ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৪ পৌষ ১৪৩১

এক ভয়াল রাতে শাকিলের শেষ যাত্রা

ড. এ. কে. আজাদ, সহযোগী অধ্যাপক, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি       

প্রকাশিত: ১২:৫২, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪

এক ভয়াল রাতে শাকিলের শেষ যাত্রা

ছবি: সংগৃহীত

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চুড়ান্ত পরিণতি  ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণবিপ্লব এবং ছাত্রজনতার অবিশ্বাস্য বিজয়। বিজয়ের এ ধারা কখনো মসৃণ পথে পিচ্ছিল যাত্রা ছিলনা। প্রায় ২ হাজার বনি আদমের শহীদ হওয়া, ৩০ হাজার মানুষের আহত ও অঙ্গহানির বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীনতা।


সময়টা ছিল ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার। বিকেলে ফেসবুক খুলতেই দেখি পারভেজ এর মৃত্যু সংবাদ। মোঃ শাকিল হোসেন পারভেজ, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিবিএ প্রগ্রামের আশুলিয়া ক্যাম্পাসে আমাদের ছাত্র। কোটা সংস্কার আন্দোলনে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে উত্তারায় পুলিশের গুলিতে শাহাদত বরণ করেন। কোন মতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সাথে সাথে শাকিলকে ফোন দিলাম, কিন্তু ফোনে  না পেয়ে আর একজন ছাত্রকে  ফোন দিলাম এবং জানতে পারলাম ঘটনার সত্যতা। এর পর ভিসি স্যার, প্রক্টর, সহকারি প্রক্টর, ডীন, রেজিস্ট্রার, ডেপুটি রেজিস্ট্রার, কোর্ডিনেটরসহ আরও বেশ ক’জন সহকর্মীর সাথে আলাপ করলাম। মসজিদে মাগরিবের আজান চলছে, আজানের সাথে মোহাম্মাদপুর শিয়া মসজিদের সামনে মুহুর্মুহু গোলাগুলির শব্দ, সাথে মিছিলের উচ্চ আওয়াজ। আমজনতার ছোটাছুটি। কোন মতে নফল রোজার ইফতার ও নামায শেষে স্ত্রী-সন্তানকে বললাম,আমি যাই। তোমরা আমার  জন্য দোয়া করো। মহান আল্লাহ্র নাম নিয়ে বের হলাম। কিছুদূর হাটার পর একটা  রিক্সা নিয়ে শ্যামলী। চালক জানালো ভাই, ওদিকে মারামারি হচ্ছে, “আমি যাইয়াম না”।
আরো কিছুদূর হেটে, আর একটা রিক্সা পেলাম, খুব অনুরোধ করে তিনগুণ ভাড়া দেয়ার শর্তে রাজি হলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে শ্যামলীতে পৌঁছলাম। রাস্তায় পুলিশ-বিজিবির গাড়ি ও দু’ একটি রিক্সা ছাড়া আর কিছু চোখে পড়লো না। শ্যামলী থেকে সিএনজিতে  মাজার রোড, সেখান থেকে আর একটা সিএনজিতে বিরুলীয়া ব্রিজ। রাস্তায় কোন যানবাহন নেই বললেই চলে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরদারি  লক্ষ্য করলাম। বিরুলীয়া ব্রিজ থেকে অটোরিক্সায় মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুলিয়া ক্যাম্পাস।


ফ্রিজ এ্যাম্বুলেন্সে আমার সদা হাস্যোজ্জ্বল শাকিলকে নীরবে ঘুমাতে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। আবার শক্ত হওয়ার  চেষ্টা করলাম এই ভেবে যে, আমি যদি এভাবে ভেঙে পড়ি তবে ছাত্র-ছাত্রীদের অবস্থা কী হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জানাযা নামাজে দাঁড়িয়ে গেলাম। নামাজ শেষে শাকিলের লাশ নিয়ে যাওয়া হলো তামীরুল মিল্লাতের গাজীপুর ক্যাম্পাসে এবং সেখান থেকে টঙ্গী পূবাইল হয়ে তাঁর জেলা লক্ষীপুর।


এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা ও  ছাত্র-ছা্ত্রীদের সম্মিলিত মিটিঙে তাদের  দাবীগুলো লিখিত আকারে জমা দেয়। 


লাশের সাথে কে যাবে এই ভয়াল রাতে, এই নিয়ে চলছিল বেশ আলোচনা। অনেকেই সেদিন রাতে যাওয়ার ব্যাপারে পিছ পা হলেন।  অনেকে পরের দিন যাওয়ার কথা বললেও বাস্তবে আর যাওয়া হয়নি। অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি সেরাতের ভয়াবহতায় জানাজা নামাযেও আসতে পারেনি।         

বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশনায় রাত দশটার দিকে আশুলিয়া ক্যাম্পাস থেকে আমার নেতৃত্বে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও ছাত্রসহ দশ সদস্যের একটি টিম নিয়ে আমরা রওনা হলাম শাকিলের বাড়ী গাজীপুরে তাকে দাফনের জন্য। আবদুল্লাহপুর যাওয়ার সাথে সাথেই একদল লোক লাঠি দেখিয়ে আমাদের গাড়ি উল্টো ঘুরাতে বললো। গাড়ির চালক বাবুল ভাই বললো, কী করবো স্যার? ওরাতো গাড়ি ভেঙ্গে ফেলতে পারে, গাড়ি জ্বালিয়েও দিতে পারে। আমি বললাম, বাবুল ভাই পিছনে ফেরার কোন উপায় নাই। এখন do or die! সামনে এগিয়ে যেতে হবে। গাড়ি এগিয়ে গেল, আমরা পরিচয় দিলাম, কথা বললাম, ওরা আমাদের গাড়ির দরজা খুলে চেক করলো, লাইট  মেড়ে আমাদের চেহারা দেখলো। তারপর যেতে দিল। এভাবে বেশ কয়েকবার আমাদের গাড়ি চেকের  সম্মুখিন  হলাম। প্রতিবারই যখন হাতে লাঠি নিয়ে কিংবা আইন শৃংখলা বাহিনীর পরিচয়ে আমাদের গাড়ি থামিয়ে চেক করছিল তখন আমারা কিছুটা আতংকিত হয়ে পড়ছিলাম। কারণ অনেক  গাড়ি জ্বালিয়ে দিতে দেখেছি, অনেক মানুষকে হতাহত হতে দেখেছি, অনেক মানুষকে বন্দী করে  নিয়ে যেতে দেখেছি, নির্মম অত্যাচারের দৃশ্য দেখেছি। কিন্তু যতবারই আমরা ভয় পেয়েছি, আমার মনে হয়েছে শাকিল আমাকে বলছে, স্যার ভয় পাবে না আমি আপনাদের সাথে আছি। মহান আল্লাহ্র অসীম কৃপায় আমার বারবার একথাই  মনে হয়েছে। শাকিলের গাড়ি যখনই একটু পিছনে  পড়ে যাচ্ছিল তখনই আমার ভয়, চিন্তা ও উদ্বেগ বেড়ে যাচ্ছিল, যে আমরা তো ঠিকঠা পৌঁছাতে পারবো তো? মনে হচ্ছিল শাকিল বারবার বলছে স্যার চিন্তিত হবেন না। আমি তো আছি! ফজরের আজানের শব্দ শুনলাম, মনে হলো শাকিল বলছে স্যার নামাজ পড়েনিন। রাস্তার পাশে মসজিদ  দেখে গাড়ি থামিয়ে  আমরা ফজরের  নামাজ পড়তে দাড়ালে  আমার মনে হলো শাকিল কোথায়, শাকিল বললো আমার জন্য চিন্তা করবেন না আমিতো আপনাদের পিছনেই আছি। নামায শেষে আবার আমাদের যাত্রা  শুরু। এরই মধ্যে শাকিলকে বহনকারি গাড়ির পিছনের বামপাশের দু’টি চাকাই পাংচার হলো।আমি ভীষণ চিন্তায় পড়লাম। মহান রব্বুল আলামীনের  সাহায্য চাইলাম, মনে হলো  পথিমধ্যে এক বাজারের গাড়ি মেকানিকের কাছে থামিয়ে চাকা পরিবর্তন করার চেষ্টা করলো কিন্তু এই বৈরী পরিবেশে ব্যবসায়ী তার দোকান খুলতে  চাইলো না। গাড়ির অতিরিক্ত চাকাটিও ভালো ছিল না।

অনেক কষ্ট করে পুরানো চাকাটি লাগিয়ে কোনো মতে আমরা সকাল নয়টার দিকে শহীদ শাকিলের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার সদর থানার ১ নং উত্তর হামসাদী ইউনিয়নের, কাফিলাতলি, ১ নং ওয়ার্ডের আমানুল্লাহ মিয়াজি বাড়ি পৌছালাম। বাড়ির কাছাকাছি যেতেই শত শত মানুষের প্রতিবাদী মিছিলে গ্রামের বন-বনানী কেঁপে  উঠছিল। শাকিলকে একনজর দেখে অনেকেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছিল। সকাল দশটায় স্থানীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে  তার নামাজে জানাযার ব্যবস্থা করা হলো।  অত্র এলাকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বর্গ আলোচনা করলেন, শাকিলের শিক্ষক হিসাবে আমাকেও কিছু বলার সুযোগ দিল। আমি বলেছি, শাকিলের মতো আদর্শবান তরুণের অত্মত্যাগ কখনই বৃথা যাবে না।  

জানাযা শেষে শাকিলের লাশ কাঁধে করে কবরস্থানের দিকে যাচ্ছিলাম, আর মনে হচ্ছিল শাকিল বলছে, স্যার! আপনারা আমার জন্য এত কষ্ট করছেন। শাকিলকে কবরে নামানোর দৃশ্য দেখে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। দু’চোখদিয়ে অঝোরে বৃষ্টিরমতো পানি ঝরছিল। মনে  হচ্ছিল ঐ মায়াবি হাসি দিয়ে শাকিল কি আমার সাথে  এসে আর কথা বলবে না? শাকিলকে মাটি দিয়ে যখন ঢেকে দেয়া হচ্ছিল, তখন মনে হচ্ছিল, শাকিল বলছে, স্যার, চিন্তা করবেন না একদিন দেখা হবে সবার সাথে জান্নাতে। শাকিলকে দাফন করার পর দোয়া করার দায়িত্ব আসে আমার উপর। শাকিলের জন্য ও শাকিলের স্বপ্ন পূরণের জন্য প্রাণভরে  মহান আল্লাহ্র কাছে দোয়া করলাম। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, সকলের জন্য, বিশেষ করে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য, সর্বোপরি বাংলাদেশের শান্তি আর সমৃদ্ধির জন্য দোয়া করলাম। শাকিল তুমি মানুষের হৃদয়ে হাজার বছর বেঁচে থাকবে। তুমি শুধু বাংলাদেশে নয় বিশ্ববাসীর জন্য এক ত্যাগের মহিমা স্থাপন করলে। উল্লেখ্য  যে শাকিল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পড়লেও তার পরিবার অনেকটাই অস্বচ্ছল। তাদের গ্রামে কোন ঘর নেই, ঢাকায় ভাড়া বাসায় থাকে। শাকিল টিউশন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে খরচ চালাতো, সাথে পরিবারকেও সাহায্য করতো। মা’ শারবিন আক্তার দীর্ঘ্যদিন ধরে প্যারালাইজড, শাকিল মা’কে রান্না করে নিজ হাতে খাওয়ায়ে দিতো। তিন বোনের একমাত্র ভাই শাকিল হোসেন।  বড় বোন-বিউটি আক্তার, মেজো বোন- সুইটি আক্তার আর ছোটবোন-নাদিয়া আক্তার। বোনরা সবাই  বিবাহিত ও বোনদের জামাইরা ছোট-খাটো কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। বাবা মোঃ বেলায়েত হোসেন খুদে ব্যবসায়ী। জানাযা নামাজ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সাময়িকভাবে দেয়া আর্থিক অনুদান শাকিলের বাবার হাতে তুলে দিয়েছি আর জড়িয়ে ধরে বলেছি শাকিলের মত সন্তানের বাবা হয়ে আপনি ধন্য। শাকিল আপনাদের জান্নাতের পথ সুগম করে দিয়েছে। শাকিলের মত ছাত্র আমাদের জন্য গর্ব। মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়সহ সমগ্রদেশের মানুষ আপনাদের সাথে সবসময় থাকবে  ইনশাআল্লাহ্। উল্লেখ্য যে, ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারি তাদের একদিনের বেতন শাকিলের পরিবার ও আহতদের জন্য দান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সমাজের সামর্থবান ব্যক্তিরা দেশ-বিদেশ থেকে শাকিলের পরিবারে পাশে দাড়াতে পারেন।      
আমাদের যাত্রা পথে বিশ্ববিদ্যালইয়ের অনেকে ফোন করে আমাদের অবস্থার খবর নিয়েছেন। সারা  রাত এক মুহূর্তের জন্যও ঘুমাইনি। 


বলাযায় সার্বক্ষণিক বিভিন্ন দোয়া ও কুরআন তিলাওয়ত করার চেষ্টা করেছি। দাফন শেষেই আমরা ঢাকায় রওনা হই। আশিকুন্নবী স্যার, আব্দুল আলী ভাই, চালক বাবুল ভাইসহ সকল ছাত্র যারা আমার সাথে গিয়েছেন এবং সার্বিক সহযোগিতা করেছেন তাদেরকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ও দোয়া। আল্লাহ্ সকলকে দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা দান করুন। শাকিলকে রেখে ঢাকায় ফেরার বাস্তবতা না হয় আর একদিন লিখবো।

শিহাব

×