বাংলাদেশ বলে চিৎকার করলে মনে হয় সমস্ত আকাশ বাতাস ভরে গেছে প্রাণের স্পন্দনে, আর যখন সেই শ্লোগান হয়ে যায় “সবার আগে বাংলাদেশ”, তখন রক্তের ভেতর আগুনের স্রোত বইতে থাকে, হৃদয়ে এক তীব্র দোলা লাগে। ১৬ বছরের অন্ধকার, নিপীড়ন আর ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের পর এ বিজয় দিবস যেন আরেকটি মুক্তির উচ্ছ্বাস; এ এক নতুন স্বপ্নের সময়, যেখানে ঘোর লাগা অনুরণনে কাঁপে অন্তরের অন্তসত্ত্বা, বিজয়ের লাল-সবুজ পতাকা আবারও জানান দেয় আমাদের অহংকার, আমাদের আত্মপরিচয়। ১৯৭১ আমাদের জন্মের কাল, আর ২০২৪ আমাদের নতুন পথচলার প্রতিজ্ঞা—এক অমলিন, দুর্বার বাংলাদেশ গড়ার শপথ।
১৯৭১-এর চূড়ান্ত বিজয় আমাদের শিকড়, আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি—যা কখনোই ভুলে যাওয়ার নয়; সেই বিজয়কে ধারণ করেই নতুন স্বাধীনতা পাওয়া প্রিয় স্বদেশ বিজয় দিবসের বিকেলে মেতে উঠেছিল এক মোহনীয় উৎসবে, যা কল্পনাকেও হার মানায়। “সবার আগে বাংলাদেশ” ব্যানারে মানিক মিয়া এভিনিউ রূপ নিয়েছিল আবেগ আর গৌরবের মহাসমুদ্রে, যেখানে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এত শিল্পী একত্রে গেয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের গান, বিজয়ের গান। উন্মুক্ত আকাশের নিচে সেই কনসার্টে ছিল দেশের সর্বকালের সেরা জনসমাগম, যেখানে কণ্ঠে কণ্ঠ মেলানো প্রতিটি মানুষ যেন হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ নিজেই। সে মুহূর্তে মানিক মিয়া এভিনিউ আর শুধু একটি সড়ক ছিল না, তা হয়ে গিয়েছিল বিজয়ী বাংলাদেশির আত্মার মিলনস্থল—এক টুকরো বাংলাদেশ।
জেমস, শিরোনামহীন, সোলস, ডিফারেন্ট টাচদের মতো ঐতিহাসিক ব্যান্ডের সাথে দেশের সেরা শিল্পীরা যখন এক মঞ্চে দাঁড়ালেন, তখন তা যেন বিজয়ের নতুন গান হয়ে আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। তরুণদের হৃদয় মাতানো ইমরান, কণা, জেফারের অসাধারণ পরিবেশনা ছিল মোহময়, কিন্তু সবচেয়ে হৃদয়ছোঁয়া মুহূর্ত ছিল আসিফ আকবর, মনির খান, কনক চাপা আর বেবী নাজনিনের মঞ্চে ওঠা। এই প্রজন্মের কাছে তাঁরা শুধু শিল্পী নন, তাঁরা সংগ্রাম আর ভালোবাসার এক অনন্য প্রতীক।
ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের ১৬ বছরের শাসনে তাঁদের ওপর নেমে এসেছিল অমানবিক নির্যাতন। গান গাওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, কনসার্টে নিষেধাজ্ঞা ছিল, টেলিভিশনের পর্দায় তাঁদের মুখ দেখা যেত না। তবুও মানুষের ভালোবাসা, অন্তরের টান যাদের পাশে থাকে, তাঁদের কে আর থামাতে পারে?
সেই অন্ধকার সময় পেরিয়ে ১৬ বছর পর বিজয় দিবসের বিকেলে মুক্ত আকাশের নিচে এমন মোহনীয় এক কনসার্টে তাঁরা গাইলেন শুধু বাংলাদেশের গান। তাঁদের কণ্ঠে শুধু সুরই ঝরেনি, ঝরেছে জমে থাকা আবেগ, চোখে ছিল বিজয়ের অশ্রু আর ঠোঁটে ছিল কথার ঝংকার—এ বিজয় সবার, এ উৎসব দলমত নির্বিশেষে সব বাংলাদেশি মানুষের। কোনো ব্যক্তি পূজা বা দলীয় ভেদাভেদ নয়, বরং সারাদেশের মানুষকে নিয়ে এমন বিজয় উদযাপনই যেন প্রকৃত স্বাধীনতার গান। মানিক মিয়া এভিনিউ যেন রূপ নিয়েছিল বাংলাদেশের হৃদয়ে, যেখানে অতীতের কষ্ট ভুলে মানুষ আনন্দে জেগে উঠেছিল, গেয়ে উঠেছিল—“সবার আগে বাংলাদেশ!”
তারেক রহমানের উদ্যোগে এবং বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীর আহ্বানে অনুষ্ঠিত “সবার আগে বাংলাদেশ” কনসার্ট যেন আমাদের আবেগ, ভালোবাসা আর ঐক্যের এক ঐতিহাসিক সাক্ষী হয়ে উঠল। এ কনসার্ট ছিল দলমতের ঊর্ধ্বে, একটি সার্বজনীন প্ল্যাটফর্ম, যেখানে একসঙ্গে মিশে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বাধীনতার গান আর ভবিষ্যতের আশার বাণী। জনতার ঢল সামলাতে আয়োজকদের হিমশিম খেতে হলেও এই বিপুল জনসমাগম যেন একটাই বার্তা দিয়েছিল—বাংলার মানুষ জেগে উঠেছে, তারা ভালোবাসে তাদের দেশকে, তাদের পতাকাকে। শিল্পীদের কণ্ঠে গান, জনতার কণ্ঠে শ্লোগান—সব মিলিয়ে মানিক মিয়া এভিনিউ হয়ে উঠেছিল পুরো বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।
কনসার্টের সবচেয়ে হৃদয়ছোঁয়া মুহূর্ত ছিল সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর দৃপ্ত কণ্ঠে শ্লোগান—“সবার আগে বাংলাদেশ”। তাঁর কণ্ঠে যেন বাঙালির সমস্ত বেদনা, সমস্ত সংগ্রাম আর প্রতিরোধের চেতনা এক হয়ে গর্জে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল, মঞ্চের সামনে জমায়েত হওয়া লাখো মানুষই শুধু নয়, বরং সারা বাংলাদেশ একসঙ্গে গলা মিলিয়ে চিৎকার করছে, হাত উঁচিয়ে শপথ নিচ্ছে—“আমরা বেঁচে থাকব বাংলাদেশের জন্য, লড়ব বাংলাদেশের জন্য।”
এমন ঐক্য, এমন আবেগের বিস্ফোরণ দেখলে যে কেউই বিশ্বাস করবে—এই জনগণ কোনো অপশক্তির সামনে মাথা নত করবে না। একটি দেশ, একটি পতাকা আর এক অভিন্ন চেতনা নিয়ে এমন ঐক্যবদ্ধ শক্তি নিয়ে এগিয়ে চললেই আমরা ভবিষ্যতের সব বাধা, সব অন্ধকার রুখে দিতে পারব।
লেখক: মাহবুব নাহিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
এসআর