.
হলুদে হলুদে ভরে গেছে মাল্টা বাগান। সে এক অপূর্ব দৃশ্য! বাগানে পা ফেলতে সবুজ গাছে থোকা থোকা হলুদ ফলের সমারোহ দেখে নিজেকে মনে হবে বিদেশে কোনো ফলের বাগানে এসেছেন। মাত্র আড়াই বছরেই বারি-১ (বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট) উদ্ভাবিত নতুন হলুদ জাতের মাল্টা ফলিয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছেন আব্দুল করিম।
আব্দুল করিম যশোরের মণিরামপুর উপজেলার মুজগুন্নী গ্রামের আকাম গাজীর ছেলে। প্রায় এক যুগ আগে মুরগি পালন, কেঁচো সার উৎপাদনসহ নানা কাজে ব্যর্থ হয়ে সর্বস্বান্ত হন। দেনার দায়ে পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেওয়া আব্দুল করিম বন্ধু আফজাল হোসেনের কিনে দেওয়া বারি জাতের সবুজ মাল্টা চারা লিজকৃত মাত্র ২০ শতাংশ জমিতে চাষ শুরু করেন। মাল্টা উৎপাদন করে দেশব্যাপী নজরে আসা করিম নানা চড়াই-উৎরাইয়ের পর আজ সফল কৃষি উদ্যোক্তা। ২৫ বিঘা জমিতে মাল্টা বাগানসহ চায়না লেবু ও কূল বাগানের কৃষি খামার গড়ে তুলেছেন। ওই সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে শিরোনাম হন মাল্টা করিম হিসেবে।
আব্দুল করিম বলেন, উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর অর্থাভাবে পড়ালেখা বন্ধ হলে ধারদেনা করে মুরগি পালনসহ নানা কাজ শুরু করেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে সর্বস্বান্ত আব্দুল করিম পুঁজি হারিয়ে দেনার দায়ে পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক পর্যায় উপজেলার তৎকালীন কৃষি কর্মকর্তা ড. মৃত্যুঞ্জয় রায়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি আব্দুল করিমকে মাল্টা চাষে উদ্বুদ্ধ করেন। লিজকৃত ২০ শতক জমিতে মাল্টা চাষ শুরুর দুই বছরে গাছে ফল ধরা শুরু হয়। সফল মাল্টা চাষি হিসেবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে স্থান করে নিলে আব্দুল করিমকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। বিভিন্ন অঞ্চল হতে মাল্টার কলম আর ফল কেনার অর্ডার আসতে থাকে। বছর তিনেক আগে হলুদ মাল্টা চাষের স্বপ্ন পেয়ে বসলে লিজকৃত আরও ৫ বিঘা জমিতে হলুদ মাল্টা চারা রোপণ করেন। আড়াই বছর পর গাছে ফল আসে। তিনি আরও জানান, হলুদ মাল্টা চাষের পাশাপাশি ডেনমার্কের মাল্টা চাষ করেও সফল তিনি। তবে, দেশীয় বারি-১ জাতের হলুদ মাল্টা রসে ভরপুর, স্বাদ ও মানেও অতুলনীয় এবং গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি।
প্রতি গাছে ৪০ কেজি থেকে ৪৫ কেজি ফল পাচ্ছেন তিনি। পাইকারি প্রতি কেজি মাল্টা ১শ’৩০ টাকা দরে আজ অবধি প্রায় ২২ লাখ টাকার মাল্টা বিক্রি করেছেন। আরও ১০ লাখ টাকা বিক্রির আশা করছেন তিনি।
এক সময় পুঁজি হারানো আব্দুল করিমের মাল্টা বাগানে ২৫ থেকে ৩০ জন নারী-পুরুষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। তারা নিয়মিত শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বিদেশ হতে ফল আমদানি নির্ভরতা কমে দেশীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে তিনি দাবি করেন।
মণিরামপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ঋতুরাজ সরকার বলেন, আব্দুল করিমের মাল্টা বাগানে আমি গিয়েছি। আসলে তার বাগানটি অনেক বড়। মাল্টা চাষ সম্পর্কে আমরা তাকে নানাভাবে পরামর্শ দিয়েছি
মাল্টা চাষ করে তিনি এখন স্বাবলম্বী।
কমলার বাগানে সাথী ফসল ॥ বগুড়ায় মনোলভা কমলা-মাল্টার বাগান। যে কেউ একটু ছুঁয়ে দেখতে চাইবে। রাস্তার পাশের্^ই বাগানে ঝুলছে থোক থোক কমলা। রসে টুইটম্বুর নানা জাতের কমলা। চায়না থেকে শুরু করে দার্জিলং জাতের। সব ধরনের কমলাই আছে বগুড়ার এই বাগানে। তবে দেশের বিভিন্নস্থানে কমলার বাগান থাকলে বগুড়া সদরের এক ছোট্ট জায়গায় কমলার বাগান গড়ে তুলে ভিন্নতা সৃষ্টি করেছেন আব্দুল আজিজ। কারণ তার বাগান শুধু কমলা ও এর চারাই নয়। বাগানটি লাভজনক করে তুলতে গড়ে তুলেছেন কমলার সঙ্গে সাথী ফসলের ভিন্নতা। আদা মরিচ শিম রসুন সবই রয়েছে এই সাথী ফসলে। গত বছর কমলাসহ সাথী ফসল বিক্রি করে লাভ করেছিলেন ২ লাখ টাকা। এবার কমলার ফলন ভালো হওয়ায় বেশি লাভের মুখ দেখার স্বপ্ন দেখছেন চালের ব্যবসা থেকে কমলার বাগান মালিক বনে যাওয়া আব্দুল আজিজ।
বগুড়া সদর দ্বিতীয় বাইপাস সংলগ্ন ফনির মোড় এলাকায় আব্দুল আজিজের কমলা বাগান। ৬০ শতাংশ জায়াগার ওপর গড়ে তুলেছেন এই বাগান। সন্তানদের শখে এক সময় কমলার বাগান গড়ার উদ্যোগ নেন। ২০১৯ সাল থেকে বাগানের পেছনে সময় ব্যয় করতে থাকেন। চুয়াডাঙ্গার সীমান্ত এলাকা থেকে প্রথমে কমলার চারা সংগ্রহ করেন। তারপর বিভিন্ন স্থান থেকে চায়না ও দার্জিলিংয়ের চারা এবং আফ্রিকান ও ভিয়েতনাম জাতের মাল্টা চারা সংগ্রহ করেন। বারী জাতের কমলাও রয়েছে তার বাগানে। এ রকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগ এক সময় স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে আজিজারকে। সমৃদ্ধ করতে থাকেন তার শখের বাগান। জানালেন বাণিজ্যিক লক্ষ্য মাথায় রেখে তিনি বাগান করেননি। শুধু কমলা ও মাল্টা নয় একই বাগানে তিনি বল সন্দুন্দী বড়ইও লাগিয়েছেন। বাগানের চারপাশে লাগিয়েছে সুপারি ও লেবুর গাছ। আর কমলা গাছের মাঝে চাষ করছেন সাথী ফসল হিসেবে মরিচ আদা রসুন ও শিম। এভাবেই গড়েছেন দৃষ্টিনন্দন শখের কমলা বাগান। আজিজ জানালেন তার কমলা বাগান দেখতে প্রতিদিন লোকজন আসেন। গাছ থেকে ছিঁড়ে টাটকা কমলা খাওয়ার লোভ ছাড়তে চান না দর্শনার্থীরা। যে সব দর্শনার্থী আসেন তারা ২/৩ কেজি করে কমলা কিনেন। অনেকে কিনেন আরও বেশি। কমলা গাছ থেকে কমলা ছিঁড়ে আনন্দে কমলা খাচ্ছেন বাগানে আসা লোকজন। আর তাদের মুগ্ধতা ছুঁয়ে যায় বাগান মালিককে। বাগান মালিক জানান, লোকজন তার বাগানের কথা বলছেন, এটিই তার ভালো লাগে। প্রতিদিন ১৫/২০ জন তার বাগান দেখতে আসেন। বাণিজ্যিক কমলার চাষের কথা না ভাবলেও এখন প্রতিদিনই কোনো না কোনো ফল বিক্রেতা তার নিকট থেকে ১৫/২০ কেজি কমলা কিনে নিয়ে যান। সব মিলিয়ে বর্তমানে প্রতিদিন ১শ’ থেকে ১৩০ কেজি কমলা বিক্রি করেন। প্রায় দেড়শ’ কমলার গাছ আছে বাগানে। প্রতি গাছে ৫০/৬০ কেজি কমলা ধরেছে বলে জানান। আজিজের দাবি তার বাগানের কমলা বেশ ভালো। বললেন সাথী ফসল থেকে গত বছর ৬০ হাজার টাকার মরিচই বিক্রি করেছেন। এবার সব কমলাসহ প্রায় আড়াই লাখ টাকা লাভ করবেন বলে আশা করছেন। কমলা বাগানের চারপাশে রয়েছে ১৩০টি সুপারি গাছ ও ৭০টি লেবু গাছ। তিনি জানান প্রতি কমলার গাছের মাঝে ৮/১০ ফুট ফাঁকা রাখতে হয়।
ওই স্থান কাজে লাগাতেই কমলা বাগানে সাথী ফসল আবাদের চিন্তা কার্যকর করেন। দেখেন এতে কমলা বাগানের কোনো ক্ষতি হয়নি, লাভ হিসাবে বাড়তি আয়ের পথ খুলেছে। কমলা বিক্রি শুধু নয় এখন তিনি চারা বিক্রির দিকে নজর দেওয়ার কথা জানিয়ে বলেন মান ও আকার ভেদে কমলার চারা বিক্রি করেন ২৫০ থেকে দুহাজার টাকা পর্যন্ত। আগামী বছর এই বাগানে চারাগাছের পরিমাণ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে তার। চারার চাহিদা বেশি বলে এখন থেকে তিনি এর দিকে বেশি নজর দেবেন। তবে দৃষ্টিনন্দন ও চমৎকার কমলা বাগানের সঙ্গে সাথী ফসল আজিজারের কমলা বাগানের আবেদন বাড়িয়ে ভিন্ন মাত্রায় এর পরিপর্ণতা এনে দিয়েছে।
কমলা বাগানের বিষয়ে বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মো. মতলবুর রহমান জানান, বগুড়া সদরসহ উপজেলা পর্যায়ে ছোট আকারের কমলা ও মাল্টার বাগান রয়েছে। এর মধ্যে মাল্টার বাগান বেশি। তিনি জানান কমলা-মাল্টা সাইট্রাস জাতীয় ফল। দেশে প্রতিবছর প্রচুর কমলা ও মাল্টা আমদানি হয়। এই জাতীয় ফসলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে কৃষি বিভাগ কমলা ও মাল্টা চাষের সম্প্রসারণে বগুড়ায় কাজ করে যাচ্ছে। তবে এটি চাষে সফলতার ক্ষেত্রে মাটির ধরনের বিষয়টি তিনি উল্লেখ করে জানান ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকে এগিয়ে আসছেন কমলা বাগান তৈরিতে।