ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১ পৌষ ১৪৩১

বীরশ্রেষ্ঠর সন্তান ও স্বপ্নের বাংলাদেশ

ড. মো. আইনুল ইসলাম

প্রকাশিত: ১৯:৪৪, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪

বীরশ্রেষ্ঠর সন্তান ও স্বপ্নের বাংলাদেশ

২০২৪ সালে বিজয় দিবস উদ্যাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ৫৩ বছর পূর্ণ হলো। স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশ ছিল অত্যন্ত দরিদ্র। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশও ছিল হতদরিদ্র। কিন্তু এ দুই সময়েই আয়বণ্টনের বৈষম্য ছিল সীমিত। তুলনায় আজকের বাংলাদেশ হতশ্রী দশা কাটিয়ে উঠেছে, জাতীয়  আয়ের দ্রুত প্রবৃদ্ধিও  ঘটিয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে বাড়িয়েছে বহু মাত্রা, তাল ও লয়ের বৈষম্য। উৎপাদন ও বণ্টণ ব্যবস্থার গভীরে বয়ে চলা বৈষম্যপ্রবণতার তাল-লয়-ক্ষয়ে রাষ্ট্রীয় পুনর্বণ্টনের দারিদ্র্য সর্বব্যাপী বৈষম্যকে এতটাই দুর্বিনীত করেছে যে, এই জাতি তার লজ্জা ও অনুশোচনা বোধটুকুই যেন হারিয়ে ফেলেছে।
এই কথা বলার কারণ শুনে হয়তো অবাক হবেন, হয়তো অবিশ^াস্য মনে হবে, কিংবা চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা অশ্রুও ঝরে পড়বে। তারপরও এ কথা সত্য যে, এ দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে নৌবাহিনীতে কর্মরত থাকাবস্থায় শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে শহীদ হয়ে যাওয়া সাত বীরশ্রেষ্ঠর অন্যতম বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মো. রুহল আমিনের দুই ছেলের বড়জন মো. বাহার ভাত-কাপড়ের অভাব নিয়ে মারা গেছেন ২০১২ সালে। জীবিত একমাত্র ছেলে শওকত আলী ২০১৮ সালে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার বাগপাচড়া উপশহরে কাঠের করাতকলে কাজ করতেন। ২০২৪ সালে এসে উপজেলা শহরের মানুষের বাড়ি বাড়ি থেকে ঠেলাগাড়িতে ময়লা-আবর্জনা সংগ্রহ করে বড় ভাগাড়ে নিয়ে ফেলছেন। আহা, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানের কথা বলে আমরা অবলীলায় কত মানুষ মেরে ফেলছি, কত সুবিধা বাগিয়ে নিচ্ছি; আর বীরশ্রেষ্ঠর ছেলেকে দিয়ে ময়লার গাড়ি টানাচ্ছি! শুধু কি তাই! একদশক ধরে প্রতি বছরই বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মো. রুহল আমিনের সন্তানের করুণ এই অবস্থা নিয়ে গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রতিবেদন হয়েছে। আর তাঁর সন্তান করাতকলের শ্রমিক থেকে চা দোকানের পানিটানা হয়েছেন এবং বার্ধক্যে এসে আর কিছু না পেরে শেষমেশ ময়লা সংগ্রহের পরিচ্ছন্নকর্মী হয়েছেন আর বাবার রেখে যাওয়া বাংলাদেশের স্বপ্নগুলোকে যেন ময়লার ভাগাড়ে নিয়ে ফেলছেন। কি বিস্ময়কর আমাদের স্বাধীনতা! কি লজ্জাজনক আমাদের বিজয় উদ্যাপন! এই কথা শুনে আজকের কোনো শিশু যদি প্রশ্ন করে, সত্যিই কি পূরণ হয়েছে স্বাধীনতাকামীদের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা! কিংবা সত্যিই কি অনুসৃত হয়েছে সংবিধানে বিধৃত নির্দেশনা, কিংবা সত্যিই কি এ দেশ বৈষম্য থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছে? তা হলে নিশ্চয়ই এ দেশের নির্লোভ যে কোনো মানুষসহ প্রতিটি বিশ^বাসীই হয়তো এক কথায় উত্তর দেবেন, ‘না’ ‘না’।
১৯৭১ সালে যার যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে শোষক শ্রেণির পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া আপামর মানুষের মূল দাবি ছিল, দেশের মানুষের অধিকার-মুক্তি-স্বাধীনতা, শোষণহীন-বঞ্চনামুক্ত-বৈষম্যহীন সমাজ, গরিব দুঃখী-আর্ত মানুষের ন্যায্য হিস্যা। এ লক্ষ্যে দেশ স্বাধীন করে খুব সন্তর্পণে সংবিধানে অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে লিপিবদ্ধ করা হয় : প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে (সংবিধান, অনুচ্ছেদ ৭.১), অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয়-শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা (অনুচ্ছেদ ১৫. ক), যুক্তিসঙ্গত মজুরির বিনিময়ে কাজের নিশ্চয়তা (অনুচ্ছেদ ১৫. খ), সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার (অনুচ্ছেদ ১৫. খ), সকল নাগরিকের সুযোগের সমতা অর্থাৎ, মানুষে-মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ (অনুচ্ছেদ ১৯/১, ২), একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করা (অনুচ্ছেদ ১৭ ক ও খ), মেহনতি মানুষ তথা কৃষক ও শ্রমিক এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সব প্রকার শোষণ থেকে মুক্তিদান (অনুচ্ছেদ ১৪), জীবনযাত্রার বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করার লক্ষ্যে কৃষি বিপ্লবসহ গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর সাধন (অনুচ্ছেদ ১৬), জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নারীর অংশগ্রহণ (অনুচ্ছেদ ১০), মৌলিক মানবাধিকার-স্বাধীনতার নিশ্চয়তা, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিতকরণ (অনুচ্ছেদ ১১)। কিন্তু অত্যন্ত লজ্জা ও পরিতাপের বিষয় সংবিধানের এসব ভালো ভালো কথার কিছুই পূরণ হয়নি। পূরণ আদৌ হবে কিÑনা তা নিয়েও ঘোরতর সংশয় আছে। বীরশ্রেষ্ঠর রক্ত বয়ে চলা সন্তানের এমন হাল দেখে সংশয় না করেই বা কীভাবে চলে।
এখানে প্রশ্ন হতে পারে, এ-কি তবে সংবিধানের দুর্বলতা না-কি রাষ্ট্র ব্যবস্থার ব্যর্থতা? অর্থনীতি শাস্ত্র ও সমাজবিজ্ঞানের মানুষ হিসেবে এ প্রশ্নের উত্তর হয়তো কালোত্তীর্ণ হবে না। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও আইন বিশারদরা এ নিয়ে ভাববেন। সবচেয়ে ভালো হয় যদি মনোবিজ্ঞানীরা ভাবেন। তবে কিছু কথা যে বলা যায় না, তা নয়। যেমনÑ ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর জাতীয় গণপরিষদে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের যে সংবিধান আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা হয়, সেখানে ২৭,৬০০ শব্দ রয়েছে। ১৫৩টি অনুচ্ছেদ, ১টি প্রস্তাবনা এবং প্রজাতন্ত্র, মৌলিক অধিকার, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ নিয়ে ৪টি তফসিলের আওতায় ১১টি অংশে বিভক্ত এই সংবিধানে প্রজাতন্ত্র, রাষ্ট্রীয় মৌলিক নীতি, মৌলিক অধিকার, নির্বাহী, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ, আইনসভা, আইন প্রণয়ন ও আর্থিক প্রক্রিয়া, অধ্যাদেশ তৈরির ক্ষমতা, নির্বাচন, বিচার বিভাগ. নিয়ন্ত্রক ও অডিটর জেনারেল, বাংলাদেশের সেবা, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, জরুরি বিধান, সংবিধানের সংশোধনী ও বিবিধসহ ভারি ভারি যেসব বিষয় রয়েছে, অর্ধশত বছর পরে এসে তার সবগুলো থেকেই দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। অথচ বর্তমান পৃথিবীতে সবদিক দিয়ে সর্বাধিক ক্ষমতাধর ও শক্তিশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে মাত্র ৪ হাজার ৪০০টি শব্দ রয়েছে। জানা ইতিহাসের যে কোনো বড় সরকারের সবচেয়ে প্রাচীন ও সংক্ষিপ্ততম লিখিত এই সংবিধান আজ থেকে ২৩৭ বছর আগে ১৭৮৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মাত্র ৫৫ জন প্রতিনিধির উপস্থিতিতে গৃহীত হয়েছিল, যেখানে ৩৯ প্রতিনিধি স্বাক্ষর করেছিলেন, বাকি ১৬ জন স্বাক্ষরে অস্বীকৃতি জানান এই বলে যে, এতে অনেক অধিকারের কথা লিপিবদ্ধ নেই। তৎকালীন সময়ে মাত্র ৩০ ডলার সম্মানীতে হাতে লেখা এই সংবিধানে সর্বজনীন ভোটের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ফলে শুধু সম্পত্তি-মালিক পুরুষরাই ভোট দিতে পারতেন। ওই সংবিধানে শত শত বছর ধরে মার্কিন ভূমিতে থাকা আফ্রিকান-আমেরিকানরা নাগরিক হিসেবেই গণ্য হয়নি। আর নারীরা তো কেবল ভোগের সামগ্রী বিবেচনায় ভোট দেওয়াসহ যাবতীয় নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকেই বাদ পড়েছিল। সংবিধান প্রণয়নের ১৩৩ বছর পর ১৯২০ সালে নারীদের এবং ১৩৭ বছর পর অর্থাৎ, ১৯২৪ সালে নেটিভ আমেরিকানদের ভোট দেওয়ার অধিকার যুক্ত হয়েছিল।
আসলে ব্যবসায়ী-আমলা-রাজনীতিবিদের ত্রিভুজ এই চক্র সংবিধানকে অপারেশনের টেবিলে ফেলে এত এত কাটাছেঁড়া করেছে যে, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে শ্রেণিবিভক্ত ও চরম মেরুকৃত আমাদের সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র ও অর্থনীতি ব্যবস্থা জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নারী-পুরুষনির্বিশেষে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই কেবলই উত্তরোত্তর অধিক হারে বহুমাত্রিক বৈষম্য ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করে যাচ্ছে। এই চক্র রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে এমনভাবে বিন্যস্ত করেছে যে, যাতে করে পণ্যের ব্যবসায়ী, রাজনীতির ব্যবসায়ী ও সরকারি নীতিপরিকল্পনার ব্যবসায়ী আমলারা মিলেমিশে রাষ্ট্রের সবকিছুতেই প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে। তারাই আবার জ্যামিতির সম্পাদ্য-উপপাদ্যের সূত্রে ফেলে আকার-আকৃতি-পরিমাণ দিয়ে কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক-অধ্যাপক-গবেষক, বিজ্ঞানী-দার্শনিক, চিকিৎসক-মনোবিশারদ-শল্যবিদ-ডেন্টিস্ট-সেবিকা-ওষুধ প্রস্তুতকারক, প্রকৌশলী-স্থপতি, সাংবাদিক-লেখক-বুদ্ধিজীবী-কূটনীতিবিদ, সামরিক কর্মকর্তা-পুলিশ, বিমানচালক, আইনজীবী, আর্থিক বিশ্লেষক, সমাজ-সংস্কৃতি কর্মী, হিসাবরক্ষক, নিবন্ধক নথিরক্ষক, পশুচিকিৎসক, বাবুর্চি, দিনমজুর, কুলি, রিক্সাচালক, হকার, ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, নাইটগার্ড, দোকানদার, দর্জি, জেলে, মুচি থেকে শুরু করে যত পেশা ও বৃত্তি আছেÑ সবাইকে নিজেদের মতো করে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়েছে। ত্রিভুজ এই চক্রই সব শ্রেণি-পেশার মানুষকেই আর্থিকীকরণকৃত পুঁজির বাহক বানিয়ে ছোট ছোট ফাউ খাওয়া-পরজীবী-লুটেরা-অনুৎপাদক গোষ্ঠী সৃষ্টি করে সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্রের সর্বময় নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। তাই নির্মোহ গবেষণায় মনে হবে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার আগে ২২ পরিবারের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত ছিল। ২০২৪ সালেও স্বাধীন বাংলাদেশ ২২ পরিবারই পরিচালনা করছে। মুষ্টিমেয় মানুষের এসব পরিবারের হাতেই রয়েছে পুঞ্জীভূত সম্পদ আয়ের সিংহভাগ অংশ, যারা অন্যের সম্পদ হরণ-লুণ্ঠন-দখল-বেদখল-জবরদখল-আত্মসাৎকরণের মাধ্যমে আইনসভার স্বীকৃতি নিয়ে লুটেরা শ্রেণি সেজে সরকার ও রাজনীতি ব্যবস্থাটাকেই দাস বানিয়ে ফেলেছে।
এমন এক অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াতে হলে যে ধরনের মন-মনন-মানসিকতা ও সংস্কৃতি প্রয়োজন, তা গড়ে তুলতে আমাদের আর কত যুগ সাধনা করতে হবে, কে জানে। তবে আশার কথা হলো, শত শত বছর ধরেই এই ভূখণ্ডের মানুষ লড়াই করেই স্বপ্নের বাংলাদেশ নামের সোনার হরিণের পেছনে ছুটে চলেছে। লড়াই-সংগ্রাম করেই এতটা পথ তারা পাড়ি দিয়ে এসেছে। আর এ স্বপ্নের হাত ধরেই দেশে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থানকে আজকের কিশোর-তরুণরা ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ ও ‘বৈষম্য উৎখাত’-এর উৎকৃষ্ট সময় বলছে। সত্যিই স্বাধীনতা কি-না, সত্যিই বৈষম্য উচ্ছেদ হবে কি-না সেসব প্রশ্নের জবাব হয়তো ইতিহাসই দেবে। কিন্তু অর্ধশত বছর ধরে এ দেশে কী এমন হলো যে, জনআকাক্সক্ষা বাস্তবায়িত হলো না। পূরণ হলো না যুগ যুগ ধরে দেখা স্বপ্ন। এখনো শুনতে হয় নতুন করে পাওয়া স্বাধীনতার গল্প। এখনো বলতে হয় বীরশ্রেষ্ঠর যুদ্ধদিনের বীরগাঁথার বদলে তাঁর সন্তানের ময়লার গাড়ি টানার গল্প। স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে হলে আমাদের এসব প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই জানতে হবে এবং সে মতেই রচনা করতে হবে নতুন পথ। আর তা না হলে আরাধ্য বাংলাদেশ চির অধরাই থেকে যাবে।

লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

মোহাম্মদ আলী

×