ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১ পৌষ ১৪৩১

অঙ্গীকার হোক সুশাসন ও গণতন্ত্র

ড. মো. শফিকুল ইসলাম

প্রকাশিত: ১৯:৩১, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪

অঙ্গীকার হোক সুশাসন ও গণতন্ত্র

বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ সমার্থক শব্দ। মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশ ভাবা যায় না। আমরা আজ স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে কথা বলছি। এসব সম্ভব হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কারণে। কিন্তু আমরা এত অকৃতজ্ঞ জাতি যে তাঁদের অনেককেই নির্মমভাবে হত্যা করেছি। এটা এখনো মেনে নিতে কষ্ট হয়। এটা ভাবতেও পারছি না কিভাবে মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা বা নির্যাতন করে। দেশ স্বাধীনের জন্য তাঁদের মূল্যবান জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিন কারাগারে ছিলেন এবং অনেকের জীবনের অবসান হয়েছে যুদ্ধে। তাদের ছেলে-মেয়ে ভালোবাসা, আদর ও স্নেহ থেকেও বঞ্চিত হয়েছেন। এটা কি আমরা চিন্তা করেছি? যদি চিন্তা করতাম তাহলে তো আমরা তাদের হত্যা বা হয়রানি করতে পারতাম না। তাই আজকের দিনে আমাদের সকল মুক্তিযোদ্ধাকে স্মরণ করা উচিত। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ধারণ করে আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে যেতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বা চেতনা ছিল ন্যায় বিচার, দুর্নীতিমুক্ত এবং বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা চালু করা। কিন্তু আজও আমরা দুর্নীতিমুক্ত এবং বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা কার্যকর করতে পারিনি। যা খুবই দুঃখজনক। তাই আমাদের দায়িত্ব কিভাবে দেশের দুর্নীতি বন্ধ করা যায় এবং সমাজে ন্যায় বা বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা যায় সে বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া।  
রাজনৈতিক তত্ত্ব অনুযায়ী, সার্বভৌমত্ব কোনো একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বা বিষয়। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে এসে সার্বভৌমত্ব যেন হুমকির মুখে। দেশের বিরুদ্ধে নানাবিধ ষড়যন্ত্র চলছে। প্রতিবেশী দেশ নানাভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে । সম্প্রতি ভারতের ত্রিপুরার আগরতলায় বাংলাদেশী দূতাবাসে হামলা এবং জাতীয় পতাকা নামিয়ে ফেলার মতো অত্যন্ত নিন্দিত ও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। যে কোনো দেশের মধ্যে অন্য দেশের দূতাবাসে এরকম ঘটনা সেদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ। ভারত বাংলাদেশের প্রতিবেশী ও বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে ভারতের জনগণের সম্পর্ক অত্যন্ত দৃঢ়। ইদানীং ভারতের মিডিয়া কর্তৃক বাংলাদেশকে একটা সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিপন্ন করার তৎপরতা প্রকটভাবে লক্ষণীয়। কিন্তু আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। বাস্তবে বাংলাদেশ একটা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। বাংলাদেশে সব ধর্মের মানুষ একে অপরের বন্ধু, আত্মীয়, ভাই হিসেবে সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করেন। তবে বাংলাদেশেও নানা ধরনের অনাকাক্সিক্ষত সম্প্রদায়গত ঘটনা ঘটে। ঐতিহাসিক এই বাস্তবতাকে বাংলাদেশের আপামর মানুষ অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে প্রতিহত করেছে বরাবর। আজকের দিনে আমাদের প্রত্যাশা, সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা যেন কোনোভাবেই নষ্ট হতে না পারে। এজন্য আমাদের সোচ্চার থাকতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধে যারা অবদান রেখেছে তাদের সকলের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। তাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ব্যতিক্রম। কারণ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। শুধু ৭ দিন কারাভোগ করেন বিদ্যালয়ের ছাত্র অবস্থায় ব্রিটিশ আমলে। বাকি ৪ হাজার ৬৭৫ দিন তিনি কারাভোগ করেন পাকিস্তান সরকারের আমলে। কেন এতদিন কারাভোগ করলেন? উত্তর সহজÑ বাংলাদেশের মানচিত্র এবং একটি স্বাধীন ভূখণ্ড পাওয়ার জন্য। যে যুদ্ধের পটভূমি তৈরি হয় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। কোটি মানুষের স্বপ্নে ও মনে, ত্যাগে রচিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস। এই ইতিহাস আমাদের জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য বহন করে। তাই বঙ্গবন্ধুর অবদান কোনোভাবেই যেন ভুলে না যাই। মানুষ হিসেবে তাঁর ভুল থাকতে পারে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান ব্যাপক ও তাৎপর্যপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুকে শুধু একটি দলের সম্পদ হিসেবে বিচার করা আওয়ামী লীগের ভুল ছিল। তাকে সার্বিক অর্থে দেশের সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব ও আত্মত্যাগকে পুনর্গঠনের জন্য সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধাদের মতামত নিয়ে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। যাদের মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি হয়েছে, তারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কি না, ন্যায্যভাবে হয়েছে কি না– সে বিষয়টি জাতির সামনে উপস্থাপন করা উচিত। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার ভিড়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে বের করা কঠিন। শুধু আট হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শনাক্ত হয়েছে তা নয়, অনেকেই টাকার বিনিময়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়েছে। তাদেরকে দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে যারা দুর্নীতি এবং অন্যান্য যত অপকর্ম সংগঠিত করছে, তাদের চরম শাস্তির আওতায় আনা উচিত। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ তালিকা করতে পারেনি বিগত সরকার। যা খুবই দুঃখজনক। উল্টো ২৫ হাজার ৫০০ গেজেটভুক্ত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রেখেই বিগত সরকারগুলো তাদের মেয়াদ শেষ করেছে। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ ভুয়া প্রমাণিত হওয়ার পরও অনেক সচিব ও বিভিন্ন সংস্থার প্রধান প্রকৌশলীসহ প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি সঠিক সময়ে। যা ঠিক হয়নি। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রকাশ করা একান্ত জরুরি। মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ তালিকা করতে না পারা আমাদের জন্য চরম ব্যর্থতা।
মুক্তিযোদ্ধারা শুদ্ধতম বাঙালি, জাতির গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক, যাদের ত্যাগ আমরা কোনোদিন ভুলে যেতে পারব না। কোনোদিন মানুষের হৃদয় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ মুছে ফেলতে পারবে না। তারপরও নানা অপশক্তি বা আন্তর্জাতিক মহল বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র করে চলেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের নামের সঙ্গে মিশে রয়েছে আমাদের সবকিছু। মিশে আছে এক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ এবং সকল মানুষের কল্যাণের রাজনীতি। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং পরাজয় মেনে নেয়, যা বাঙালির জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়, সেটির আবার উদয় ঘটে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বিজয়ের মুহূর্তটি সূচিত হয়েছিল আজকের এই দিনে। ৯১ হাজার ৫৪৯ পাকিস্তানি সৈন্য প্রকাশ্যে আত্মসমর্পণ করেছিল। কারও ঋণে নয়, কারও দয়ার দানে নয়, বরং এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের মহান বিজয়ের সেই সুর। যার ফলে আজ আমরা স্বাধীন এবং একটি স্বাধীন দেশের পতাকা নিয়ে বিশ্ব দরবারে ঘুরে বেড়াতে পারি। যা সত্যি গৌরবের বিষয়।  
ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মাহুতি এবং তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর ফলে অর্জিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, কিন্তু আমরা কি অর্থনৈতিক মুক্তি এখনো অর্জন করতে পেরেছি? উত্তর, না, পারিনি। তাই এখন দরকার অর্থনৈতিক মুক্তি। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত আমরা অনেক কিছুতেই এগিয়েছি, কিন্তু কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। সেই কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে আমাদের দরকার জাতীয় ঐক্য। দরকার সুশাসন এবং গণতন্ত্র। যে গণতন্ত্রে জনগণ তাদের ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারবে। শ্রমজীবী, মেহনতি মানুষ, দরিদ্র এবং নিম্ন আয়ের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তিই হোক আমাদের আজকের বিজয় দিবসের অঙ্গীকার। দারিদ্র্যের বলয় ভেঙ্গে অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করতে পারলে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মা শান্তি পাবে। অর্থাৎ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আমাদের শাণিত করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রেরণা প্রতিটি মানুষের মুক্তি। শোষণহীন, বঞ্চনাহীন একটি সমাজ এখনো নির্মাণ করা যায়নি। তাই সেখানে সরকারের নজর দিতে হবে। সমতাভিত্তিক সমাজ সৃষ্টি করতে হবে। সেখানে কোনো বৈষম্য থাকবে না। প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে– এটিই স্বাধীনতার মূল ভিত্তি। স্বাধীনতার মূল ভিত্তি নিয়ে দেশ বা জাতি এগিয়ে যাক, সেটাই আজকের দিনের প্রত্যাশা।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

মোহাম্মদ আলী

×