নানা কারণে কৃষি খাতে কাজের আগ্রহ কমছে মানুষের। কিন্তু মানুষ কর্মীদের অভাব পুষিয়ে দিতে পারে রোবট। এরই মধ্যে অনেক রোবট কৃষক কৃষিকাজে সফলতাও দেখিয়েছে। চিকিৎসা, শিল্প থেকে শুরু করে রেস্তোরাঁ, বসত বাড়ির পর এবার কৃষি ও মৎস্য শিল্পের জন্য রোবট তৈরি করেছে উন্নত দেশগুলো। শীর্ষে আছে জাপান। উচ্চ ফলনশীল কৃষিপণ্য ও লোকবলের চাহিদা কমাতে নতুন এই পরিকল্পনা নিয়েছে দেশটি। জাপানে কৃষকদের গড় বয়স ৬৪ বছর। বয়স্ক কৃষকদের শ্রম লাঘবের জন্য তারা নির্মাণ করে চলেছে কৃষক রোবট। বিগত বছরগুলোতে তারা বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭ ধরনের রোবট তৈরির জন্য ১২০ কোটি জাপানি মুদ্রা বরাদ্দ দিয়েছে। এই লক্ষ্যে গবেষকরা অর্ধেকের বেশি রোবট আবিষ্কার করেন কৃষি ও মৎস্য খাতের উন্নয়নে। সম্প্রতি কৃষিতে রোবটের ব্যবহারকে বৈপ্লবিক জয় আখ্যা দিয়ে জাপানের ওকায়েমা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইচি ইয়াগি বলেছেন যে, সাধারণত একজন কৃষক দুই হাতে কাজ করতে পারে এবং মাত্র সাত-আট কেজি ওজন বহন করতে পারে। কিন্তু তাদের উদ্ভাবিত কিছু কিছু রোবট মানুষের বুকে কিংবা কনুইয়ে বাঁধা থাকে, যার মাধ্যমে সে ২০ কেজির বেশি কমলার ঝুড়ি বহন করতে পারে। এছাড়া আগাছা বাছাইয়ের জন্যও কিছু রোবট আবিষ্কার করা হয়েছে, যা দিয়ে মাত্র এক ঘণ্টায় প্রায় ৮০০ বর্গমিটার ফসলি জমি পরিষ্কার করা সম্ভব হচ্ছে।
বিশ্বে এখন ৮০০ কোটি মানুষের আহার জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন কৃষক। জাতিসংঘের অনুমান, ২০৫০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা বেড়ে হবে প্রায় ৯ দশমিক ৭ বিলিয়ন। এত মানুষের খাদ্য উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়বে কৃষকসমাজ। আবার জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে কৃষি খাত। সময়ের প্রয়োজনে তাই টেকসই চাষাবাদ করা অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু কৃষিতে তরুণদের আগ্রহ নেই বললেই চলে। সুতরাং ভবিষ্যতে জনবল সংকটে পড়তে পারে এ খাত। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে টেক জায়ান্টদের। তারা শুধু খাদ্য সমস্যা সমাধানই নয়, তরুণদের সম্পৃক্ত করে কৃষিব্যবস্থাকে উচ্চপ্রযুক্তির ব্যবসায় কিভাবে পরিণত করা যায় সেদিকে এগোচ্ছেন। নেদারল্যান্ডসের ওয়াজেনিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্ম টেকনোলজি গ্রুপের প্রধান এলডার্ট ভ্যান হেন্টেন বলেন, খুব কম মানুষই ভোরে ঘুম থেকে উঠে কৃষিজমিতে যেতে চান। তবে কৃষি প্রযুক্তির আবির্ভাব ঘটলে এ অবস্থার পরিবর্তন হবে। এমনকি কৃষি ছেড়ে অন্য ব্যবসায় চলে যাওয়া বিনিয়োগকারীরাও ফিরে আসবেন এ পেশায়। ইতোমধ্যে রোবটিক ফার্মিং নিয়ে ইউরোপে নানা প্রকল্প চালু হয়েছে। এসব রোবটের দক্ষতা, উৎপাদনশীলতা এবং স্থায়িত্ব বৃদ্ধি করে বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে কৃষি কাজকে আরও উল্লেখযোগ্যভাবে রূপান্তরিত করার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। যেমন- ১. স্বয়ংক্রিয় রোপণ এবং বীজ বপন। যথার্থ রোপণ- রোবট সর্বোত্তম গভীরতা এবং ফাঁকে বীজ রোপণ করতে পারে, ভালো ফসলের ফলন নিশ্চিত করতে এবং বীজের অপচয় কমাতে পারে। ২. পরিবর্তনশীল হার বীজ- উন্নত রোবট মাটির অবস্থার ওপর ভিত্তি করে রোপণের হার সামঞ্জস্য করতে পারে, সম্পদের ব্যবহার অনুকূল করে। ৩. ফসল পর্যবেক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনা- ড্রোন এবং সেন্সর- ক্যামেরা এবং সেন্সর দিয়ে সজ্জিত ইউএভি (ড্রোন) ফসলের স্বাস্থ্য নিরীক্ষণ করতে পারে, বৃদ্ধির পর্যায়গুলো মূল্যায়ন করতে পারে এবং বায়বীয় চিত্রের মাধ্যমে কীট বা রোগের প্রাদুর্ভাব শনাক্ত করতে পারে। ৪. ডেটা সংগ্রহ- রোবটগুলো মাটির আর্দ্রতা, তাপমাত্রা এবং পুষ্টির স্তরের তথ্য সংগ্রহ করতে পারে, কৃষকদের সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে। ৫. আগাছা এবং কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ- স্বয়ংক্রিয় আগাছা- রোবটগুলো উচ্চ নির্ভুলতার সঙ্গে আগাছা শনাক্ত করতে এবং অপসারণ করতে পারে, রাসায়নিক ভেষজনাশকের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করতে পারে এবং ফসলের ক্ষতি হ্রাস করতে পারে।
৬. লক্ষ্যযুক্ত কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা- রোবটগুলো সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় কীটনাশক বা জৈবিক নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করতে পারে, রাসায়নিক ব্যবহার এবং পরিবেশগত প্রভাব হ্রাস করতে পারে। ৭. ফসল কাটা- রোবটিক হার্ভেস্টার- স্বয়ংক্রিয় ফসল কাটার মেশিন ফল ও সবজি বাছাই করতে পারে প্রায়ই মানুষের শ্রমিকদের চেয়ে বেশি যত্ন সহকারে, নষ্ট হওয়া এবং শ্রমের খরচ কমিয়ে। যথার্থ ফসল কাটা- রোবট ফসলের পরিপক্বতা শনাক্ত করতে পারে, নিশ্চিত করে যে শুধু পরিপক্ব ফসল কাটা হয়, যা গুণমান এবং বাজার মূল্য উন্নত করতে পারে। ৮. মাটি এবং ফসল বিশ্লেষণ- মাটি পরীক্ষা- সেন্সর দিয়ে সজ্জিত রোবটগুলো পুষ্টির মাত্রা এবং পিএইচ নির্ধারণ করতে মাটি পরীক্ষা করতে পারে, যা কৃষকদের মাটি ব্যবস্থাপনার জন্য কার্যকর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। ৯. ফসলের স্বাস্থ্য মূল্যায়ন- পাতার রং এবং গঠন বিশ্লেষণ করে, রোবট উদ্ভিদের স্বাস্থ্য মূল্যায়ন করতে পারে এবং সমস্যাগুলো প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করতে পারে। ১০. সেচ ব্যবস্থাপনা- স্বয়ংক্রিয় সেচ ব্যবস্থা- রোবটগুলো সঠিকভাবে কখন এবং কোথায় পানি সরবরাহ করে, জল সংরক্ষণ করে এবং ফসলের স্বাস্থ্যের উন্নতি করে সেচকে অপ্টিমাইজ করতে পারে। স্মার্ট সেন্সর- এগুলো রিয়েল-টাইম আবহাওয়া ডেটা এবং মাটির আর্দ্রতার মাত্রার ওপর ভিত্তি করে সেচ সামঞ্জস্য করতে পারে। ১১. প্রাণিসম্পদ ব্যবস্থাপনা- পশু স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ- রোবট স্বাস্থ্য সমস্যা, আচরণ পরিবর্তন এবং খাওয়ানোর ধরনগুলোর জন্য পশুসম্পদ পর্যবেক্ষণ করতে পারে। কৃষকদের মূল্যবান তথ্য প্রদান করে।
অটোমেটেড ফিডিং সিস্টেম- রোবট প্রাণীদের খাদ্য এবং পানি সরবরাহ করতে পারে, সম্পদ বিতরণকে অনুকূল করে এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ যত্ন নিশ্চিত করতে পারে। ১২. লজিস্টিকস এবং সাপ্লাই চেইন- স্বয়ংক্রিয় পরিবহন- রোবটগুলো খামারের মধ্যে পণ্য পরিবহন করতে পারে, শ্রমের খরচ কমাতে পারে এবং পণ্যগুলোকে প্রক্রিয়াকরণের এলাকায় বা স্টোরেজে স্থানান্তর করতে পারে। ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্ট - ড্রোন এবং রোবটগুলো ইনভেন্টরি লেভেল ট্র্যাক করতে এবং সরবরাহ পরিচালনা, অপারেশনাল দক্ষতা বাড়াতে সহায়তা করতে পারে।
বর্তমান চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এবং নিকটবর্তী পঞ্চম শিল্প বিপ্লব উপযোগী ভবিষ্যতের কৃষি রোবট কেমন হতে পারে, তার ধারণাও দিয়ে যাচ্ছে বর্তমান প্রযুক্তিবিদ ও টেক জায়ান্টরা। ধারণাগুলো হলো- ১. এআই এবং মেশিন লার্নিংয়ের সঙ্গে একীকরণ- এআই প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে রোবটগুলো ডেটা থেকে শেখা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান পারদর্শী হয়ে উঠবে। কৃষিতে তাদের উপযোগিতা আরও বাড়িয়ে তুলবে। ২. স্থায়িত্ব এবং সম্পদের দক্ষতা- রোবট টেকসই কৃষি অনুশীলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, যেমন- নির্ভুল কৃষি, যা সম্পদের ব্যবহার এবং পরিবেশগত প্রভাবকে হ্রাস করে। ৩. শ্রমের ঘাটতি মোকাবিলা করা- কৃষিতে চলমান শ্রম ঘাটতির সঙ্গে রোবট শূন্যস্থান পূরণ করতে সাহায্য করতে পারে, যাতে খাদ্য উৎপাদন সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং দক্ষ থাকে। ৪. গ্রামীণ উন্নয়ন- রোবটিক প্রযুক্তি গ্রহণ গ্রামীণ অর্থনীতিকে উদ্দীপিত করতে পারে, প্রযুক্তি রক্ষণাবেক্ষণ এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারে। ৫. বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা- বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রোবটগুলো খাদ্য উৎপাদন দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সম্পদের সীমাবদ্ধতার মুখে খাদ্য নিরাপত্তায় অবদান রাখবে। পরিশেষে, কৃষিকাজ এবং কৃষিতে রোবটের ব্যবহার বর্ধিত দক্ষতা এবং শ্রমের ব্যয় হ্রাস থেকে উন্নত স্থায়িত্ব এবং ফসলের গুণমান পর্যন্ত অসংখ্য সুবিধা প্রদান করতে পারে। রোবটগুলো চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করতে পারে, কখনো বিরতির প্রয়োজন হয় না, যা উৎপাদনশীলতাকে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করে। পাশাপাশি শ্রমের ঘাটতি কৃষিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। রোবট সে স্থানটি পূরণ করতে সাহায্য করবে।
লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মোহাম্মদ আলী