ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের গুরুত্ব

মো. জাহিদুল ইসলাম

প্রকাশিত: ১৯:০৬, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪; আপডেট: ১৯:০৭, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪

পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের গুরুত্ব

পৃথিবীতে একটি ভৌগোলিক উত্তর মেরু এবং একটি  দক্ষিণ মেরু রয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দুই মেরুতেই শীতকাল এবং গ্রীষ্মকাল ছাড়া আর কোনো ঋতু নেই। শীতকালে মেরু অঞ্চলে সূর্যের দেখা  মেলে না। গ্রীষ্মকালে ঠিক এর উল্টোটা হয়, অর্থাৎ  তখন মেরু অঞ্চলে সূর্য অস্ত যায় না। তবে মেরু অঞ্চলে সূর্য দিগন্তরেখার খুব বেশি ওপরে ওঠে না। উত্তর মেরুতে যখন শীতকাল হয়, দক্ষিণ মেরুতে তখন থাকে গ্রীষ্মকাল। কক্ষপথে পৃথিবী কিছুটা হেলে থাকার কারণে দুই বিপরীত মেরুতে একই সময়ে সূর্যের দেখা মেলে না। ভৌগোলিক উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু ছাড়াও পৃথিবীর আরও দুটো মেরু রয়েছে। এ দুটো হলো পৃথিবীর চৌম্বকীয় মেরু বা ম্যাগনেটিক পোল। অর্থাৎ চুম্বকের মতো পৃথিবীরও রয়েছে দুটি মেরু। পৃথিবী একটা চুম্বকের মতো কাজ করে। পৃথিবীর চারপাশে একটি অদৃশ্য চৌম্বক ক্ষেত্র রয়েছে, যা পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র নামে পরিচিত। পৃথিবীর অভ্যন্তরে গলিত লোহা জমাট বাঁধার ফলে এক ধরনের শক্তিশালী চৌম্বকীয় ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। এই চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের প্রভাবেই কম্পাসের কাঁটা নড়ে উঠে দিক নির্দেশ করে। কম্পাসের কাঁটাও একটি চুম্বক। চুম্বকের কাঁটার দক্ষিণ মেরু পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের উত্তর মেরুর দিকে ফিরে থাকে। এর কারণ হলো,  দুটি চুম্বকের বিপরীত মেরুতে আকর্ষণ হয় এবং সমমেরুতে ঘটে তার উল্টোটা, অর্থাৎ বিকর্ষণ। পৃথিবীর চৌম্বকীয় উত্তর ও দক্ষিণ চৌম্বকীয় মেরুর অবস্থান ভৌগোলিক উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই দুই মেরুর মাঝে রয়েছে যথেষ্ট দূরত্ব। চৌম্বকীয় উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু ভৌগোলিক উত্তর এবং দক্ষিণ মেরুর মতো এক জায়গায় স্থির থাকে না।
পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র মহাকাশে বেশ খানিকটা বিস্তৃত। পৃথিবী হলো মহাকাশে ভাসমান একটি শক্তিশালী চুম্বক। এই চৌম্বকীয় ক্ষেত্রটি পৃথিবীকে নানা ধরনের ক্ষতিকর মহাজাগতিক রশ্মির আঘাত থেকে প্রতিনিয়ত রক্ষা করে চলেছে। চৌম্বকীয় ক্ষেত্র না থাকলে পৃথিবী নামক গ্রহটি জীবজগতের জন্য বাসযোগ্য হতো না। এই প্রতিরক্ষা বলয় সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে পৃথিবীকে প্রতিনিয়ত রক্ষা করে চলেছে। এই চৌম্বক ক্ষেত্র পৃথিবীকে সূর্যের তীব্র রশ্মি এবং মহাকাশের অন্যান্য ক্ষতিকর রশ্মি থেকে সুরক্ষা প্রদান করে। এ বলয় না থাকলে পৃথিবীতে জীববৈচিত্র্য কল্পনা করাও সম্ভব হতো না। চৌম্বক ক্ষেত্র ছাড়া সৌরবায়ুর প্রভাবে বিলীন হয়ে যেত পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল। সূর্যের প্রচণ্ড তেজস্ক্রিয় বিকিরণ আছড়ে পড়ত পৃথিবীর বুকে। মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য পৃথিবীর ভূত্বকের নিচে কনক্রিটের আবাসস্থল তৈরি করে সেখানে বসবাস করতে হতো। সুতরাং এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে,  আমাদের জীবন ধারণের জন্য এই চৌম্বক ক্ষেত্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পৃথিবী প্রতি ২৪ ঘণ্টায় একবার নিজের অক্ষের ওপর ঘোরে এবং এর কেন্দ্রের গলিত লোহা চক্রাকারে ঘুরে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে। তবে পৃথিবীর চৌম্বক মেরু নিয়মিতভাবে পরিবর্তিত হয়ে থাকে এবং এই পরিবর্তন প্রায় দুই থেকে তিন লাখ বছরে একবার ঘটে। পৃথিবীর কেন্দ্রে রয়েছে অতি উত্তপ্ত কঠিন লোহার গোলক। এর তাপমাত্রা প্রায় ৫ হাজার ৭০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কেন্দ্রের কঠিন গোলকের চারপাশে আছে অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রার তরল পদার্থ। এই তরলের উপাদান মূলত লোহা ও নিকেল। তাপমাত্রা, চাপ এবং গঠনগত পার্থক্যের কারণে গরম ও কম ঘন পদার্থ বাইরের স্তরে বেরিয়ে আসে। একইভাবে বাইরের স্তরের ঘন পদার্থগুলো চলে যায় ভেতরের স্তরে। মূলত এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। সব সময় এটা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। তবে পৃথিবীর উচ্চচাপের কারণে একেবারে কেন্দ্রের গোলকটি তরল হতে পারে না। সূর্যের কক্ষপথে পৃথিবী তার নিজের অক্ষের ওপর প্রতিনিয়ত পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে ঘুরছে। নিজ অক্ষের ওপর পুরো একবার ঘুরে আসতে পৃথিবীর সময় লাগে ২৩ ঘণ্টা, ৫৬ মিনিট, ৪ সেকেন্ড। পৃথিবীর এই লাটিমের মতো ঘোরার ফলেই প্রতিদিন পূর্বদিকে সূর্যের উদয় হচ্ছে এবং পশ্চিম দিকে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। অর্থাৎ এই গতির ফলেই পৃথিবীতে দিনরাত্রি হয়। এটা হচ্ছে পৃথিবীর আহ্নিক গতি। এই ঘূর্ণনের কারণে কেন্দ্রে কোরিওলিস ইফেক্ট (গতিশীল বস্তুসমূহের আপাত বিচ্যুতি) তৈরি হয়। এ কারণে কেন্দ্রের তরলে তৈরি হয় এক ধরনের ঘূর্ণিবর্ত। ফলে, বৈদ্যুতিক স্রোত তৈরি হয়। এই বিদ্যুত প্রবাহের কারণে তৈরি হয় অদৃশ্য চৌম্বকক্ষেত্র। বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত ধাতু কেন্দ্রের তরলের মাঝে ঘোরার সময় চৌম্বকক্ষেত্রের কারণে তৈরি হয় বিদ্যুৎ প্রবাহ। বিদ্যুৎ প্রবাহের কারণে তৈরি হয় চৌম্বকক্ষেত্র। এ চক্র ক্রমাগত চলতেই থাকে। ফলশ্রুতিতে এটা অনুভব হতে পারে যে, পৃথিবীর কেন্দ্রে মনে হয় নিরবচ্ছিন্নভাবে বাইরের কোনো সাহায্য ছাড়াই শক্তি তৈরি হচ্ছে। বিষয়টি আসলে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক রূপ । সূর্যের আকর্ষণে পৃথিবী যে প্রচণ্ড বেগে ঘুরছে, সেই ঘূর্ণন শক্তি থেকে কেন্দ্রে তৈরি হয় এই বিদ্যুৎ ও চৌম্বক শক্তি। সঙ্গে আছে পরমাণুর অভ্যন্তরীণ শক্তি ও পৃথিবীর অভ্যন্তরে জমে থাকা তাপশক্তির সক্রিয় প্রভাব। সুতরাং হঠাৎ করে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র বিলীন হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে পৃথিবী এবং মানবজাতির ভবিষ্যৎকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে পৃথিবীর চৌম্বক মেরুর উল্টানোর বিষয়টি। যদিও এটি একটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। তবে এর ফলে উদ্ভূত বিপদ হতে পারে বিধ্বংসকারী এবং বিপর্যয়কর। এরূপ ভয়ংকর পরিস্থিতি মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। গবেষকদের মতে, পৃথিবীর চৌম্বক মেরু যখন উল্টে যাবে তখন পৃথিবীর প্রাণিকুলের জন্য এক ভয়ানক বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের এক বিশাল অংশ বিলুপ্ত করে দিতে পারে, যা ‘ম্যাস এক্সটিংশন’ (কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মহাকাশের গ্রহাণু পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ে বহু প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটাতে পারে এমন পরিস্থিতি) নামে পরিচিত। কারণ, চৌম্বক ক্ষেত্রের দুর্বল হওয়ার ফলে পৃথিবীকে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই রশ্মিগুলো প্রাণীদের জন্য প্রাণঘাতী হতে পারে।
সর্বশেষ, চৌম্বক মেরু উল্টানোর ঘটনা ঘটেছিল প্রায় ৭ লাখ ৮০ হাজার বছর আগে। আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ১৯৮০ সাল থেকে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র অস্বাভাবিকভাবে দুর্বল হতে শুরু করেছে। বিশেষ করে সাউথ আটলান্টিক এনাম নামে একটি অঞ্চলে চৌম্বকক্ষেত্র প্রায় অকেজো হয়ে পড়েছে। এই অঞ্চলটি পৃথিবীর এক-পঞ্চমাংশ অংশজুড়ে বিস্তৃত। এই দুর্বলতার কারণেই গবেষকরা ধারণা করছেন যে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে পৃথিবীর চৌম্বক মেরু উল্টে যেতে পারে। এদিকে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র না থাকলে বিপর্যয়ের শুরুটা ঘটত বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় ইন্টারফারেন্স এবং রেডিও-তরঙ্গ ইন্টারফারেন্সের মাধ্যমে। এর ফলে পৃথিবীর বেতার তরঙ্গ অকার্যকর হয়ে পড়ত। ভেঙে পড়ত সব ধরনের বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা। পাখিরা দিক হারিয়ে আকাশ থেকে ছিটকে পড়ত। উড়োজাহাজ হয়ে পড়ত নিয়ন্ত্রণহারা। পৃথিবীর বিদ্যুৎ সংযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ত। সৌরবায়ুর অবাধ প্রবাহে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতো। শ্বাস নেওয়ার মতো বাতাসও একটা সময় থাকত না পৃথিবীতে। বর্তমানে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র সূর্য থেকে আসা উচ্চশক্তিসম্পন্ন কণা এবং সৌরবায়ুকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে আটকে দেয়। এ কারণে উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে দেখা যায় মেরুজ্যোতি বা আরোরা।
পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র না থাকলে অথবা এর    বিলুপ্তি ঘটলে বায়ুমণ্ডলের উপাদান কমে যাবে। যার ফলে, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলীয় চাপও কমে যাবে। বায়ুমণ্ডলীয় চাপ কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের পানি আরও দ্রুত বাষ্পীভূত হতে থাকবে। একটা সময় বাতাস ও পানি সম্পূর্ণই হারিয়ে যাবে মহাশূন্যে। মঙ্গলের মতো বাতাস ও পানিবিহীন মরুগ্রহে পরিণত হবে পৃথিবী। এ সময় পৃথিবীপৃষ্ঠে কোনো মানুষ বেঁচে থাকলেও সূর্যের তেজস্ক্রিয় বিকিরণের প্রভাবে শরীরে দেখা দেবে ক্যান্সার। বেতার তরঙ্গ না থাকায় এক সময় পৃথিবীর কক্ষপথে থাকা কৃত্রিম উপগ্রহগুলোও আছড়ে পড়া শুরু করবে পৃথিবীতে। পৃথিবীতে ভূমিকম্প, ভূমিধস, অগ্নুৎপাতের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও ঘটতে পারে। বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, সার্কিট, বিদ্যুৎ গ্রিড এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর ফলে স্যাটেলাইট, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট কোনো কিছুই কাজ করবে না। এমন পরিস্থিতিতে মানবজাতি এক  অন্ধকার সময়ের যুগে ফিরে যাবে। যেখানে আধুনিক প্রযুক্তির কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। এক কথায় চৌম্বক ক্ষেত্র বিলীন হলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পৃথিবীতে নেমে আসবে চরম বিপর্যয়। সম্প্রতি গবেষণার ফল অনুযায়ী পৃথিবীর চৌম্বক মেরুর উল্টানোর এই রহস্য মানবজাতির জন্য এক নতুন চ্যালেঞ্জ হতে পারে।  অদূর ভবিষ্যতে এই গবেষণার ফল আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। পৃথিবীতে এমনিতেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটছে প্রতিনিয়ত। মহাজাগতিক বিপদেরও কমতি নেই। সবার মাঝে পৃথিবীকে সুন্দর ও বাসযোগ্য রাখতে আমাদেরই সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। মানুষের কারণে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের যেন কোনো ক্ষতি না হয়, সেদিকে আমাদের সবাইকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
লেখক  : নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান (আইসিটি সেল), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

মোহাম্মদ আলী

×