ক’দিন পরই মহান বিজয় দিবস। বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠতম এক আনন্দঘন দিন। নয় মাস রক্তস্নাত স্বাধীনতা সংগ্রামের পরে এ মহান বিজয় দিবসের আগমন। তাই প্রতি বছর এ দিনের আগমন মানেই স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা-মকতব, গ্রাম-শহর, অফিসপাড়া এমনকি কৃষকের পণ্য কুটিরেও আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। কারণ, স্বাধীনতা মানে এক মানবতার বিজয়ে অপ্রতিরোধ্য আত্মত্যাগের জয়যাত্রা আর বিজয় মানে এ সংগ্রামমুখর জীবনের পরম প্রাপ্তি ও চরম সমাপ্তি। যুগে যুগে ইসলাম পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে নতুন সূর্য আবিষ্কারে মুসলমানদের উৎসাহিত করেছে। আমাদের কবি নজরুল ইসলামের এ বাঁধভাঙা স্বাধীনতা অর্জনের স্পৃহাকে খোদা লা শারিকের পরম শিক্ষা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। -তাঁরই শক্তিতে শক্তি লভিয়া/হইয়া তাহারই ইচ্ছাধীন/মানুষ লভিবে পরম মূর্তি,/হইবে আজাদ, চির স্বাধীন।’ (নজরুল)
পাক কলেমা পড়ে একজন মুসলমান তাওহীদ বা আল্লাহ সুবহানাহুতায়ালায় একত্ববাদের সুদীপ্ত ঘোষণা দেয়, সে পবিত্র বাক্যের মর্মমূলে নিহিত রয়েছে মানুষের স্বাধীনতার জয়ধ্বনি। কালিমা তায়্যিবা—‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূূলুল্লাহ’-আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ বা প্রভু নেই; মুহম্মদ (স.) আল্লাহর প্রেরিত রাসূল।-এ বাক্য ও মন্ত্র প্রাথমিকভাবে একজন মানুষের অন্তরে গাইরুল্লাহ বা কোনো সৃষ্টির দাসত্বের ব্যাপারে কিম্বা অনিয়মতান্ত্রিক কোনো আনুগত্যের বিষয়ে সতর্কতা সৃষ্টি করে। কলেমাটির দুটি অংশ। এক. আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহা নেই।’ এর মাধ্যমে একজন মানুষ শুধু একজন স্রষ্টারই অধীনতা মেনে নিয়ে বাকি সকলের কাছ থেকে মুক্ত স্বাধীন হিসেবে গর্বিত জীবন লাভ করে।
এজন্য হয়তো কবি ইকবাল বলেছিলেন ‘ওয়ে একহি সিজদা জু তু করতি হ্যায়; দেতি হ্যায় তুজকো হাজারো সিজদা ওছে নাযাত।’ অর্থাৎ যে একটি মাত্র সিজদা তুমি এক আল্লাহর নামে কর, তা তোমাকে অন্যান্য হাজার প্রভু দাবিদারের সামনে শির অবনমিত করা থেকে মুক্তি দিয়ে থাকে।
কলেমার দ্বিতীয় অংশে ‘মুহম্মদ (স.) আল্লাহর রাসূল।’ এর মাধ্যমে ন্যায়ানুগ আনুগত্যের সন্ধান পাওয়া যায়। একটি মূলনীতির ভিত্তিতে সাম্যমৈত্রীর শিক্ষা পাওয়া যায়। অহিংস চিন্তাধারা ও অন্যান্য ধর্মপ্রবর্তক সকল নবী রাসূলগণের প্রতি সমান শ্রদ্ধা ভক্তি ফুটে ওঠে। কুরআনের ভাষায়- লানুর্ফারিকু বাইনা আহাদিম মির রাসুলিহি... আমরা আল্লাহর রাসূলগণের মাঝে কোনো বিভেদ রেখা সৃষ্টি....করি না।’ এ ভাবে কলেমার মর্মবাণী আমাদের মনমুকুরে একটি মুক্ত স্বাধীন পরিবেশ গড়ার বীজ বপন করে।
বাস্তবিক পক্ষে আমরা দেখি, মানুষ কিছু কিছু ব্যাপারে সম্পূর্ণ দুর্বল, অধীন বা মুখাপেক্ষী। এসব অধীনতা ও মানবীয় দুর্বলতা হতে সে কখনো মুক্ত হতে পারে না। যেমন- পানাহার গ্রহণ, নারী-পুরুষের মাঝে দৈহিক ও মানসিক ব্যবধান। এগুলো সৃষ্টিকর্তার জীবনের গতিময়তা ও সাযুজ্য রক্ষার জন্য স্থির করে দিয়েছেন। ‘স্বাধীনতা’ বলতে ইসলাম কতিপয় সুনির্দিষ্ট বিষয়ে অঙ্গুলী নির্দেশ করে, যা আধুনিক রাষ্ট্র বিজ্ঞানেও স্বীকৃত। যেমন- ব্যক্তিস্বাধীনতা, চিন্তা ও আকিদা বিশ্বাসের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সমালোচনার অধিকার এবং নাগরিক স্বাধীনতা (দ্র: আল কুরআনে রাষ্ট্র ও সরকার-৩০৫)।
এগুলো সমাজে বাস্তবায়িত না থাকলে মনুষ্যজীবন নি®প্রাণ ও অনর্থক হয়ে পড়ে এবং স্তব্ধ হয়ে যায় সমৃদ্ধির গতিধারা। যুগে যুগে কিছু স্বৈরশাসনের কবলে পড়ে মানুষের স্বাধীনতা ও স্বাধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। কুরআন মাজিদে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন পর্যায়ে ফিরাউনি শাসনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআনে ফিরাউনকে একজন দাম্ভিক, সীমালঙ্ঘনকারী ও বাড়াবাড়িকারী শাসকরূপে চিহ্নিত করা হয়। (দ্র: সূরা ইউনুস-৭৫, ৮৩; সূরা মু’মিনুন-৪৫, ৪৬; সূরা দুখান-৩১-৩২)। ফিরাউন মিসরের লোকদের দাসানুদাস বানিয়ে রেখেছিল। জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করে রাখে। তার ওপর দিয়ে যেমন কারোর কথা চলত না, তেমনি তার ওপর কথা বলার সাহসও কারোর ছিল না। ফিরাউন হজরত মূসা ও হারুনের (আ.) তাওহিদী দাওয়াত কবুল করেনি। বনী ইসরাঈলিদের মুক্তিদানের দাবিও মেনে নিতে রাজি হয়নি।
যুগে যুগে অসংখ্য নবী ও রাসূল এসেছিলেন সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বিধানের জন্য। মহানবী হজরত মুহম্মদ (স.) মক্কায় ধর্মপ্রচারের শুরুতেই দাসপ্রথা বিলুপ্ত ও সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণে সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাঁর ও তাঁর সাহাবাগণের সঙ্গে দ্বন্দ্ব হয় স্থানীয় কায়েমি স্বার্থবাদীদের, শোষক সমাজপতিদের। তবু তার প্রত্যয় সাধারণ মানুষকে শোষক শ্রেণির জিন্দান থেকে মুক্ত করবেনই। তিনি একপর্যায়ে হিজরত করলেন, বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন। আট বছরের ব্যবধানে তিনি মুক্ত ও স্বাধীন করলেন মাতৃভূমি মক্কা (খ্রিঃ ৬৩০)।
লক্ষণীয়, মহানবী হজরত মুহম্মদ (স.) তাঁর সুদীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের ধারাবাহিকতায় যখন পবিত্র মক্কা বিজয় করলেন- এর আগ পর্যন্ত তাঁর অধিকাংশ সংঘাত-সংঘর্ষের হোতা ও ইন্ধনদাতা ছিল মক্কার নেতৃত্ব শ্রেণি। বিজয়ের পর তিনি আশ্চর্যজনকভাবে তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন। দুনিয়ার বিজয়ী বীরদের জন্য এ এক অবিস্মরণীয় শিক্ষা।
স্বাধীনতার জন্য রক্ত ঝরানোর পর তা যখন অর্জিত হয়, অবশ্যই তার মর্যাদা রক্ষা করতে জানা বিরাট বিচক্ষণতা ও যোগ্যতার বিষয়। সে সময় শুধু মুসলমানগণ স্বাধীনতার উন্মুক্ত পরিবেশ উপভোগ করেনি, অন্য সকল ধর্মাবলম্বীও পেয়েছিল শান্তি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। এ ক্ষেত্রে আল কুরআন সুস্পষ্ট শিক্ষা ও যৌক্তিকতা উপস্থাপন করেছে- ‘আর মুশরিকদের মধ্য থেকে যদি কোনো ব্যক্তি তোমার নিকট আশ্রয় চেয়ে আসতে ইচ্ছে করে তাহলে তাকে অবশ্যই আশ্রয় দিবে। যেন সে আল্লাহর কালাম শোনার সুযোগ পায়। পরে তাকে তার নিরাপত্তার স্থানে পৌঁছে দাও। এই নির্দেশ এ জন্য দেওয়া হলো এবং তা করা এজন্য প্রয়োজন যে, ওরা হচ্ছে এমন লোক যারা প্রকৃত ব্যাপার কিছুই জানে না।’ (সূরা তাওবা-৬)।
এ প্রসঙ্গে মহানবীর (স.) একটি বিখ্যাত উক্তিও স্মরণীয়। তিনি যে কোনো মানুষের স্বাধীন মনোভাবের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে বলেছিলেন- দেশ-শহর-নগরের মালিক আল্লাহ। মানুষ সব আল্লাহর বান্দা। অতএব তুমি যেখানেই কল্যাণ পাবে বলে মনে করবে সেখানেই তুমি অবস্থান গ্রহণ কর। (আল ফাসাহা-২২৩)।
সুতরাং আমরা দেখি, ইসলামী ইতিহাস ও দর্শন সদা-সর্বদা মানুষের মৌলিক স্বাধীনতা সুরক্ষার ব্যাপারটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছে। পরাধীন হয়ে থাকা হীনম্মন্যতার পরিচায়ক। পরাধীন জীবন শৃঙ্খলিত ও মর্যাদাহীন জীবন। এ জীবন থেকে মুক্ত রাখা এবং মুক্ত থাকার পথ নির্দেশ করেছে ইসলাম। এজন্য যে কোনো মানুষের, যে কোনো গোত্র বা জাতির স্বাধীনভাবে সহায়তাদানে ইসলাম অনুপ্রেরণা হিসেবে আর মুসলমানরা শক্তি হিসেবে অবদান রেখেছে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি আজ মুক্ত-স্বাধীন। এর স্বাধীনতা অর্জনেও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীসহ দেশের অধিকাংশ মুসলমান জানমাল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ’৭১-এ অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডারগণ ছিলেন মুসলমান। বস্তুত স্বাধীন জীবনই প্রকৃত জীবন। এ শিক্ষাই ইসলাম জগৎবাসীর সামনে তুলে ধরতে চায়। আর পরাধীনতার গ্লানিমুক্ত হওয়া ও অন্যান্য পরাধীন নারী-পুরুষকে স্বাধীন জীবনের সন্ধান দেওয়া, স্বাধীনতা প্রতিটি মুসলমানের ইমানি দাবি। আল্লামা ইকবাল যথার্থই বলেছেন- ওহে অসীম নীল আকাশের পাখি! জেনে রেখো, ওই ধরনের জীবন থেকে মৃত্যুই শ্রেয়; যে জীবিকার জন্য ব্যক্তিত্বে পরাধীনতা নেমে আসে। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বিজয় অর্জনের পর যে কোনো পরিণামদর্শী জাতিকে আমরা দেখেছি সংযত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ হতে। যারা উচ্ছৃঙ্খল তারা প্রতিশোধপরায়ণ হয়। আমাদের নবীজী (স.) প্রতিশোধপরায়ণতার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তার শান্তিপূর্ণ মক্কা বিজয় ছিল এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
লেখক: অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব
[email protected]
মোহাম্মদ আলী