে সচরাচর বছর শেষ মজুরি বৃদ্ধির নিয়ম রাখা হয় ৫ শতাংশ। অথচ গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে নিয়মিতভাবে মূল্যস্ফীতি ঘটছে বছরে কম-বেশি প্রায় ১০ শতাংশ হারে। বাংলাদেশের সরকার তার বড়জোর ২২ লাখ চাকরিজীবীকে মূল্যস্ফীতির কবল থেকে মুক্ত রাখতে নানা সময়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়। দিন কয়েক আগে মহার্ঘ্য ভাতা দেওয়ার পরিকল্পনা ঘোষণা এরই একটি অংশ। কিন্তু প্রায় ১৮ কোটি জনসংখ্যার আরও যে ৭-৮ কোটি শ্রম কাজে নিয়োজিত মানুষ রয়েছে, তাদের জন্য সরকার সমন্বিত কোনো পদক্ষেপ নেয় না। এর কারণ হয়তো সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় মহাশক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন আছে। কিন্তু বেসরকারি চাকরিতে গার্মেন্টস শ্রমিক বাদে আর কোনো অঙ্গনে আইনে থাকলেও সেই অর্থে ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ নেই। আবার ট্রেড ইউনিয়ন সরকারের শ্রম অধিদপ্তরের নিবন্ধিত হলেও শ্রমিকদের কল্যাণে তারা তেমন কিছু করেন না, তাদের সম্পর্ক ও ওঠা-বসা মালিক পক্ষের সঙ্গে। ফলে এ দেশে শ্রমিক জীবনে অর্থনীতির ভালো সময় কিংবা পুরনো বছরের বিদায় ও নতুন বছরের আগমন তেমন কোনো পরিবর্তন বয়ে আনে না। টানাপোড়েনের পুরনো জীবনই তাকে নতুন করে যাপন করতে হয়, বরং পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। কয়েক দশক ধরেই এমনটা দেখা যাচ্ছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এমন হওয়াটা খুব স্বাভাবিক প্রবণতা হলেও বাংলাদেশে বর্তমানে চলমান বৈষম্য থেকে মুক্তির প্রবল আকাক্সক্ষার এই সময়ে অবস্থার কিছুটা হলেও অন্তত পরিবর্তন দরকার। কারণ বাংলাদেশে শ্রমকাজে নিয়োজিত সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্মী ও তাদের ওপর নির্ভরশীল মানুষের বদ্ধমূল ধারণা, যাপিত জীবনটা বয়ে নিয়ে যেতে হয়, তাই সেও বয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং এক সময় এভাবেই হয়তো জীবনটা থেমে যাবে, আর তার পরেরটা পরবর্তী প্রজন্ম বুঝবে।
বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ও মজুরি সমস্যার মধ্যে যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, সে নিয়ে খুব একটা আলোচনা দেখা যায় না। অথচ মূল্যস্ফীতি ও মজুরির সমস্যা অর্থনীতির সামগ্রিক স্থিতিশীলতা এবং জনগণের জীবনযাত্রার মানের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। তার পরও মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ে নানা কথাবার্তা শোনা গেলেও মজুরি পরিস্থিতি নিয়ে কেউ সেই অর্থে কখনো কথা বলে না। এর কারণ হয়তো কথা বলার জায়গাগুলোতে মালিক পক্ষের শক্তিশালী উপস্থিতি। ফলে স্বাধীনতার অর্ধশতক পেরিয়ে গেলেও দেশে জাতীয়ভিত্তিক কোনো ন্যূনতম মজুরি প্রচলন করা যায়নি। উল্টো জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা যে টেকসই অর্থনীতির জন্য অতিগুরুত্বপূর্ণ, সে বিষয়টিই সবার মন থেকে দিন দিন উঠে যাচ্ছে। শ্রমিকদের দিক থেকে একটি জাতীয় ন্যূনতম মজুরির দাবি দীর্ঘদিনের হলেও নীতিনির্ধারকরা বিষয়টিকে সব সময় কঠিন-জটিল আখ্যা দিয়ে এড়িয়ে গেছেন। শ্রমিকদের দাবি মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে চলে গেলে তারা জোড়াতালি দিয়ে একটি সমাধান দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন। আর সময়ে সময়ে সরকারি কর্মচারীদের বেতন ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে চলছেন। এই সুবাদে সব সময় মালিক পক্ষও কোনো মজুরিসীমা নির্ধারণে প্রবল বিরোধী থাকতে পারছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে সরকারি নীতি ও পরিচালনা কাঠামোয় পুঁজির মালিকদের জোরালো উপস্থিতি শ্রম খাতে মজুরি বিষয়ে কোনো ভালো সিদ্ধান্ত নিতে মূল প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। সীমিত সামর্থ্য ও সময়ের জন্য আসা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলেও এমনটাই দেখা যাচ্ছে। অথচ একটি দেশের উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে মজুরি কাঠামোর জন্য একটি ন্যূনতম মানদণ্ড নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। এটি থাকলে সব ধরনের শ্রমজীবী মানুষের মজুরির জন্য একটি জাতীয় নিম্নসীমা প্রদান করা সম্ভব হয় এবং সে অনুযায়ী কাজের ধরন ও খাতভেদে পৃথক মজুরি নির্ধারণ করা যায়। শিল্প খাতের সামর্থ্য-সক্ষমতা বিচার করে খাতভিত্তিক ন্যূনতম মজুরিই কার্যকর পদ্ধতি। আবার একটি শ্রমঘন শিল্পে যে ধরনের ন্যূনতম মজুরি প্রয়োজন হয়, পুঁজিঘন শিল্পে সে ধরনের ন্যূনতম মজুরি প্রয়োজন হয় না। বাংলাদেশে ছোট ও মাঝারি অনেক অসংগঠিত খাত আছে, যেখানে লাখ লাখ মানুষ কাজ করছে। কিন্তু তাদের মজুরির জন্য কোনো দিকনির্দেশনা নেই। একটি জাতীয় মজুরি ব্যবস্থা থাকলে এসব খাতের মানুষ একটা ভিত্তি খুঁজে পেত, যা আবার অন্য সব খাতের জন্য একটি নিম্নতম মানদণ্ড হিসেবে কাজ করত। তা ছাড়া জাতীয়ভিত্তিক ন্যূনতম মজুরি থাকলে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে মজুরি সমন্বয় করা তুলনামূলকভাবে সহজ হতো।
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা সত্ত্বেও শ্রমশক্তির অন্তত ছয় কোটি মানুষের কাজ ও আয়ের জন্য খুঁজে নিতে বা সৃষ্টি করতে হয় অনানুষ্ঠানিক খাতের অনিশ্চিত, নিরাপত্তাহীন, বিপজ্জনক কাজকর্ম বা ক্ষুদ্র ব্যবসা-বাণিজ্য। আনুষ্ঠানিক খাতের এই বিশালত্বের মূল কারণ বেকারত্ব ও দারিদ্র্য। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বেকার থাকা সম্ভব না। কোনো না কোনো কাজ তাকে সৃষ্টি করতেই হয়, যা থেকেই তৈরি কুলি-টোকাই-হকার বা রিক্সা-টেম্পোচালক, মৌসুমি কৃষি শ্রমিক প্রভৃতি পেশা। অথচ মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রামানের অবমূল্যায়নে পণ্যের দাম বৃদ্ধির ধারা এই শ্রেণির মানুষের অর্থের মূল্য ক্রমাগতই কমিয়ে দেয়। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণ জ্বালানি ও আমদানি পণ্যের দাম বৃদ্ধি, আমদানিনির্ভর অর্থনীতিতে জ্বালানি, খাদ্যশস্য ও কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির প্রভাব অথবা সরবরাহ ব্যবস্থায় দুর্বলতা বলা হলেও মজুরি নির্ধারণ বিষয়ক নীতিপরিকল্পনার দুর্বলতা যে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দেয়, সে কথা কেউ ভাবে না। গবেষণায় দেখা গেছে, সরকারের অসম ও অপরিকল্পিত মজুরি নীতি অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত বিপুল জনগোষ্ঠীর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে আরও অনিশ্চিত করে দেয়। ২০১৫ সালে দেশের সরকারি কর্মচারীদের শতভাগ বেতন বৃদ্ধির জেরে বেসরকারি খাতের স্বল্প দক্ষতাসম্পন্ন অনেক কর্মী সাময়িকভাবে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গিয়েছিল। কোভিড-১৯ এর লকডাউনের সময় অনানুষ্ঠানিক খাতের ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষতি হয়েছে অপূরণীয়, অপরিমেয় ও অপরিসীম। কিন্তু এই দুই সময়েই সরকারকে পরিপূরক কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। কোভিডের সময় প্রণোদনার নামে সরকারের পক্ষ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা দেওয়া হলেও, তার বেশিরভাগই পেয়েছে প্রতিষ্ঠিত শিল্প খাতের মালিকরা। গবেষকদের মতে, বাংলাদেশে যখন বার্ষিক জাতীয় বাজেট প্রস্তাব করা হয় এবং সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাব আসে, তখন সার্বিক পণ্যমূল্য বেশ দ্রুততার সঙ্গে অন্তত ১০ শতাংশ বেড়ে যায়। সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়ছে এমন খবর আসামাত্রই দ্রুতগতিতে বাজারে পণ্যমূল্যও বেড়ে যায়। আর বেতন বৃদ্ধি ও বাজেট প্রস্তাব একই সময় হলে পণ্যমূল্য বাড়ে আরও দ্রুত হারে। কিন্তু বেতন ও সুযোগ-সুবিধা শুধু ২০-২২ লাখ সরকারি কর্মচারীদের বাড়লেও বর্ধিত দ্রব্যমূল্যের চাপ সবার ওপরেই গিয়ে পড়ে, যা বড় একটি অংশের মানুষকে এক ধাক্কায় দারিদ্র্যসীমার নিচে নিয়ে যায়।
বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, দেশে বছরে ২০ লাখ মানুষ চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে, যার মধ্যে ১৩-১৪ লাখের দেশের অভ্যন্তরেই কর্মসংস্থান হয়। বাকিরা দেশের বাইরে চলে যায়। ২০২৩ সালে দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার, ২০২২ সালে দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ছিল ৭ কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজার। অপরদিকে ২০২৩ সালে কর্মে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৯ লাখ ৮০ হাজার। বিবিএসের হিসাবে বেকারের বাইরে দেশের বড় একটি জনগোষ্ঠী শ্রমশক্তির বাইরে রয়েছে এবং এই সংখ্যাটি প্রায় ৪ কোটি ৭৪ লাখ হবে, যাদের বড় অংশই শিক্ষার্থী, অসুস্থ, অবসরপ্রাপ্ত বা বয়স্ক ব্যক্তি। বিবিএসের জরিপে বাংলাদেশে বেকারত্বের প্রকৃত চিত্র কখনোই পাওয়া যায় না। কারণ এখানে শ্রমশক্তির ৮০-৮৫ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত সেখানে মজুরি কম, কাজের পরিবেশ ভালো না, আবার চাকরিরও কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু নতুন বছর বা অর্থনৈতিক সংকট এলেই এই খাতের মানুষদের দুর্ভোগ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। প্রতি বছরই বাড়ি ভাড়াসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ে। সে অনুযায়ী বাড়ে না এই আনুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত মানুষের আয়। পক্ষান্তরে শ্রমমক্তির ১ শতাংশেরও কম দেশের সরকারি চাকরিজীবীরা সুযোগ-সুবিধার উচ্চ শিখরে অবস্থান করে। দিনকয়েক আগেও সরকারি সব চাকরিজীবীর জন্য মহার্ঘ্য ভাতার দেওয়ার ঘোষণা এসেছে। নতুন বছরেই হয়তো আরও বাড়বে তাদের আয়। কিন্তু সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবীদের সুযোগ-সুবিধার ব্যবধান যে আকাশ-পাতাল হচ্ছে এবং এর ফলে যে সামাজিক বৈষম্য ক্রমশই বাড়ছে, সে নিয়ে কারও চিন্তা দেখা যায় না। ঢাকা শহরে একজন বেসরকারি চাকরিজীবীর বেতনের অর্ধেকটাই ব্যয় হয় বাড়ি ভাড়ার পেছনে। বাকি টাকায় খাবার, চিকিৎসা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয়সহ ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচে। এর ফলে তারা ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় বা সম্পদ কিছুই করতে পারে না। অপরদিকে অধিক আয়ের সুবাদে একশ্রেণির মানুষের অর্থের পাহাড় জমছে, যা সমাজে বহুমাত্রিক বৈষম্যকে আরও উস্কে দিচ্ছে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বিশ^ব্যাপী অনানুষ্ঠানিক খাতের অর্থনীতির আকার ১০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ, যা বিশে^র দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীনের চেয়েও বড়। এই অর্থনীতির সঙ্গে পৃথিবীর ৭৮০ কোটি মানুষের মধ্যে ১৮০ কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা জড়িত, যেখানে সৃষ্টি হয় বৈশি^ক জিডিপির প্রায় ৫০ শতাংশ এবং বৈশি^ক শ্রমশক্তির ৮০-৮৫ শতাংশও এর সঙ্গে জড়িত। বিশ^ব্যাপী অনানুষ্ঠানিক খাতের অর্থনীতিই একমাত্র আর্থিক ক্ষেত্র, যা ক্রমবর্ধমান। সামনের ১০-১৫ বছরে এই অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হবে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশে মোট সক্রিয় শ্রমশক্তির অর্থাৎ শ্রমবাজারের ৮০-৮৫ শতাংশই এই অনানুষ্ঠানিক খাতেই নিয়োজিত। অনানুষ্ঠানিক খাত বলতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, যে কোনো কাজ ও শ্রমিকদের এক বৈচিত্র্যময় সমবায়কে বোঝায়, যা রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে না, লক্ষণীয় কোনো সুরক্ষাও দেয় না। রাষ্ট্র এই খাত থেকে কোনো কর আদায় করে না, এ কথা রাষ্ট্র সবসময় বলে এলেও প্রকৃত অর্থে উন্নয়নশীল বিশে^ রাষ্ট্র অনানুষ্ঠানিক খাত থেকেই সবচেয়ে বেশি কর আদায় করছে পরোক্ষ কর আদায়ের মাধ্যমে। আবার সরকারি প্রশাসন ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্তরা অনানুষ্ঠানিক খাতের মানুষের কাছ থেকে নিয়মিত টাকা নেয়, রাজনৈতিক মাস্তান-চাঁদাবাজ ও মধ্যস্বত্বভোগীরা এদের কাছ থেকে নিয়মিত বখরা নেয়। কিন্তু এদের দেখার জন্য কেউ নেই। তার পরও জীবন-জীবিকার জন্য অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মসংস্থানের ওপর নির্ভরশীলতা ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। আর এর সঙ্গে পাল্লা দিয়েই বাড়ছে বিশাল এক জনগোষ্ঠীর আয়ের অনিশ্চয়তা, যা বাংলাদেশের টেকসই অর্থনীতি অর্জনের পথে নিশ্চিতভাবেই বড় অন্তরায়।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যতই হোক না কেন, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বিকাশ মাত্রা যাই-ই হোক না কেন শ্রমিকের নবসংযোজিত মূল্য বা উদ্বৃত্ত মূল্য কিছু মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত ও কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। ফলে বৈষম্য-অসমতাও বাড়ছে। কারণ উৎপাদনের উপায়ের ওপর ব্যক্তিমালিকানাধীন পুঁজির মালিক নিজ শ্রমে নতুন কোনো মূল্য সৃষ্টি করেন না। পুঁজির মালিক মূলত উৎপাদন প্রক্রিয়ায় শ্রমিক ভাড়া করেন, যার একমাত্র সম্বল নিজের শ্রমশক্তি। শ্রমিকের শ্রমেই সৃষ্টি হয় নবসৃষ্ট মূল্য, যা-ই কেবল মজুরির চেয়ে অতিরিক্ত মূল্য সৃষ্টি করতে সক্ষম এবং এই উদ্বৃত্ত মূল্যই মালিক পক্ষের মূল লক্ষ্য। শ্রমের সঙ্গে পুঁজির এই বিরোধ অতীতেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে যদি উৎপাদনের উপায়ের ওপর ব্যক্তিমালিকানা অব্যাহত থাকে। কিন্তু বৈষম্য নিয়ে বাংলাদেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া যুগান্তকারী ঘটনায় এই মালিক-শ্রমিকের দ্বন্দ্ব এবং ক্রমশই বেড়ে চলা বহুমাত্রিক বৈষম্য কিছুটা হলেও শোভন পর্যায়ে নামিয়ে আনা সংখ্যাগরিষ্ঠ সব মানুষেরই কাম্য। আর এ জন্য রাষ্ট্রের পরিচালকদের শুধু মূল্যস্ফীতি-মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে ভাবলেই চলবে না, সামগ্রিকভাবে মানুষের আয়-রোজগারের দিকেও নজর দিতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি