বুদ্ধিজীবী হত্যা
আজ ১৪ ডিসেম্বর। এক দিন, যা আমাদের জাতির ইতিহাসে এক গভীর শোক আর ত্যাগের স্মারক। একাত্তরের এই রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করে, যেন বাংলার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মেধাশূন্য করা যায়। রক্তাক্ত এই দিনটি বাঙালির হৃদয়ে এক চিরকালীন ক্ষতচিহ্ন হয়ে আছে।
সেই রাতে আলবদর, রাজাকার এবং আলশামস বাহিনী পরিকল্পিতভাবে শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, সাংবাদিক, লেখক এবং সংস্কৃতিসেবীদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। মিরপুর ও রায়েরবাজারের মতো নির্জন স্থানে তাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শহীদ হলেন ড. মুনীর চৌধুরি, ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, ড. মোহাম্মদ আবুল খায়ের, সেলিনা পারভীনসহ আরও অনেকে। তাদের অপরাধ? তারা এ দেশে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে ধ্বংস করা, নতুন রাষ্ট্রকে দুর্বল করে দেওয়া।
আজকের দিনে, আমরা সেই মহামানবদের স্মরণ করি, যাঁদের আত্মত্যাগ আমাদের মুক্তির পথ দেখিয়েছে। বুদ্ধিজীবীদের রক্তে স্নাত এই মাটি আজ আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতার প্রতীক। কিন্তু এই গৌরবের পথে কেবল পাকিস্তানের শোষণই বাধা ছিল না। স্বাধীনতার পরে আমরা একাধিকবার দেখেছি শাসকের স্বৈরাচারী রূপ।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শোষণ আর বৈষম্যের কথা আজও আমরা ভুলিনি। ভুলিনি তাদের নির্মম গণহত্যা, ধর্ষণ, এবং প্রিয়জনদের হারানোর বেদনা। একইভাবে, আমরা ভুলব না আমাদের দেশের ভেতরের শাসকদের অত্যাচার, হত্যাযজ্ঞ, এবং স্বৈরাচারিতার অধ্যায়।
১৯৭১ সাল বাঙালির ইতিহাসের এক মহাকাব্যিক অধ্যায়। পাকিস্তানি শাসকদের বৈষম্য, দমন-পীড়ন আর গণহত্যার বিরুদ্ধে এক রক্তাক্ত সংগ্রামের পর অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এই মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শেকড়, আমাদের আত্মপরিচয়ের ভিত্তি। ১৯৭১ শুধু স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ নয়, এটি ছিল একটি শৃঙ্খলমুক্ত সমাজের স্বপ্ন। যারা সেই সংগ্রামে প্রাণ দিয়েছেন, তাদের রক্তে রচিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস। আজ কেউ যদি এই ইতিহাসকে ম্লান করতে চায়, তবে সেটি জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল।
স্বাধীনতার পরেও আমাদের দেশ বারবার মুখ থুবড়ে পড়েছে স্বৈরাচারী শাসনের ভারে। শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে বাকশালের নামে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছিল, যেখানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অপমৃত্যু ঘটে। সেই সময় দেশে হত্যা, দুর্নীতি আর দমন-পীড়নের এক অধ্যায় শুরু হয়। এরপর আসে সামরিক স্বৈরাচারী শাসনের কালো সময়, এরশাদের স্বৈরাচারী শাসন, যা আমাদের গণতান্ত্রিক আদর্শে নতুন করে আঘাত হানে। এই ধারাবাহিকতাই প্রমাণ করে, যখন স্বৈরাচাররা ক্ষমতায় এসেছে তখনই শোষণের চিত্র একই থেকে যায়।
২০২৪ সালেও আমরা দেখেছি রাজপথে রক্ত ঝরেছে। কিন্তু একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে আজকের এই ক্ষমতার রাজনীতি এক নয়। একাত্তর ছিল শোষণের শৃঙ্খল ছিঁড়ে স্বাধীনতার পতাকা উড়ানোর যুদ্ধ। আর ২০২৪ হয়েছে ক্ষমতার লোভে হিংস্র দানব হয়ে যাওয়া এক স্বৈরাচারের পতনের বছর। কেউ যদি ১৯৭১-এর গৌরবকে ২০২৪-এর ঘটনাবলীর আড়ালে ঢাকতে চায়, তবে সেটি হবে একটি গভীর চক্রান্ত। আমরা ১৯৭১ ভুলব না, যেমনটি ভুলব না শেখ মুজিবের বাকশাল, এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনামল, কিংবা শেখ হাসিনার রক্তাক্ত শাসনের দিনগুলো। আমাদের ইতিহাস আমাদের স্মরণ করায়, মুক্তি কোনো সহজ রাস্তা নয়, এবং প্রতিটি লড়াইকে বিচার করতে হবে তার ন্যায্যতার ভিত্তিতে।
১৪ ডিসেম্বর আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে স্বাধীনতা কখনোই সহজে পাওয়া যায় না। শহিদ বুদ্ধিজীবীদের রক্তের ঋণ শোধ করতে হলে আমাদের প্রতিটি প্রজন্মকে সচেতন হতে হবে। এই আত্মত্যাগকে আমাদের মনে রাখতে হবে প্রতিদিনের কাজে, ভাবনায়, আর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায়।
আজ বুদ্ধিজীবী দিবসে, শহিদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। তাদের রক্ত আমাদের মাটির প্রতিটি বিন্দুতে মিশে আছে। তাদের ত্যাগ আমাদের পথ দেখাক, যেন আমরা একটি সৎ, সুবিচারপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে পারি। বাংলাদেশ গড়ার পথে কিংবা এগিয়ে যাওয়ার পথে যারা সংগ্রাম করেছেন, জীবন দিয়েছেন সবাইকে শ্রদ্ধা জানাই। ১৯৭১ এর বীরদের ভুলব না, ভুলব না রক্ষী বাহিনীর নির্যাতনের কথা, ভুলব না নূর হোসেনের কথা, ভুলব না আবু সাঈদ, ওয়াসিম, মুগ্ধদের কথা! "আমরা ভুলব না। আমরা ভুলতে দেব না।"
লেখক: মাহবুব নাহিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
এম হাসান