সুজলা-সুফলা, শস্যশ্যামল, সবুজ আবহমান বাংলা উৎপাদনশীলতার অনন্য লীলাক্ষেত্র। স্বদেশী কবি-সাহিত্যিক আর ভিনদেশী পরিব্রাজকদের বন্দনায় তা আরও হয়েছে সৃজন ক্ষমতার চিরায়ত শৌর্যে। সুশোভিত উর্বর পলিমাটির যে অবারিত শস্যভাণ্ডার তাও বঙ্গভূমির এক অবারিত বৈভবের পরম নির্মাল্য। দ্বিজেন্দ্রলালের রচনায় আবহমান সেই সম্ভার আরও যেন মহীয়ান হয়ে বাংলা ও বাঙালিকে গৌরবে, সম্মানে ঐশ্বর্যময় করে তুলেছে। ধনে ধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদেরই বসুন্ধরা। চিরস্থায়ী কাব্য বচনে কবির স্বমহিমায় প্রকাশিত হলেও বঙ্গভূমির সর্বজনীন প্রেক্ষাপটের অবদানও গুরুত্বপূর্ণ, কালজয়ী। সপ্তদশ শতকে ফরাসি পরিব্রাজক বার্নিয়ার বিমুগ্ধচিত্তে যে বন্দনায় আপ্লুত তা কখনোই বিলুপ্ত হয়নি। তিনি বলেছিলেন- এই দেশে প্রবেশের বহু পথ থাকলেও বেরোবার রাস্তা খুঁজে পাওয়া কঠিন।
সার্থক জনম আমার। এ দেশের মাটির অন্নজলে নিজেকে আপ্লুত করা। সোনার বাংলার এমন উর্বর পলিমাটি আজ আর আগের মতো স্নিগ্ধতায় সুশোভিত থাকেনি। শুধু তাই নয়, উর্বর পলিমাটি তার বিরামহীন উৎপাদনশীলতায় ব্যবচ্ছেদ ঘটানো যেন আধুনিক শিল্প সভ্যতার অমোঘ নিয়ম। নানা কারণে জমির ফলনশক্তি হ্রাস পাওয়া প্রাকৃতিক নিয়মে হলেও মানুষ ও সভ্যতার দুঃসহ এক পালাক্রম। সভ্যতার ইতিহাসে এগিয়ে যাওয়া কিংবা বিবর্তনে সৃষ্টির সেরা মানুষের অবদান অপরিহার্য, অলঙ্ঘনীয় এবং এগিয়ে চলার পরম শক্তিময়তাও বটে। আবার বিপরীত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় হরেক দুঃসময় যখন ভাঙনের খেলায় উন্মত্ত হয়, তাও এই বরেন্দ্র অঞ্চলের অবধারিত এক সর্বনাশা বিপর্যয়। কোনো এক সময় সারা দুনিয়া প্রত্যক্ষ করে পাল্টা এক অসহনীয় পরিবেশ, পরিস্থিতি, যা আগে কল্পনাও করা যায়নি। চিরায়ত সবুজ বাংলা এ সময়ে অনুভব করছে ঋতু বৈচিত্র্যের এই বর্ণিল অঞ্চলটি আগের মতো গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্তকে দৃশ্যমান করতে বারবার পিছু হটছে। শীত, বসন্তও আগের মতো প্রকৃতি সহায়ক ঋতু হিসেবে অন্য আবহ তৈরিতে যেন ব্যস্ত। বর্ষণস্নাত বাংলা বর্ষাকালের এক অবিমিশ্র বারিধারা। জলসিঞ্চিত বর্ষা যখন চিরায়ত বৈভবকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তীব্র দাবদাহে দগ্ধ হয়, সেটাও প্রকৃতিকে নয়-ছয় করার দুরবস্থা। বৈশাখ মাসের কালবৈশাখীর উন্মত্ত ঝড় আর বাদলের হাওয়ায় প্রকৃতি যে ধ্বংসাত্মক রূপ নেয়, সেটা পরিচিত এক বিক্ষুব্ধ প্রতিবেশ। তেমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করেই বাংলার বর্ষবরণের যে আয়োজন তাও এই অঞ্চলের অনন্য বাতাবরণ। সব মিলিয়ে সুশীতল, নাতিশিতোষ্ণ আবহমান বাংলা নিয়ত যে দাবদাহের অনুষঙ্গ হচ্ছে, সেটা প্রকৃতির সহজাত প্রতিবেশকে নানামাত্রিক হুমকির মুখে আবর্তিত করছে। ষড়ঋতু আর আগের প্রতিবেশ পরিস্থিতিকে দৃশ্যমান করতে ব্যর্থ হচ্ছে ক্রমাগত। সঙ্গত কারণেই নিসর্গ বিজ্ঞানীর সচেতন দায়বদ্ধতায় পরিবেশের ভারসাম্যের বিপন্নতাকে অনুসন্ধানে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশে নিয়োজিত হওয়াও বর্তমান পরিবেশ বিরূপতার মূল শিকড় উন্মোচন করা।
সহজাত সবুজ বাংলা কেন যে বিপরীত প্রতিবেশ পরিস্থিতিতে নাকাল হচ্ছে, তা এক লাগাতার প্রযুক্তির নিরবচ্ছিন্ন দাহ্য পদার্থের বিকিরণ। বিভিন্ন গবেষণায় প্রতীয়মান হচ্ছে উর্বর পলিমাটিও ক্রমান্বয়ে তার শক্তি হারানোর অসময়ে পতিত হচ্ছে। সম্প্রতি বিআইডিএসের এক গবেষণা প্রতিবেদনে প্রতীয়মান হয়, সময়ের গতিতে কমছে জমির উর্বরতা। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হ্রাস পাচ্ছে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা, যা কৃষিনির্ভর উর্বর পলিমাটির বরেন্দ্র অঞ্চলের জন্য এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। জমির উর্বরতা কমার সঙ্গে অবিচ্ছিন্নতা থাকে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য নির্ধারণই শুধু নয়, কৃষি অর্থনীতিরও বিপাকে পড়ার দুঃসহ চিত্র। চালের উৎপাদন খরচও বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে কৃষকের মাথায় হাত। কারণ, তাদের লভ্যাংশে দৃশ্যমান হচ্ছে আগের তুলনায় ঘাটতি। সঙ্গত কারণেই ধান চাষেও আসছে ক্রমাগত বিঘ্নতা। উৎপাদন, ব্যয় খরচ আর মুনাফায় যদি সমন্বয় অবস্থায় না থাকে বিঘ্নতা তৈরি করে সেখানে। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশ খাদ্যপণ্য উৎপাদনে হিমশিম খাওয়ার দুরবস্থায় চলে যেতে সময় নেবে না। অধিক খরচে যদি উৎপাদন ব্যয় বাড়তির দিকে যায় তা হলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে যেতে পিছু হটে না। এমনিতে বাজার সিন্ডিকেটের বলয়ে সাধারণ গ্রাহক অসহনীয় দুর্বিপাকে পড়ে, যা খোদ কৃষক এবং ক্রেতার মাঝে যে অভেদ্য প্রাচীর তৈরি হয় সেটার কোনো কূল-কিনারা পাওয়া আজ অবধি করা যায়নি। প্রতি বছর জমির উর্বরতা ও ফলন শক্তির অবক্ষয় ভূমিনির্ভর সমাজ ব্যবস্থার আনুকূল্যে থাকে না।
মূলত জমির উৎপাদন শক্তির নিয়ামক দক্ষ মানবসম্পদ। তবে জমিতে সার, কীটনাশক ছাড়াও মাটির নিচে অত্যধিক জমাটবদ্ধ পানির চাপ উর্বরা শক্তিকে যে মাত্রায় বিঘ্নতার রুদ্ধ জালে আবদ্ধ করে তাও প্রকৃতি, পরিবেশের নির্মমতা। সেখানে যদি ক্ষমতাবান মানুষের নয়-ছয় অবস্থায় পলিমাটির সহজাত শক্তি কোথায় নামবে তা ধারণা করা মুশকিল। শিল্প বিপ্লবের কার্বন নিঃসরণ প্রকৃতিকে যে মাত্রায় ভারসাম্যহীনতায় আবর্তিত করছে তাও প্রযুক্তির নিদারুণ অপব্যবহার এবং মানুষের নানামাত্রিক অপরিণামদর্শিতার বিপরীত প্রতিক্রিয়া। উৎপাদন খরচ বাড়ার অসহনীয় চিত্রে কৃষক থেকে গ্রাহক কেউ স্বস্তিতে নেই। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন উৎপাদনে খোদ কৃষকই। তারা কৃষি কাজে যা ব্যয় করছেন তার যথার্থ মূল্য না পাওয়াও এক কঠিন যাত্রাপথ। তার ওপর নিজেদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে মূল্যবান শ্রমশক্তির বিনিয়োগ তাও ধর্তব্যের মধ্যেই আসছে না। মূল্য নির্ধারণ তো কঠিন এক অদম্য যাত্রাপথ। কৃষকরা উদয়াস্ত পরিশ্রমে কৃষি ভূমিতে যে চাষাবাদে নিযুক্ত হন সেখানে কত কিছু যে হিসাব-নিকাষের বাইরে থেকে যায় তাও বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনের নেতিবাচক চিহ্ন। সেখানে জোর দেওয়া হচ্ছে ভূমির স্বাস্থ্যসচেতনতায় অনেক বেশি নজর দেওয়া। ধানচাষিরা পড়েছেন অব্যাহত এক অর্থনৈতিক সংকটে। শ্রম যে কোনো মানুষের স্বাভাবিক এক অদম্য শক্তি, যা কোনো উৎপাদন ব্যবস্থার মূল হাতিয়ার। আধুনিক শ্রম প্রযুক্তি কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় যতই অবদান রাখুক কৃষকের কায়িক শ্রমের ব্যত্যয়ে কোনো কিছুই মান্যতা পায় না। চাষাবাদ প্রক্রিয়ায়ও এমন শ্রমশক্তি উৎপাদনের অতি আবশ্যক হাতিয়ার, যা নাকি নিজের মূল্যের চাইতেও অধিক মূল্য তৈরি করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাজ গবেষক কার্ল মার্কস শ্রমিকের মূল্য নির্ধারণ করতে গিয়ে তাদের শ্রমশক্তিকে যেভাবে বিবেচনায় এনেছেন তা আজও সংশ্লিষ্টদের জন্য পরম বরমাল্য। শ্রমিকের উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তিই নাকি মালিক শ্রেণির সম্পদ আহরণের মূল নির্ণায়ক। কৃষিভিত্তিক ভূমি ব্যবস্থায় হরেক দুর্বিপাক নিরসনে কিছু নির্দেশনাও সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে উল্লেখ করা হয়। নির্দেশনায় ভূমিতে উৎপাদনশীলতা, প্রযুক্তির দক্ষতা এবং মানবসম্পদের ব্যবহারের ওপর যথার্থ গুরুত্ব বিবেচনায় সহনীয় অবস্থা তৈরির আলোকপাত করা হয়। মাটির উর্বরতা পরীক্ষাও এক জরুরি বিষয়। তেমন প্রকৃতি প্রদত্ত শক্তির অবক্ষয়ে যান্ত্রিক সভ্যতার হরেক উপাদান আবিষ্কার সময়ের অপরিহার্যতা। এই প্রয়োজনে উর্বরতা বাড়াতে সংশ্লিষ্ট কৃষি কাজে নতুন শক্তির সংযুক্তকরণ অতি আবশ্যিক প্রক্রিয়া। নিয়মিত জৈব সার প্রয়োগ উর্বরতা শক্তিকে রক্ষা করার কবচ।
একই জমিতে ভিন্নমাত্রার ফসলের বীজ বপন ভূমিকে তার সহজাত শক্তিতে জিইয়ে থাকতে নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করে। উর্বরা শক্তির সঙ্গে উৎপাদন খরচ কমানো ছাড়া কৃষকদের প্রযুক্তির প্রতি আসক্তিই শুধু নয়, বরং দক্ষতা বাড়ানোও সময়ের অপরিহার্য দাবি। প্রতিবন্ধকতা নিরসনে যথাযথ কার্যক্রম অব্যাহত রাখলে টেকসই উন্নয়নকে হাতের নাগালে পেতে পারেন দেশের অগণিত কৃষক। সংশ্লিষ্ট কৃষি ভূমির যথার্থ রক্ষণাবেক্ষণ জমিকে তার ন্যায্য এবং সহজাত উর্বরতায় অবিচ্ছিন্ন রাখে। আমাদের উৎপাদনশীল কৃষি ভূমি যুগযুগান্তরে এক অবিস্মরণীয় ঐশ্বর্য, যেখানে বীজ মাত্রই জমিতে সোনা ফলে। কিন্তু শিল্প প্রযুক্তির অবাধ প্রসারে সারাবিশ্ব এক গতিময় প্রবাহের অনুগামী হলে আধুনিক মানবসভ্যতা উন্নয়ন বিশ্বের কাতারে মিলে-মিশে একাকার হওয়াও যান্ত্রিক সভ্যতার পরম উৎকর্ষ। কিন্তু তার বিপরীত আবহ উপলব্ধি করতে আরও এক শতক অতিক্রান্ত করা সময়ের অপরিহার্যতা। ততদিনে বিশ্বময় নতুন শিল্প প্রযুক্তি যে অনন্য সোপানে উপনীত হবে তাই যান্ত্রিক সভ্যতার আর এক মহাসন্ধিক্ষণ। তবে তার বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় নিসর্গ স্বাভাবিক স্নিগ্ধতা থেকে ক্রমাগত অপসৃত হওয়ার নির্মমতাও এক সচেতন বৈশ্বিক দায়বদ্ধতা। ক্রমান্বয়ে যখন স্পষ্টতর হতে থাকে যান্ত্রিক সভ্যতার বিপরীত দাহ্য ক্রিয়ায় সহজাত স্নিগ্ধ নিসর্গ তার অবস্থান থেকে চ্যুত তখন থেকেই প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা আওয়াজ তুললেন প্রকৃতি সহায়ক প্রযুক্তি উদ্ভাবন বিপন্ন সময়ের ন্যায্যতা। বারবার সাবধান বাণী আসে প্রকৃতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিতে আর কোনো যন্ত্রসভ্যতা কিংবা আবিষ্কার মান্যতা পায় না। প্রকৃতির সহজাত ন্যায্যতাকে সামাল দিতে তার শান্ত-স্নিগ্ধ প্রতিবেশও জরুরি, যা ঋতু বৈচিত্র্যের আবহকে সুনির্দিষ্ট চেহারায় চিহ্নিত করতে বেগ পাবে না। পরিবেশবাদীদের নিঃশর্ত আন্দোলনও তৈরি হয় ক্ষতিকারক যান্ত্রিক উপাদান উদ্ভাবনের বিপরীতে। মানুষ যখন উন্নয়নের অবারিত কর্মযোগে ধাবিত হতে থাকে তখন শুধু ন্যায়-অন্যায়ই নয়, বরং হিত বিপরীত জ্ঞানও লুপ্ত হতে সময় লাগে না। তেমন দুঃসহ আবিষ্কারের পালাক্রমের শিকার একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক। আজও প্রকৃতি সহায়ক প্রযুক্তি উদ্ভাবন কতখানি অবারিত হয়েছে তাও বৈজ্ঞানিক গবেষকদের কাছে এক যৌক্তিক প্রশ্ন।
লেখক : সাংবাদিক
মোহাম্মদ আলী