১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। আমাদের গৌরবময় অবিস্মরণীয় মহান বিজয় দিবস। পৃথিবীর মানচিত্রে ৫৩ বছর আগে এই দিনে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ৯ মাসের রক্তাক্ত যুদ্ধ শেষে বাঙালি জাতি চূড়ান্তভাবে বিজয় লাভ করে। বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বিশ্বের মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে। এই দিনটির জন্য আমাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে রক্ত দিতে হয়েছে বারবার। লড়তে হয়েছে আড়াইশ’ বছর। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন, ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আমাদের রক্ত দিতে হয়েছে। এভাবে লাখো শহীদের রক্তের ধারায় এবং লাখ লাখ নারী-পুরুষের আত্মত্যাগের ফসল আমাদের আজকের এই বিজয়। যে বিজয়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষরা সেই ১৭৫৭ সালের পর থেকে; কিন্তু আজও ২০২৪ সালে এসে স্বাধীন বাংলাদেশে জুলাই বিপ্লবে হাজারো ছাত্র-জনতার রক্তে রঞ্জিত নতুন এক বিজয় দিবস এ বছর আমরা পেয়েছি। একটি প্রশ্ন তাই সামনে আসে, এতো রক্ত দিয়ে পাওয়া স্বাধীনতার স্বপ্ন কেন পুরোপুরি পূরণ হয়নি? কেন স্বাধীন দেশে আবারও ছাত্র-জনতাকে রক্ত দিতে হলো? কেন বারবার ধূলিসাৎ হয়ে যায় আমাদের প্রকৃত স্বাধীনতার চেতনা? কেন আজও আমাদের শহীদদের স্বপ্ন ভেঙে যায় স্বাধীন হওয়ার পরও? কেন স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা যায় না? পৃথিবীর বুকে আমরা ৫৩ বছরেও কেন এখনো স্বনির্ভর স্বাধীন সমৃদ্ধ একটি দেশ গঠনে ব্যর্থ হয়েছি? নতুন নতুন ফরমেটে প্রতিবাদ যুদ্ধে বারবার আমাদের রক্ত ঝরেছে।
অথচ ১৯৭১ সালে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি সশস্ত্র জনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অনেক স্বপ্ন নিয়ে। সেদিন মুষ্টিমেয় কিছু বিপথগামী ছাড়া সবাই এক কাতারে লড়েছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ২৩ বছরের শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল প্রকৃতপক্ষে এক জনযুদ্ধ। প্রশিক্ষিত একটি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে পূর্ব বাংলার সাধারণ জনগণের অসম এক লড়াই যেখানে অংশগ্রহণকারীদের সিংহভাগই ছিল অস্ত্রহীন। ছিল না কোনো প্রশিক্ষণ, ছিল না অত্যাধুনিক কোনো অস্ত্র। যারা জীবনে কোনোদিন রাইফেল, স্টেনগান, বোমা দেখেনি তারাও স্বাধীনতার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাদেরই ছেলেমেয়েরা যারা সেনাবাহিনীপুলিশ বাহিনীসহ অন্যান্য নিয়মিত বাহিনীতে পাকিস্তানের চাকরিতে ছিল, তারাও চাকরি ছেড়ে এই জনযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। এভাবেই দেশের কৃষক-শ্রমিক, সাধারণ নারী-পুরুষ সবাই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এক কাতারে লড়াই করেছিল স্বাধীনতার স্বপ্নে, যে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে আসছিল বাঙালি জাতি উত্তরাধিকার সূত্রে শত শত বছর ধরে।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে তথাকথিত পরাজিত হওয়ার পর থেকে বাংলার স্বাধীনতা অস্তমিত হয়ে যায়। ফলে বাংলায় শুরু হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। বাংলার কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে তারা নিজেদের স্বার্থে হস্তক্ষেপ শুরু করে। কৃষকদের বাধ্য করে তাদের পছন্দমতো ফসল উৎপাদনে। নানা কৌশলে অধিকাংশ জমিতে জোরপূর্বক নীল চাষ প্রবর্তন করে। ব্রিটিশ শিল্পের কাঁচামালের জোগান বাড়ানোর জন্য খাদ্যশস্য, ডালশস্য ইত্যাদি বাদ দিতে চাষে বাধ্য করে কৃষকদের। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলায় খাদ্য সংকট সৃষ্টি করে তারা। কৃষক-শ্রমিক দরিদ্র থেকে দরিদ্র হয়ে পড়ে। অথচ আদিকাল থেকে বাংলা ছিল কৃষি প্রধান। বাংলার কৃষকরা ছিল অন্ন-বস্ত্রের জোগানদার, বাঁচার অবলম্বন। সেই সময় ভারতবর্ষের কৃষির ঐশ্বর্য বা সমৃদ্ধির অবদান ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো বিশ্বে। মোগল আমলেও রাজা-বাদশাদের শান-সৌকতের অর্থনীতি ছিল কৃষি ও কৃষকনির্ভর। কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শোষণের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতেও ভারতবর্ষের ভাগ নাটকীয়ভাবে কমে আসে। বৈশ্বিক শিল্পপণ্যের মধ্যে ১৭৫০ সালে ভারতের ভাগ ছিল শতকরা ২৫ ভাগ। ১৭৬০ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্রিটেনের ভাগ যেখানে ছিল দুই দশমিক নয় শতাংশ, কিন্তু ১৮৭০ সালেই তা বেড়ে শতকরা ৯ ভাগে উন্নীত হয়। ১৯৪৭ সালের আগ পর্যন্ত বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ব্রিটিশ উপনিবেশের সময়কে লুণ্ঠনের যুগ বলা হয়ে থাকে। শোষণ-নিপীড়নে বারবার শস্যভাণ্ডারসমৃদ্ধ বাংলা দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে। মানবসৃষ্ট ১৭৭০ সালে দুর্ভিক্ষে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়। এটা ইতিহাসে ভয়াবহ গণহত্যা হিসেবেও এখন বর্ণনা করা হয়ে থাকে। ব্রিটিশ শাসনের শেষ সময়েও আবারও মানুষ সৃষ্ট ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের শিকার হয় বাংলার জনগণ। ১৯৪৩ সালে আবার দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, যা বাংলায় পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। এই দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ বর্ণনা পড়ে আজও মানুষ কেঁদে ওঠে। বাংলার জনগণ এভাবেই আড়াইশ’ বছর পরাধীনতার মূল্য দিয়েছে।
বাঙালি প্রতিবাদী জাতি। হাত গুটিয়ে তাই বলে বসে থাকেনি। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে বিদ্রোহ করেছে, আন্দোলন করেছে, জীবন দিয়ে লড়াই করতে শিখেছে। বারবার কৃষক বিদ্রোহ, তিতুমীর বিদ্রোহ, ফরায়েজী আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন এবং ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের মতো আন্দোলনে সংঘটিত হয়। কারণ বাংলার সাধারণ কৃষক-জনতার মধ্যে এভাবেই ক্রমাগত লড়াই করতে করতে রাজনৈতিক পরিবর্তন আসে। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের মতো আন্দোলনের ফলেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা এদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। এটাই ছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ। অবশেষে ১৯৪৭ সালে জন্ম হয় ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের।
পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি গঠিত হয় পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে। কিন্তু ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার আশা-আকাক্সক্ষা অচিরেই ধূলিসাৎ হয়ে যায়। কারণ, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে। রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা তারা কুক্ষিগত করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সঙ্গে সব ক্ষেত্রেই বৈষম্য সৃষ্টি করতে থাকে। ক্ষমতা থেকে শুরু করে রাজনীতি, কৃষি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, প্রশাসন এবং প্রতিরক্ষাসহ সকল ক্ষেত্রেই পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে বৈষম্যের খতিয়ান স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সৃষ্টি হয় বৈষম্যবিরোধী ক্ষোভ ও দূরত্ব। শোষণ ও স্বৈরতান্ত্রিক নীতির ফলে জনগণ পরাধীনতার মতোই শোষিত হতে থাকে। এসব শোষণ-বঞ্চনার পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ২৩ বছর পর রূপ নেয় স্বাধিকার আন্দোলনে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। সেই মুক্তিযুদ্ধ রূপ নেয় জনযুদ্ধে। অবশেষে চূড়ান্ত বিজয় আসে দীর্ঘ নয় মাস পর ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে। যে বিজয়ের আজ ৫৩ বছর পার হয়েছে।
কিন্তু পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, আমাদের স্বাধীনতার অনেক স্বপ্ন অর্জন এখনো বাকি। এমনকি স্বাধীনতার পরও স্বাধীন দেশে গণতন্ত্রের জন্য বারবার লড়াই করতে হয়েছে। ৯০ গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারকে বিদায় করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে হয়েছে। ২০২৪ সালে এসে হাজারো ছাত্র-জনতাকে নতুন করে জীবন দিতে হয়েছে, ত্রিশ হাজারের মতো মানুষকে আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করতে হয়েছে। স্বাধীন দেশে লড়তে হয়েছে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে। বিগত ১৬ বছর মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অর্থনীতি, গণতন্ত্র, সুশাসনের অভাবে দুর্নীতি, লুটপাট এবং অর্থ পাচারের মতো ভয়াবহ সংকটে ছিল দেশ এবং অর্থনীতি। ফলে বেড়েছে বৈষম্য, দারিদ্র্য। সম্প্রতি প্রকাশিত শ্বেতপত্র অনুযায়ী জানা যায়, বিগত ১৫ বছরে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে দেশ থেকে পাচার হয়েছে। রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা নড়বড়ে হয়ে গেছে।
২০২৪-এর জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকে জনগণ নতুন করে বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখছে। আবার বৈষম্যহীন সমাজ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রকৃত স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের ইতিবাচক প্রত্যাশা এখন সবার মাঝে। যেখানে থাকবে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা। যেখানে দুঃশাসন, বঞ্চনা, বৈষম্য থাকবে না। যুবসমাজ কর্মসংস্থানের খোঁজে বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে আর লোহিত সাগর বা বঙ্গোপসাগরে ডুবে মরবে না। বিপুল বেকারের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বেকারত্বের গ্লানি জীবন থেকে দূর হবে। এই স্বপ্ন যুবসমাজ নতুন করে দেখছে। যেখানে কৃষক-শ্রমিক তার ন্যায্য অধিকার পাবে। তাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ হবে। জাতি আজ একাত্তরের মতো নতুন করে ঐক্যবদ্ধ। বিভক্তির রাজনীতির মাধ্যমে আমাদের আবারও যেন কেউ অন্ধকারে ঠেলে না দেয় সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। তরুণ যুবসমাজের নেতৃত্বে দেশ, জাতি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাবে। এ প্রত্যাশা এবারের বিজয় দিবসে সমগ্র দেশবাসীর। কারণ, ২০২৪-এ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে জীবন দিয়ে তারাই শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করেছে। ছাত্র-জনতাই বৈষম্যহীন সমাজ, গণতন্ত্র, সুশাসন ফিরিয়ে এনে স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে সক্ষম। এবারের বিজয় দিবসে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : প্রাবন্ধিক
মোহাম্মদ আলী