ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১ পৌষ ১৪৩১

বাংলাদেশের বিজয় বিশ্বের জন্য প্রেরণা

রুশাইদ আহমেদ

প্রকাশিত: ১৯:২৪, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশের বিজয় বিশ্বের জন্য প্রেরণা

বর্তমানে জাতিসংঘে স্বাধীন রাষ্ট্রের সংখ্যা ১৯৩ হলেও, তাদের মধ্যে যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে খুবই কম দেশ। এ তালিকায় বাংলাদেশসহ যুক্তরাষ্ট্র, ইরিত্রিয়া, আলজেরিয়া, হাইতি, চিলি, বলিভিয়া উল্লেখযোগ্য। এসব দেশের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, স্বাধীনতা অর্জনের লড়াই ছিল দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী। তবে এ সংগ্রামগুলো একেক দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে ভিন্নধর্মী রূপ নিয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ইতিহাস এ ধরনের একটি দৃষ্টান্ত। ১৭৭৬ থেকে ১৮৮৩ সাল পর্যন্ত সাত বছর ধরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তারা স্বাধীনতা অর্জন করে। এ যুদ্ধের প্রধান কারণ ছিল ‘ব্রিটেনের প্রতিনিধিত্ব ছাড়া কর আরোপ’। জনগণের এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা যুদ্ধে রূপ নেয়, যার ফলে গড়ে ওঠে আজকের স্বাধীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
অন্যদিকে, হাইতির সংগ্রামের প্রেক্ষাপট ছিল বেশ ভিন্ন। ১৭৯১ সালে শুরু হওয়া দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের মাধ্যমে দেশটি ১৮০৪ সালে ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের শিকল থেকে অবমুক্তি লাভ করে। যদিও স্পেনীয় শাসকদের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণভাবে জয়ী হতে পারেনি, তবু ফরাসি দখলদারিত্বের অবসান ঘটানোর জন্য হাইতির জনগণের দীর্ঘ সংগ্রাম এক উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত।
লাতিন আমেরিকার দুই দেশ চিলি এবং বলিভিয়াও স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা লাভ করে। তাদের সংগ্রাম প্রায় ১৬ বছর স্থায়ী হয়। এ দীর্ঘ সময়ে লাতিন আমেরিকার মানুষকে সহ্য করতে হয়েছে চরম দমন-পীড়ন। তবে অটুট ইচ্ছাশক্তি ও ঐক্য তাদের স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
আফ্রিকার দেশগুলোর ইতিহাস ও সংগ্রামমুখরতায় পরিপূর্ণ। ইরিত্রিয়া ছিল এর একটি চমৎকার উদাহরণ। ১৯৬১ সালে ইথিওপিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য ইরিত্রিয়ানরা দীর্ঘ ৩০ বছর যুদ্ধ করে। ইতালির ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ইথিওপিয়ার সঙ্গে একত্রিত হয়ে ইরিত্রিয়া স্বাধীনতার জন্য লড়াই চালিয়ে যায়। ১৯৯১ সালে ত্রিশ বছরের সংগ্রামের পর তারা চূড়ান্ত স্বাধীনতা লাভ করে।
উত্তর আফ্রিকার আরেকটি দেশ, আলজেরিয়া, স্বাধীনতার জন্য ফরাসি ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে। ৮ বছর ধরে চলা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে দেশটির জনগণ অসীম ত্যাগ স্বীকার করে। ফরাসি শাসনের বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলন বিশ্বের মুক্তিকামী জাতিগুলোর জন্য অনুপ্রেরণার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
বাংলাদেশÑ স্বল্পমেয়াদি সংগ্রামে অনন্য সাফল্য
এই সব দেশের তুলনায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল তুলনামূলক স্বল্পমেয়াদি। মাত্র ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। এটি সম্ভব হয়েছিল দেশের জনগণের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ ও অসীম আত্মত্যাগের মাধ্যমে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ মুক্তিযুদ্ধকে দ্রুত ও সফলতার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যায়। অন্য কোনো দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এমন বৃহত্তর জনসম্পৃক্ততা বিরল।
বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার জন্য আকাক্সক্ষা ও আবেগ ছিল অসীম। তাদের এই উদ্যমই পাকিস্তানি বাহিনীকে স্বল্প সময়ে পরাজিত করতে সহায়তা করে। এ কারণেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকার ১৬ ডিসেম্বরকে বিজয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করে, যা আজও জাতির গর্বের দিন।
মুক্তিযুদ্ধের শিক্ষাগ্রহণ ও জাতীয় উন্নয়ন
বিজয় দিবস বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মহিমান্বিত দিন। এ দিনটি আমাদের জাতির ত্যাগ ও আত্মনিবেদনকে স্মরণ করার একটি বিশেষ উপলক্ষ। তবে প্রশ্ন জাগে, যারা এই বিজয়ের জন্য প্রাণ দিয়েছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও স্মরণ শুধু একটি বা কয়েকটি জাতীয় দিনে সীমাবদ্ধ কেন? তাদের ত্যাগ ও সংগ্রামের গল্প থেকে আমাদের জাতি কেন আরও শিক্ষা নিয়ে দেশের উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করবে না?
আজ, স্বাধীনতার তেপান্ন বছর পর, বাংলাদেশ একটি উল্লেখযোগ্য অবস্থানে পৌঁছেছে। অনেক দেশ এমন অগ্রগতি করতে পারেনি। অর্থনীতি, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও সামাজিক খাতের উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা প্রশংসনীয়। তবে এ অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে জাতীয় ঐক্য ও প্রগতির পথে এগিয়ে যেতে হবে। আর্থসামাজিক খাতগুলো থেকে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, অনিয়মের শিকড় উৎপাটনে দৃঢ়ভাবে উদ্যোগী হতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগী চেতনা আমাদের জন্য পথপ্রদর্শক। এ চেতনা ধরে রাখার মাধ্যমেই জাতিকে ভবিষ্যতে আরও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। তাই শুধু স্মরণ নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের জাতীয় জীবনে বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশের বিজয়ের গল্প শুধু একটি জাতির নয়, এটি বিশ্বব্যাপী সংগ্রামমুখর মানুষের জন্য একটি অনুপ্রেরণা। তাই আমাদের এই ঐতিহ্য ও সংগ্রামের গৌরবময় ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। এভাবেই আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সোনালি অধ্যায়কে সার্থক ও স্মরণীয় করে রাখতে পারব ন্যায়ভিত্তিক বৈষম্যহীন সামাজিক অবকাঠামো বিনির্মাণে নিয়োজিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। আর এটাই হবে আমাদের বিজয়ের সার্থকতা।

মোহাম্মদ আলী

×