জৈন্তিয়া রাজ্যের ইতিহাস সিলেট অঞ্চলের একটি মহৎ অধ্যায়, যা এই অঞ্চলের রাজনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতি এবং সমাজের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। সিলেট বিভাগের উত্তরে অবস্থিত এই রাজ্যটি ছিল প্রাচীন এবং ঐতিহ্যময়। খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা এ রাজ্য তার স্বতন্ত্র রাজনৈতিক কাঠামো, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য খ্যাত।
জৈন্তিয়া রাজ্যটি বর্তমান সিলেট জেলার কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত ছিলো। এই রাজ্যটি মোট ৩৬টি পরগনায় বিভক্ত ছিলো। এর মধ্য থেকে উক্ত ৩ উপজেলায় ১৮ টি পরগনা এবং বর্তমান মেঘালয়ে ছিলো ১৮ টি পরগনা। জৈন্তিয়া রাজ্যের ভৌগোলিক অবস্থান ছিল অত্যন্ত কৌশলগত। এর উত্তরে মেঘালয়ের খাসিয়া ও জৈন্তিয়া পাহাড় এবং দক্ষিণে সুরমা নদী রাজ্যটিকে একদিকে প্রাকৃতিক দুর্গের মতো সুরক্ষা দিত, অন্যদিকে বাণিজ্যের জন্য সুযোগ করে দিত। সুরমা নদী এবং এর উপনদীগুলো শুধু পরিবহন এবং সেচের কাজেই ব্যবহৃত হত না, রাজ্যের অর্থনৈতিক কাঠামোকেও মজবুত করত। নদী-নালা, পাহাড়, এবং অরণ্যপ্রধান এ রাজ্যে চুনাপাথর এবং কয়লার মতো খনিজ সম্পদের ভান্ডার ছিল, যা রাজ্যের ধন-সম্পদ বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।
জৈন্তিয়া রাজ্যের রাজনীতি ছিল স্বতন্ত্র এবং শক্তিশালী। মোগল আমলে যখন সমগ্র বাংলা মোগলদের অধীনস্থ ছিল, তখনও জৈন্তিয়া রাজ্য স্বায়ত্তশাসন বজায় রেখেছিল। মোগলদের সামরিক শক্তি এবং প্রশাসনিক দক্ষতা সত্ত্বেও রাজ্যের ভৌগোলিক দুর্গমতা এবং স্থানীয় জনগণের প্রতিরোধ শক্তি মোগলদের এখানে স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করতে বাধা দেয়। মোগলদের পর, ব্রিটিশ শাসনের আমলে এই রাজ্য তাদের স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে। তবে ব্রিটিশদের আধুনিক অস্ত্র এবং কৌশলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পেরে ১৮৩৫ সালে জৈন্তিয়া রাজ্য ব্রিটিশদের দ্বারা বিলুপ্ত হয়।
জৈন্তিয়া রাজ্যের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবন ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। রাজ্যের অধিবাসীরা প্রধানত খাসিয়া জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। যারা প্রকৃতি পূজা করত এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রকৃতির সঙ্গে গভীর সম্পর্ক বজায় রাখত। জৈন্তিয়া রাজ্যের অন্যতম আলোচিত এবং বিতর্কিত ধর্মীয় রীতি ছিল নরবলি। দেবতাদের সন্তুষ্ট করতে রাজ্যের প্রাচীন মন্দিরে নরবলির আয়োজন করা হত। এটি রাজ্যের ধর্মীয় রীতিনীতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল, যদিও ব্রিটিশ শাসকদের দৃষ্টিতে এটি ছিল অমানবিক এবং বর্বর। এই নরবলি প্রথার বিরোধিতা করে ব্রিটিশরা জৈন্তিয়া রাজ্যের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং একপর্যায়ে রাজ্যের স্বাধীনতা হরণের পটভূমি রচনা করে।
জৈন্তিয়া রাজ্যের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং ঐতিহ্য রাজ্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। পাহাড়ি জনগণের মধ্যে সংগীত, নৃত্য এবং উৎসবের প্রতি বিশেষ আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। ধান কাটার সময়, বর্ষার শুরু, এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক উপলক্ষগুলোতে বড় আকারে উৎসব আয়োজন করা হত। সঙ্গীত, নৃত্য, এবং ঐতিহ্যবাহী পোশাক এই উৎসবগুলোর সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলতো। এর সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য এতোই প্রবল যে, এ রাজ্যের পতনের ২০০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও সুরমা নদীর যে পারে জৈন্তিয়া রাজ্য ছিলো তারা অপর পারের মানুষকে 'মোগলি'(মোগল সাম্রাজ্যের অধীনস্থ) বলে সম্বোধন করে এবং অপর পারের মানুষ তাদেরকে 'জৈন্তাপুরি' বলে ডাকে। জৈন্তিয়া অঞ্চলের(কানাইঘাট) মানুষের ভাষা সিলেটের অন্যান্য অঞ্চলের ভাষার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা এবং ধীরগতির। এমনকি জৈন্তাপুর অঞ্চলের মানুষের ধ্যান ধারণা সিলেটের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের থেকে স্বতন্ত্র এবং এই স্বাতন্ত্র্যবোধের জন্য কেউ তার সন্তানকে মোঘলিদের সাথে বিয়েও দেয়না (এটা বর্তমান সময়ে কিছুটা কমতে শুরু করছে)।
জৈন্তিয়া রাজ্যের পতনের পেছনে একাধিক কারণ ছিল। অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা, প্রশাসনিক কাঠামোর অভাব এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে বিভক্তি রাজ্যের ক্ষমতাকে ক্রমে ক্ষয়িষ্ণু করে তোলে। ব্রিটিশদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র এবং কৌশলগত দক্ষতার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো সামরিক সক্ষমতা রাজ্যের ছিল না। নরবলি প্রথা বন্ধ করার জন্য ব্রিটিশদের কঠোর পদক্ষেপ এবং এই ইস্যুতে রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত করে। ১৮৩৫ সালে ব্রিটিশরা জৈন্তিয়া রাজ্যকে তাদের শাসনের অধীনে নিয়ে যায় এবং রাজ্যের স্বাধীনতার সমাপ্তি ঘটে। এই স্বাধীন রাজ্যের বিলুপ্তি সিলেট অঞ্চলের ইতিহাসে একটি নতুন মোড় এনে দেয়। যদিও জৈন্তিয়া রাজ্য আর আজ স্বাধীন নয়, এর ইতিহাস এবং ঐতিহ্য সিলেটের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
আজ জৈন্তাপুর অঞ্চলে (কানাইঘাট, জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট) জৈন্তিয়া রাজ্যের প্রাচীন মন্দির, জৈন্তিয়া রাজবাড়ি এবং অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থাপনা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গবেষক এবং পর্যটকদের কাছে এই অঞ্চলটি একটি আকর্ষণীয় স্থান। স্থানীয় জনসাধারণ এবং ঐতিহাসিকরা জৈন্তিয়া রাজ্যের স্মৃতি ধরে রাখতে এবং এর গৌরবময় ইতিহাসকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে কাজ করে যাচ্ছেন।
জৈন্তিয়া রাজ্যের ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয় কীভাবে একটি ছোট রাজ্য বড় শক্তির সঙ্গে লড়াই করেছিল এবং স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগ করেছে। এর সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় ঐতিহ্য আমাদের অতীতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে এবং সিলেট অঞ্চলের একটি অনন্য পরিচিতি তৈরি করে। জৈন্তিয়া রাজ্যের হারিয়ে যাওয়া গৌরবময় অধ্যায় শুধুমাত্র স্মৃতির আকারে নয়, বরং আমাদের ঐতিহ্যের গভীরে চিরকাল বেঁচে থাকবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল: [email protected]
মোহাম্মদ আলী