মানব সমাজের ইতিহাস হলো সমাজ বিকাশের ইতিহাস। উৎপাদন ব্যবস্থার ইতিহাস। পৃথিবীর উৎপত্তির শুরু থেকেই সমাজের বিকাশ সাধন হয়ে আসছে। একইসঙ্গে হচ্ছে উৎপাদনের বিকাশ। পৃথিবী উৎপত্তির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সমাজ বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে বর্তমান সমাজে পৌঁছেছে। যেগুলো হলোÑ আদিম সাম্যবাদী সমাজ, দাস সমাজ, সামন্তবাদী সমাজ, পুঁজিবাদী সমাজ ও সমাজতান্ত্রিক সমাজ। প্রত্যেকটি সমাজই একেকটি উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এসেছে। এই উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে দুই ধরনের সম্পর্কের ভিত্তিতে। উৎপাদন সম্পর্ক ও উৎপাদন শক্তি। উৎপাদন সম্পর্ক ও উৎপাদন শক্তির নির্দিষ্ট সম্পর্কের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে সমাজ ব্যবস্থা।
উৎপাদন করতে গিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের যে সম্পর্ক হয়, তাকে বলা হয় উৎপাদন সম্পর্ক এবং মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির যে সম্পর্ক হয়, তাকে বলা হয় উৎপাদন শক্তি। আদিম সাম্যবাদী সমাজে মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক অর্থাৎ উৎপাদন সম্পর্ক ছিল সাম্যবাদী। সমাজবদ্ধ মানুষ সকলেই একসঙ্গে পশু শিকার করতে যেত। শিকারের সেইসব যন্ত্রপাতিও ছিল সামাজিক মালিকানায় অর্থাৎ কারও কোনো ব্যক্তিগত সম্পদ ছিল না। যার যার সাধ্যমত পরিশ্রম করত, কিন্তু ভোগের সময় সবাই যার যার প্রয়োজন অনুযায়ী ভোগ করত।
আদিম সাম্যবাদী সমাজের পরবর্তী সমাজ ব্যবস্থা হলো দাস সমাজ। দাস সমাজে মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক ছিল অর্থাৎ উৎপাদন সম্পর্ক ছিল দাস প্রথাভিত্তিক। দাস সমাজেই প্রথম ব্যক্তিগত সম্পত্তি, শ্রেণি সংগ্রাম, শ্রেণি বৈষম্য, শ্রেণি শোষণ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার উদ্ভব হয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভবের জন্য দাস সমাজে দুই ধরনের শ্রেণির উদ্ভব হয়। যার একটির নাম ভূস্বামী শ্রেণি। অপরটি দাস শ্রেণি। ভূস্বামী শ্রেণি সকল সম্পত্তির মালিক ছিল। দাসরাও তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে উৎপাদন কাজে নিয়োজিত থাকত এবং উৎপাদনের সকল কাজ সম্পন্ন করত দাসরাই। কিন্তু উৎপাদিত সকল সম্পদের মালিক হতো ভূস্বামী শ্রেণি, যদিও তারা উৎপাদন কাজে অংশগ্রহণ করত না। দাসদের কোনো রকম বেঁচে থাকার জন্য যৎসামান্য খাবার দিত। বাকি সকল সম্পত্তির মালিক হতো ভূস্বামী শ্রেণি। অর্থাৎ দাস সমাজের এই উৎপাদন সম্পর্ক ছিল চরমমাত্রার বৈষম্যমূলক উৎপাদন সম্পর্ক।
যে কোন দেশে রাষ্ট্র ও রাজনীতির ভিত্তি হলো অর্থনীতি ও এর উৎপাদন সম্পর্ক। অর্থাৎ একটি দেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজ ব্যবস্থা জনকল্যাণকর হবে, নাকি শোষণের হাতিয়ার হবে, তা নির্ভর করে ঐ রাষ্ট্রের উৎপাদন সম্পর্কের ওপর। উৎপাদন সম্পর্ক যদি হয় বৈষম্যমূলক অর্থাৎ বৈষম্যের বীজ যদি উৎপাদন সম্পর্কে নিহিত থাকে, তাহলে সমাজ, রাষ্ট্র ও দেশ থেকে কখনোই বৈষম্য দূর করা যাবে না। আর যদি উৎপাদন সম্পর্কে বৈষম্য না থাকে, তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্রে চাইলেই সহজে বৈষম্য তৈরি করা যাবে না। অর্থাৎ বৈষম্যের গোড়াপত্তন হয় উৎপাদন সম্পর্ক থেকে। সুতরাং সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে বৈষম্য কার্যকরভাবে দূর করতে চাইলে মূল থেকে অর্থাৎ উৎপাদন সম্পর্ক থেকে বৈষম্য দূর করতে হবে। দাস সমাজের উৎপাদন সম্পর্কেই বৈষম্য ছিল। যে কারণে দাস সমাজে বৈষম্য বিদ্যমান ছিল। দীর্ঘদিন এভাবে চলতে চলতে বিপ্লবের মাধ্যমে দাস প্রথাভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙে সামন্তবাদী সমাজ আসে, যেখানে নতুন উৎপাদন সম্পর্ক হয় ভূমি কেন্দ্রিক।
সামন্ত সমাজেও দুটি শ্রেণি। ভূস্বামী শ্রেণি ও শ্রমিক শ্রেণি। পূর্ববর্তী সমাজের মতোই উৎপাদনের মূল উপাদান ভূমির মালিক, ভূস্বামী শ্রেণি এবং শ্রমিক শ্রেণি। ভূস্বামী শ্রেণির ভূমিতে কাজের বিনিময়ে উৎপন্ন ফসলের একটা ন্যূনতম অংশ পাচ্ছে শ্রমিক শ্রেণি। উৎপাদন করছে শ্রমিক শ্রেণি কিন্তু উৎপাদিত দ্রব্য বা পণ্যের বৃহত্তম অংশ নিয়ে যাচ্ছে ভূস্বামী শ্রেণি। অর্থাৎ এই সমাজেও শোষণ বিদ্যমান। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এই সমাজেও উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যেই শোষণ পদ্ধতি বিদ্যমান। ফলে, যেই সমাজে উৎপাদন পদ্ধতিতেই শোষণের অস্তিত্ব, সেই সমাজ থেকে শোষণ দূর করা এক প্রহসনের আলাপ।
দীর্ঘদিন এভাবে চলতে চলতে বিপ্লবের মাধ্যমে ভূমি কেন্দ্রিক সামন্তবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙে নতুন পুঁজিবাদী সমাজ আসে, যেখানে নতুন উৎপাদন সম্পর্ক হয়। নতুন সমাজ ব্যবস্থায় নতুন উৎপাদন সম্পর্ক স্থাপিত হয় শ্রেণি দুটির মাঝে, যার নাম পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ক এবং একই সঙ্গে একে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা বা ধনতন্ত্র বলা হয়।
পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের মূল কথা হলোÑ পুঁজিপতিরা পুঁজি এবং উৎপাদন যন্ত্রের মালিক। শ্রমিক শ্রেণিকে বলা হয় সর্বহারা শ্রেণি। কেননা, শ্রমিকদের একমাত্র সম্বল হলো শ্রম শক্তি। উৎপাদন কাজে নিয়োজিত থেকে দ্রব্য বা পণ্য উৎপাদন করে এই শ্রমিক শ্রেণি। পুঁজিপতি শ্রেণি উৎপাদন কার্যে অংশগ্রহণ করে না। শ্রমিক শ্রেণি উৎপাদন করলেও পণ্য বা দ্রব্যের মালিক হয় পুঁজিপতি শ্রেণি শুধু পুঁজি ও উৎপাদন যন্ত্র তাদের হাতে থাকার কারণে। পুঁজিপতি শ্রেণি নামমাত্র মূল্যে শ্রমিকদের শ্রমশক্তি কিনে নেয়। শ্রমিক শ্রেণির আর কোনো সম্বল না থাকায় তারা বাধ্য হয়ে অল্প দামে শ্রম বিক্রি করতে অর্থাৎ শোষিত হয়। পুঁজিবাদী সমাজে যে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা এবং পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ক, এখানেই শোষণ লুকায়িত। অর্থাৎ এই ব্যবস্থার মধ্যেই শোষণ অন্তর্নিহিত। সুতরাং পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার সংস্কার এবং উৎপাদন সম্পর্কের সংস্কার ছাড়া পুঁজিবাদী সমাজ থেকে শোষণ দূর করার উপায় নেই।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ১. নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন ২. পুলিশ সংস্কার কমিশন ৩. বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন ৪. জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ৫. সংবিধান ও দুর্নীতি দমন সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠন করা হয় প্রথম ধাপে। পরবর্তীতে আরও চারটি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয় ‘স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, শ্রমিক অধিকারবিষয়ক সংস্কার কমিশন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন। বর্তমানে আমরা পুঁজিবাদী সমাজে বসবাস করছি। যেহেতু পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার মধ্যেই শোষণ, বৈষম্য অন্তর্নিহিত। সুতরাং এই শোষণ ও বৈষম্যবাদী উৎপাদন সম্পর্ক, উৎপাদন ব্যবস্থার বিলোপ না ঘটিয়ে যত সংস্কারই করা হোক না কেন, তাতে মূল সমস্যার সমাধান হবে না। সুতরাং সমস্যার গোড়াপত্তন যেখানে অর্থাৎ উৎপাদন সম্পর্ক, সেখান থেকে সমাধান শুরু করতে হবে। সরকার গণঅভ্যত্থানের আকাক্সক্ষায় বৈষম্যের অবসানের জন্য প্রথম পর্বে ছয়টি এবং পরবর্তীতে আরও চারটি সংস্কার কমিশন গঠন করলেও উৎপাদন সম্পর্কের বৈষম্য বিলুপ্তির লক্ষ্যে কোনো কমিশন গঠন করেনি। ফলে, যেখান থেকে সকল সমস্যার উৎপত্তি, সেই জায়গা অধরা রেখে পরিপূর্ণ ভাবে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ফলে, উৎপাদন সম্পর্কের সংস্কার অতীব জরুরি এবং মুখ্য বিষয়।
লেখক : সমাজকর্মী
মোহাম্মদ আলী