শিক্ষা মানব সভ্যতার অপরিহার্য অংশ। শিক্ষার দ্বারা মানুষ তার আচরণগত পরিবর্তন সাধন করে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ডিসেম্বর বিজয়ের মাস- দীর্ঘ ২৪ বছরের শোষণের শৃঙ্খল ভেঙে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাঙালি জাতি চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে, হাসিল করে স্বার্ধীনতা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বিজয়ের ৫৪ বছরে এসেও আমরা কাঙ্ক্ষিত শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। এখন প্রশ্ন হলো "কী সেই কাঙ্ক্ষিত শিক্ষাব্যবস্থা যা আমরা বাস্তবায়ন করতে চাই"। আমরা এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা চাই, যা সমাজের সর্বস্তরের জনগণের জন্য সহজলভ্য, বৈষম্যহীন, বিজ্ঞানমনস্ক ও অবশ্যই মুখস্থনির্ভরতামুক্ত অর্থাৎ সৃজনশীল, যা আধুনিক বিশ্বের নিত্যনৈমিত্তিক চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলায় আমাদের শিক্ষার্থীদের সহযোগী হবে। যা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক প্ল্যাটফর্মে আমাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। আমাদের আকাঙ্ক্ষিত সেই শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে না পারার বহুবিধ কারণ রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় তিনটি স্তর দৃশ্যমান : প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা। প্রাথমিক স্তরে একটি শিশু যখন শিখতে আরম্ভ করে তখন প্রয়োজন হয় তার মধ্যে নতুন কিছু শেখার স্পৃহা গড়ে তোলা। এজন্য প্রয়োজন হয় তার যত্ন নেয়া, বিদ্যালয়ের প্রতি তার ভালোবাসা তৈরি করা, তার সঙ্গে শিক্ষকের সময় কাটানো। প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারি ২০২৩ অনুযায়ী- দেশে প্রাথমিক পর্যায়ে গড়ে ১ জন শিক্ষকের বিপরীতে ২৯ শিক্ষার্থী আছে, যা কোনোক্রমেই ১০ থেকে ১৫ জনের বেশি হওয়া উচিত নয়। এমনকি জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনুসারে শিক্ষক শিক্ষার্থীর গ্রহণযোগ্য অনুপাত ধরা হয়েছে ১:৩০, যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলে মনে হয়।
অন্যদিকে বিদ্যালয়, শিক্ষক, অভিভাবক এবং বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের চতুর্মুখী মানসিক চাপের ফলে অনেক শিক্ষার্থী মাধ্যমিক স্তরে ঝড়ে যায়, অথচ এই স্তরটি তার শিক্ষা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই এই স্তরে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পাশাপাশি মানসিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য রাষ্ট্রের ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে। শুনতে অবাক লাগতে পারে, মার্কিন মুলুকে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কোন বিজ্ঞানের পাঠ্যবই থাকে না, তারা বিজ্ঞান শেখে হাতে কলমে। আমাদেরও শিক্ষার্থীদের হাতে মোটা মোটা বই না ধরিয়ে তাদের ব্যবহারিক ও প্রায়োগিক শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করা উচিত। পাশাপাশি মানবিকবিদ্যা অধ্যয়নের মাধ্যমে তাদের আত্মিক ও নৈতিক উন্নয়নের উপর নজর দেয়া উচিত।
সর্বোপরি উচ্চশিক্ষা : বর্তমানে উচ্চশিক্ষার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা রীতিমতো যুদ্ধের পর্যায়ে পৌঁছেছে। এসময় সুযোগের সদ্ব্যবহার করে কোচিং বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মুনাফা করছে বিভিন্ন কোচিং সেন্টার। তাছাড়া এই ভর্তি পরীক্ষাগুলো পশ্চাদপদ, মুখস্থনির্ভর এবং সৃজনশীলতাবিমুখ, যেখানে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা যাচাইয়ের সুযোগ নেই বললেই চলে। কেবল ভর্তি পরীক্ষা নয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির পরও কোন ধরনের গবেষণাধর্মী অধ্যয়ন না করেই যে কেউ স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা বছরের পর বছর একই প্রশ্নে পরীক্ষা নেন এবং শিক্ষার্থীরাও গদবাঁধা উত্তর লিখেন। যার ফলে নতুন কোনো চিন্তার জগৎ উন্মোচিত হয় না। ফলস্বরূপ, বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে উচ্চশিক্ষার মানের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪১ টি দেশের মধ্যে ১২৩। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য গবেষণাকে প্রাধান্য দিয়ে উচ্চশিক্ষার সিলেবাস পুনর্গঠন করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মৌলিক গবেষণায় উৎসাহিত করার জন্য গবেষণা বৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষকদের মানোন্নয়নের জন্য দেশি-বিদেশি দক্ষ প্রশিক্ষকদের দ্বারা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করতে হবে। দেশের সেরা মেধাবীদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করার জন্য স্বতন্ত্র বেতনস্কেল তৈরি করে তাদের বেতন- ভাতা ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। জিডিপির ন্যূনতম ৮ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়ার যে দাবি দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে, তা শীঘ্রই বাস্তবায়ন করতে হবে। এই অর্থের সুষ্ঠু বণ্টন ও স্বচ্ছ ব্যয়ের নিশ্চয়তা প্রদানের জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিশন গঠন করতে হবে- যাদের কাজ হবে বরাদ্দকৃত অর্থের যথাযথ ব্যয়ের উপর তদারকি করা। আশার আলো হচ্ছে, ২৪ এর গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে আমরা শিক্ষা সংস্কার নিয়ে নতুনভাবে সচেতন হয়েছি। প্রত্যাশা রাখছি খুব শীঘ্রই আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে বৈশ্বিক মানদণ্ডে উন্নীত করতে সক্ষম হবো।
মোহাম্মদ আলী