১৯৮৭ থেকে ২০২৪-৩৭ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের চিত্রে এক গভীর অনুরণন লুকিয়ে আছে। ১৯৮৭ সালের নূর হোসেন, যিনি স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বুকের ওপর ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান লিখে রাজপথে প্রাণ দিয়েছেন, তাঁর আত্মত্যাগ ছিল গণতন্ত্রের জন্য এক অমর অঙ্গীকার।
৩৭ বছর পর, ২০২৪ সালে, রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদও বুক পেতে দিয়ে একের পর এক গুলি খেয়ে শহীদ হন ফ্যাসিবাদী শাসকের বিরুদ্ধে। নূর হোসেনের মতো আবু সাঈদও আমাদের জন্য রেখে গেছেন একটি চিরকালীন বার্তা-গণতন্ত্রের জন্য আত্মত্যাগ কখনো বৃথা যায় না, তার মূল্য চিরকাল রক্ষা পাবে। এই দুই শহীদের আত্মদানে ও সাহসিকতায় মিশে রয়েছে আমাদের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য এক অবিরাম সংগ্রামের ইতিহাস।
বাংলাদেশের ইতিহাস এক অবিচ্ছেদ্য সংগ্রামের গল্প, যেখানে প্রতিটি বিজয় শুধুমাত্র সামরিক নয়, বরং জনতার চেতনায় উত্তেজিত এক বিপ্লবের ফলশ্রুতি। এই ইতিহাসে তিনটি নাম অম্লান হয়ে থাকবে-শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, এবং বিএনপির ভারপাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তাঁদের অবদান একে অপরের পরিপূরক, এবং এদের সংগ্রাম ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা পেয়েছি আমাদের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার।
১৯৭১ সালে মেজর জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক অমর নায়ক। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণকে প্রতিরোধ করতে, নিজের জীবন বিপন্ন করে তিনি যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। ২৫ মার্চ রাতেই যখন পাকিস্তানী বাহিনী গণহত্যা শুরু করে, তখন চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তিনি ঘোষণা করেন “উই রিভোল্ট”-এটি শুধু একটি বাক্য ছিল না, এটি ছিল স্বাধীনতার প্রতি গভীর আকাঙ্ক্ষার এক প্রচেষ্টা, একটি সশস্ত্র প্রতিবাদ, যা মুক্তিযুদ্ধের এক নতুন দিগন্ত সূচনা করেছিল।
তিনি ছিলেন শুধু একজন রাষ্ট্রপতি কিংবা সেনাপ্রধান নয়, ছিলেন সেই সময়ের মানুষের প্রত্যাশার প্রতীক, যে তার নেতৃত্বে দেশকে স্বাধীনতা এনে দিতে পারে। মেজর জিয়া ছিলেন একজন কৌশলী নেতা, যিনি যুদ্ধক্ষেত্রে তার অসামান্য নেতৃত্বের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীকে একের পর এক যুদ্ধের জয়ে পরিচালিত করেছেন। কামালপুর, নকশী সীমান্ত, শেরপুর—এসব যুদ্ধের মধ্যে জিয়ার নেতৃত্বের গৌরবগাথা ইতিহাসের পাতা থেকে কখনো মুছে যাবে না। তার এই দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ, এবং নিঃস্বার্থ নেতৃত্ব বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম মাইলফলক হয়ে থাকবে।
মেজর জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এক অবিস্মরণীয় যোদ্ধা, যিনি তাঁর নেতৃত্ব, কৌশলগত বুদ্ধিমত্তা এবং সাহসিকতায় মুক্তিবাহিনীকে গড়ে তুলেছিলেন শক্তিশালী প্রতিরোধ হিসেবে। ১৯৭১ সালে তিনি যে সকল যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তা শুধু শত্রুপক্ষকে পরাজিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, বরং মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এক নতুন উদ্দীপনা এবং সাহসের জন্ম দিয়েছিল। কামালপুর, নকশী, বিলোনিয়া, চিলমারী, টেংরাটিলা, সাগরনালা-এসব যুদ্ধের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছিলেন কীভাবে দৃঢ় সংকল্প, সামরিক কৌশল, এবং দেশপ্রেম একত্রিত হয়ে শত্রু বাহিনীকে পরাজিত করতে পারে।
মেজর জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত জেড ফোর্স ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সংগঠিত সশস্ত্র শক্তি, যা অসংখ্য যুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছিল। কামালপুর সীমান্ত ফাঁড়ির বিরুদ্ধে একাধিক আক্রমণ, ঘাসিপুরের প্রতিরোধ যুদ্ধ, সালুটিকর বিমানবন্দর দখলের অভিযান-এইসব বিজয় তাঁর অপরাজেয় নেতৃত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি যুদ্ধে মেজর জিয়া সেনা-ছাত্র-যুবদের একত্রিত করে তাদের আত্মত্যাগ এবং সাহসিকতায় মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, যা আজও আমাদের ইতিহাসের অন্যতম সেরা অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়।
স্বাধীনতার পর, যখন শেখ মুজিবুর রহমানের একদলীয় শাসনব্যবস্থা দেশকে অন্ধকারে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন মেজর জিয়াউর রহমান আবারও জাতির সামনে এসেছিলেন। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, মানুষের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে আনা—এমন এক নতুন দিশা দেখিয়েছিলেন তিনি। সাম্য মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের ভিত্তিতে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন বাংলাদেশি জাতীয়াতাবাদের। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তার এই মহৎ প্রচেষ্টা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৮১ সালের ৩০ মে, কিছু ঘাতকের হাতে শহীদ হওয়ার পরেও, মেজর জিয়াউর রহমানের প্রেরণা আজও আমাদের হৃদয়ে বেঁচে আছে। তিনি একটি স্বাধীন, গণতান্ত্রিক ও সুষ্ঠু সমাজ গড়ার জন্য যে প্রচেষ্টা করেছিলেন, তার সেই পথই পরবর্তীকালে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া অব্যাহত রেখেছিলেন।
কিন্তু দেশি ও বিদেশি নানান ষড়যন্ত্রের ফলে দেশের গণতন্ত্র বারবার মুখ থুবড়ে পড়েছে, ব্যাহত হয়েছে দেশের উন্নয়ন ও উৎপাদনের স্বাভাবিক ধারা। ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ, যখন লেঃ জেঃ হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন, তখন দেশের গণতন্ত্রে এক অন্ধকার যুগের সূচনা হয়েছিল। এরশাদ সামরিক আইন জারি করে দেশের মানুষের ভোটের অধিকার, স্বাধীনতা, এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে চূর্ণ করে দেন।
এর মধ্যেই জন্ম নেন এক সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব-নূর হোসেন, যিনি নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন যে, গণতন্ত্রের জন্য আত্মত্যাগ কখনও বিফলে যায় না। ১৯৮৭ সালের ১০ই নভেম্বর, স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান তিনি, কিন্তু তাঁর আত্মাহুতি ছিল দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অমূল্য রত্ন।
স্বৈরাচারী শাসন থেকে মুক্তির জন্য দেশের ছাত্র-জনতা যখন এক হয়ে দাঁড়ায়, তখন তার নেতৃত্বে ছিলেন ছাত্রদল। ১৯৯০ সালে, ছাত্রদলের বিশাল কর্মী বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আন্দোলন শুরু করে এবং এক অনন্য সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন ঘটায়। এরশাদ চলে গেলেও, গণতন্ত্রের জন্য যাত্রা এখানেই থেমে যায়নি। ১৯৯১ সালে, বেগম খালেদা জিয়া প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, এবং তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ আবারও গণতান্ত্রিক পথে এগিয়ে যায়। খালেদা জিয়া শুধুমাত্র এক রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন দেশের মানুষের আশা, দৃঢ়তার এবং সমৃদ্ধির প্রতীক। তাঁর সাহসিকতা এবং অটল নেতৃত্বে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন শুরু করেছিল, যা আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এক নতুন প্রেরণা সৃষ্টি করেছিল।
২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, যা ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়েছে, সেই সংগ্রাম রুপ নেয় গণ মানুষের আন্দোলনে। এই আন্দোলনে অংশ ছাত্র থেকে শুরু করে শ্রমিক কৃষক শিক্ষকসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষ। এই আন্দোলনে একদম শক্তভাবে সাহস, শক্তি, জনবলের যোগান দেয় বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদ বিরোধী সকল রাজনৈতিক শক্তি। এই সকল রাজনৈতিক শক্তি এক করে হাসিনার পতনের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এই ফ্যাসিবাদ পতনের আরো এক বছর আগেই তিনি হাসিনার পতনের এক দফা দাবী তুলে রেখেছিলেন।
২০২৩ সালের ১৩ জুলাই, তারেক রহমান তাঁর ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা’ রুপরেখা উপস্থাপন করে বাংলাদেশের রাজনীতির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। এই ৩১ দফা শুধুমাত্র রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাবনা নয়, বরং এটি একটি সংকল্প, এক চূড়ান্ত লক্ষ্য—গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার এক দৃঢ় অঙ্গীকার। তারেক রহমানের নেতৃত্বে, আমরা ফিরে পেতে পারি একটি মানবিক, বৈষম্যহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ, যেখানে সকল নাগরিকের অধিকার সুরক্ষিত হবে। তার সাহস, নিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় আজকে বাংলাদেশে একটা নতুন আশা জন্মেছে, যা এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করবে।
দেশে না থাকলেও তারেক রহমান তাঁর রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়ে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি ১৬ বছর ধরে, বিদেশ বিভূঁইয়ে থেকেও, ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন এবং সকল নেতাকর্মীকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছেন। শত বাধা, ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও বিএনপির সংগঠন এক নতুন শক্তি পেয়েছে, যা দেশের রাজনৈতিক ভূচিত্রে একটি নতুন বিপ্লবের ইঙ্গিত দেয়। বিএনপির এখন একজোট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, সংগ্রামের পথে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি তৈরি হয়েছে এবং এই ঐক্যই দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে এক অদম্য শক্তির প্রতীক হয়ে উঠেছে।
এই তিন ব্যক্তিত্ব-মেজর জিয়াউর রহমান, বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান—বাংলাদেশের ইতিহাসের অমর অংশ। তাঁরা একে অপরের পরিপূরক হয়ে আমাদের জাতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। একদিকে, শহীদ জিয়া স্বাধীনতার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ দিয়েছেন, অন্যদিকে, বেগম খালেদা জিয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন এবং তারেক রহমান সেই গণতন্ত্রের পুনর্গঠন করেছেন। তাঁদের সকলের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ আমাদের আজকের বাংলাদেশ গড়ার প্রেরণা।
দেশের মানুষ এখন আরো একটি বিজয় দেখার প্রত্যাশায়। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষ ভোটের অধিকার থেকে। অন্তবর্তী সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে দ্রুত নির্বাচন আয়োজন করলে বাংলাদেশের মানুষ পুনরায় গণতন্ত্রের স্বাদ পাবে। আর সেই ভোটের মাধ্যমে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসবে বলেই সকলের বিশ্বাস।
লেখক: মাহবুব নাহিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
এসআর