ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২ পৌষ ১৪৩১

স্বজনতোষী পুঁজিবাদ

সাজ্জাদুল হাসান

প্রকাশিত: ২০:০১, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪

স্বজনতোষী পুঁজিবাদ

স্বজনতোষী পুঁজিবাদ বা ক্রোনি ক্যাপিটালিজম নিয়ে পৃথিবীজুড়ে হচ্ছে ব্যাপক আলোচনা। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। বিশেষ করে, সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এই নিয়ে হচ্ছে নানা ধরনের আলোচনা, সমালোচনা আর পর্যালোচনা। বিষয়টা আসলে কী? ক্লাসিক্যাল বা প্রচলিত পুঁজিবাদের সঙ্গে এর সম্পর্ক বা তফাত কোথায়? পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে বর্তমানে পুঁজিবাদ তথা মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অবসানের পর পুঁজিবাদ বিশ্বব্যাপী তার অবস্থান সুদৃঢ় করে নেয়। (সূত্র-ইন্টারনেট)।

মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ব্যবসা-

বাণিজ্য সাধারণত অবাধ ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সরকার মূলত থাকে নীতি নির্ধারণ এবং নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়, যাতে কেউ অযাচিতভাবে বাজারকে প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে এবং সুস্থ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হয়। অন্যদিকে,  স্বজনতোষী পুঁজিবাদ এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যেখানে কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সরকারের সঙ্গে যোগসাজশে ব্যবসায় অন্যায্য এবং অনৈতিক সুবিধা ভোগ করে এবং সাধারণ ভোক্তাদের জিম্মি করে মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করে। স্বনামধন্য ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্ট অবৈধ উপায়ে, কারসাজির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনকে ‘রেন্ট সিকিং’ বা ‘অনুপার্জিত আয়’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। কোনো পণ্য বা সেবা পেতে একজন গ্রাহককে এর ন্যায্য মূল্যের ওপর যে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয়, অর্থনীতির ভাষায় একে ‘ইকোনমি কারেন্ট’ বলা হয়।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি, অবকাঠামো, টেলিযোগাযোগ, প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত কেনাকাটাসহ কিছু খাত রয়েছে, যেগুলো সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে থাকে। এসব খাতে ব্যবসা সাধারণত মনোপলি (একচেটিয়া) বা অলিগোপলি ধরনের হয়ে থাকে। সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে আইনের ফাঁকফোকর গলে কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এ ধরনের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। প্রায়ই সরকারের সঙ্গে যোগসাজশে পণ্য বা সেবার দাম বাড়িয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফা লাভের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী,  বিশ্বব্যাপী স্বজনতোষী পুঁজিপতিদের সম্পদের মূল্য প্রায় ৩ লাখ কোটি মার্কিন ডলার, যা বৈশ্বিক জিডিপির ৩ শতাংশ। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এ সম্পদ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৯৮ সালে এই সম্পদের পরিমাণ ছিল বৈশ্বিক জিডিপির ১ শতাংশ। আর এই সম্পদ বৃদ্ধির ৬৫ শতাংশই ঘটেছে রাশিয়া, চীন, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ প্রণীত ২০২৩ স্বজনতোষী পুঁজিবাদ সূচকে শীর্ষস্থানে আছে রাশিয়া; দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানে আছে যথাক্রমে চেকপ্রজাতন্ত্র এবং মালয়েশিয়া। আশ্চর্যজনকভাবে এই তালিকার চতুর্থ দেশ সিঙ্গাপুর, যেটি পৃথিবীর অন্যতম একটি কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে সুবিদিত। উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে ভারতের অবস্থান সবার ওপরে, তালিকায় দেশটির স্থান সাত নম্বরে।
স্বৈরতান্ত্রিক দেশগুলোতে স্বজনতোষী পুঁজিবাদ লক্ষণীয়ভাবে দৃশ্যমান থাকে। কেননা, ওই সমস্ত দেশে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির যথেষ্ট ঘাটতি থাকে। তবে আশ্চর্যের বিষয়, গণতান্ত্রিক এবং কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে সুপরিচিত সুইজারল্যান্ড (৮), যুক্তরাজ্য (১২), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১৬), জাপান (১৭) এবং জার্মানির (১৮) মতো দেশও রয়েছে এই তালিকায়।
স্বজনতোষী পুঁজিবাদের কারণে একটি দেশের অর্থনীতি, সমাজ এবং রাজনীতি গভীরভাবে প্রভাবিত হতে পারে। এই দিকটা নিয়ে খানিক আলোকপাত করা যাক।
পক্ষপাতিত্ব : প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং উচ্চপদস্থ আমলারা অনৈতিক লেনদেনের বিনিময়ে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা প্রদান করে থাকে। উভয়পক্ষই এতে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের সাধারণ মানুষ।
অসম এবং পক্ষপাতদুষ্ট আইন : স্বার্থান্বেষী মহল তাদের গোষ্ঠী স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করে এমন সব আইন বা নীতি প্রণয়ন করে, যা গণস্বার্থবিরোধী হয়।
দুর্নীতি : ঘুষ, অবৈধ লেনদেন ইত্যাদি অনৈতিক কার্যকলাপের কারণে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতি বাধাগ্রস্ত হয়। পরিণতিতে একটি অকার্যকর এবং বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
বাজারে প্রবেশে বাধা- সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সরকারের সহযোগিতায় এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করে, যেখানে নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য বাজারে প্রবেশ বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। এতে করে প্রতিযোগিতা  হ্রাস পায় এবং দেশের অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বৈষম্য : সমাজে সম্পদ এবং আয়ের বৈষম্য অত্যধিক হারে বেড়ে যায়। কেননা, একটি বিশেষ গোষ্ঠীর কাছে সম্পদ পুঞ্জীভূত হয় এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ন্যায্য অধিকার এবং সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।
অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা : দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেহেতু গোষ্ঠীস্বার্থে পরিচালিত হয়, স্বাভাবিক কারণে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়তে পারে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে।
সামাজিক অসন্তোষ : স্বজনতোষী পুঁজিবাদ সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। কারণ, তারা উপলব্ধি করে যে, কিছু মানুষ রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অযৌক্তিক সুবিধা পাচ্ছে। আর বঞ্চিত হচ্ছে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী।
পৃথিবীর অনেক দেশ স্বজনতোষী পুঁজিবাদের কারণে কাক্সিক্ষত অর্থনৈতিক উন্নতি সাধনে ব্যর্থ হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য অবনমন হয়েছে। এক্ষেত্রে ভেনিজুয়েলা অন্যতম দৃষ্টান্ত হতে পারে। জ্বালানি তেলের বিশাল মজুতের কারণে ভেনিজুয়েলা লাতিন আমেরিকার অন্যতম একটি ধনী দেশ ছিল। দুঃখজনকভাবে সাম্প্রতিক সময়ে দেশটি নাটকীয় অর্থনৈতিক পতনের সম্মুখীন হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, দেশটির সাবেক রাষ্ট্রপতি হুগো শ্যাভেজ এবং তার উত্তরসূরি নিকোলাস মাদুরোর শাসনামলে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি আনুগত্যকে সরকারি চুক্তি এবং ব্যবসা লাভের অন্যতম শর্ত বা যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগগুলো, বিশেষত তেলসেক্টর, এমনভাবে পরিচালিত হয়েছিল, যা শাসক দলের মিত্রদের অনুকূলে ছিল। ফলে ব্যাপক দুর্নীতি হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, স্বজনতোষী পুঁজিবাদ থেকে মুক্তির উপায় কী? বর্ণিত কিছু পদক্ষেপ কার্যকরী হতে পারে:
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা : সরকারের উচিত ব্যবসায়িক চুক্তি ও প্রকল্পের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, যাতে সকল ব্যবসায়ী সমান সুযোগ পায়।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর আইন : দুর্নীতির অভিযোগের বিরুদ্ধে তদন্ত এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করা অত্যন্ত জরুরি। সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে অবৈধ সম্পর্কের বিরুদ্ধে সরকারকে হতে হবে কঠোর।
উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা : নতুন ব্যবসায়ীদের জন্য বাজারে প্রবেশের সুযোগ বাড়াতে প্রতিযোগিতামূলক নীতির প্রয়োগ করা, যাতে সমান সুযোগ নিশ্চিত হয়।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি : সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। যাতে তারা স্বজনতোষী পুঁজিবাদের প্রভাব সম্পর্কে অবগত হয় এবং এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে পারে।
স্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা : একটি স্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা উচিত, যা ব্যবসায়িক কার্যক্রমের ওপর নজরদারি করবে এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করবে।
স্বজনতোষী পুঁজিবাদ নিঃসন্দেহে একটি গুরুতর সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান না হলে দেশের অর্থনীতি ও সমাজের স্থিতিশীলতা বিপন্ন হতে পারে। একটি ন্যায়সঙ্গত এবং সুষ্ঠু ব্যবসায়িক পরিবেশ তৈরি করার মাধ্যমে স্বজনতোষী পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
লেখক : একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত

মোহাম্মদ আলী

×