ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১

প্রেসিডেন্ট আসাদের পতন- আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি

ড. মো. মোরশেদুল আলম

প্রকাশিত: ২০:২৬, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রেসিডেন্ট আসাদের পতন-  আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি

.

সমকালীন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সিরিয়া সংকট ছিল একটি বহুল আলোচিত বিষয়। গাজা, লেবানন, ইরানের পর এবার নতুন করে সংঘাত মাথাচাড়া দিয়েছিল পশ্চিম এশিয়ার দেশ সিরিয়ায়। ২০১১ সালে শুরু হওয়া ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধ শেষে গত রবিবার বাশার আল আসাদ দামেস্ক ছেড়ে পালিয়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন। গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বাশার আল আসাদ ইরান ও রাশিয়ার সমর্থন পেয়ে আসছিল। বাশার আল আসাদ সিরিয়া ছেড়ে যাওয়ায় শুধু বাথ পার্টির শাসনেরই অবসান হয়নি; একই সঙ্গে প্রক্সিযুদ্ধে ইরান ও রাশিয়ারও পরাজয় হয়েছে। সিরিয়ায় ইরানের উপস্থিতি ইসরাইলের জন্য ছিল অস্বস্তির বিষয়। ইরানি মিলিশিয়ারা শুধু বিদ্রোহীদেরই দমন করেনি, একই সঙ্গে লেবাননের হিজবুল্লাহদেরও সহযোগিতা করত। বাশারের পতন ঘটিয়ে ইসরাইল সফলভাবে হিজবুল্লাহর সরবরাহ লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়াও সিরিয়া থেকে তার যোদ্ধাদের সরিয়ে নেওয়ায় অব্যাহতভাবে বাশারকে সহযোগিতা করা রাশিয়ার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে, বাশারের প্রতি রাশিয়ার সামরিক সহযোগিতাও হ্রাস পেয়েছিল। সিরিয়া সরকারের আর্থিক সংকটও এর সঙ্গে ছিল যুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক নিষেধাজ্ঞার কারণে সিরীয় সরকার চরম আর্থিক সংকটে ছিল। এমনকি শেষ দিকে এসে সামরিক বাহিনীর বেতনও ঠিকমতো দিতে পারেনি। রাশিয়া ও ইরানের যোদ্ধারা পিছু হটায় বাশারের বাহিনীর মনোবল ভেঙে যায়। এভাবেই মূলত সিরিয়ার রাজনীতিতে বাশার আল আসাদের পতন ঘটে।
২০১১ সালে পুরো মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাজুড়ে যে গণআন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো তা ‘আরব বসন্ত’ হিসেবে অভিহিত করেছিল। আরব অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে একনায়কতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাক্স্বাধীনতা প্রভৃতির দাবিতে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে তিউনিশিয়ার শাসক বেন আলীর পতনের মধ্য দিয়ে আরব বসন্তরের সূচনা হয়েছিল। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে স্ফুলিঙ্গের মতো তা গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ও উত্তর আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে। একে একে পতন হয় লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি, মিসরের হোসনি মোবারক, ইয়েমেনের আলী আবদুল্লাহ সালেহের মতো দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা শাসকদের। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে ২০১১ সালের মার্চে আন্দোলন শুরু হয়। আরব বসন্ত থেকে সৃষ্ট বা’আস শাসন বিরোধী এই বিদ্রোহ প্রায় ১৩ বছর ধরে চলেছিল। শুরুটা হয়েছিল দেশের শাসনকাঠামোর বিরুদ্ধে জনগণের, বিশেষত বেকার তরুণদের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ থেকে। বাশার আল আসাদের ক্ষমতা গ্রহণের আগে থেকেই তরুণদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, দুর্নীতি, রাজনৈতিক ও বাক্স্বাধীনতার অভাববোধ থেকেই তুমুল অসন্তোষের জন্ম হয়েছিল, যা উসকে দেয় আরব বসন্ত। তরুণদের সেই প্রতিবাদ দমাতে দেশটির প্রেসিডেন্ট কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করায় অশান্তি ও সংঘাত দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এই সময় কয়েক লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। এতে করে ইতিহাসের ভয়াবহতম মানবিক সংকট সৃষ্টি হয় সিরিযায়। সেই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত দেশটিতে চরম বিশৃঙ্খলার জন্ম দিয়েছে। উত্থান ঘটিয়েছে সশস্ত্র নানা গোষ্ঠীর। এই বিক্ষোভ পরবর্তী সময়ে গৃহযুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করে। এতে একে একে জড়িয়ে পড়ে আঞ্চলিক শক্তি থেকে শুরু করে বৈশি^ক পরাশক্তিগুলো। যদিও ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে শক্ত হাতে ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন বাশার আল আসাদ। 
সিরিয়ার সশস্ত্র গোষ্ঠী তাহরির আল শামের হাতে বাথ পার্টির ৬১ বছরের শাসনের অবসান হয়েছে। ১৯৬৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে আরব সোশ্যালিস্ট বাথ পার্টি সিরিয়ার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ১৯৭১ সালে হাফিজ আল আসাদ পার্টির ভেতরে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে আমিন আল হাফিজের নিকট থেকে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। ২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন তার পুত্র বাশার আল আসাদ। তাঁরা আলাউইট শিয়া গোত্রের। যুগের পর যুগ রোমান ও মোঙ্গলদের থেকে শুরু করে ধর্মযোদ্ধা ও তুর্কিদের আক্রমণ এবং দখলের শিকার বিধ্বস্ত একটি দেশ সিরিয়া। মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিতে বিভিন্ন ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। কুর্দি, আর্মেনীয়, অ্যাসিরীয়, খ্রিস্টান, দ্রুজ, আলাউইট শিয়া ও আরব সুন্নিসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মানুষের আবাসস্থল। তবে শিয়া ও সুন্নি গোত্রের মুসলমান দেশটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ।

আধুনিক সিরিয়া ফ্রান্সের নিকট থেকে ১৯৪৬ সালে স্বাধীন হয়। সিরিয়া দক্ষিণ-পশ্চিমে ভূমধ্যসাগরের পূর্বপ্রান্তে আরব উপদ্বীপের উত্তরে পশ্চিম এশিয়ায় উপস্থিত। এর উত্তরে তুরস্ক, পশ্চিমে ও দক্ষিণ-পশ্চিমে লেবানন ও ইসরাইল, পূর্বে ইরাক এবং দক্ষিণে জর্দান সীমান্ত রয়েছে। দেশটি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রবিরোধী এবং ইরান-হিজবুল্লাহ-হামাস জোটের শক্তিশালী অংশীদার। বহু বছর ধরে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অজুহাতে সিরিয়ায় সামরিক উপস্থিতি বজায় রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন সরকার বিরতিহীনভাবে দেশটির বিভিন্ন সম্পদ লুট করে চলেছে বলে ইরান অভিযোগ করেছে। জাতিসংঘে নিযুক্ত ইরানের স্থায়ী প্রতিনিধি আমির সায়িদ ইরাভানি নিরাপত্তা পরিষদের এক অধিবেশনে সিরিয়া থেকে শীঘ্রই ও বিনাশর্তে সকল মার্কিন সৈন্য সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। সিরিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য বিষয়টি জরুরি বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, মার্কিনিরা সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে লড়াইয়ের পরিবর্তে ‘জিবহাতুন নুসরার’ মতো সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এবং সিরিয়ার জনগণের তেল ও অন্যান্য সম্পদ লুট করছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারসহ কোনো কোনো পশ্চিমা সরকার সিরিয়ায় সংঘাত দীর্ঘ করার জন্য দায়ী মন্তব্য করে তিনি বলেন, এই সরকারগুলো সিরিয়ার জনগণের ওপর তাদের ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। তিনি সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, ঐক্য ও ভৌগোলিক অখ-তা রক্ষা করাকে সবার দায়িত্ব হিসেবে জোর দিয়ে বলেছেন, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, বিদেশীদের দখলদারিত্ব এবং অবৈধ নিষেধাজ্ঞা থেকে উদ্ভূত অর্থনৈতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সিরিয়ার জনগণকে পরিত্রাণ করা আন্তর্জাতিক সমাজের উচিত নয়। সিরিয়ার সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ইসরাইলের অব্যাহত আগ্রাসন এবং সেখানকার বেসামরিক জনগণের ওপর এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগুলোর ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানায় ইরান। রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ছাড়াও সিরিয়ার পুনর্গঠন ও বিদেশ থেকে সিরীয় শরণার্থীদের নিরাপদে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন এবং ঘরোয়া পর্যায়ে শরণার্থী হওয়া সিরীয়দের নিজ নিজ অঞ্চলে পুনর্বাসনের মতো ক্ষেত্রগুলোতে আন্তর্জাতিক সহায়তার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকা প্রয়োজন। 
বাশার আল আসাদ সরকারকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছিল রাশিয়া ও ইরান। ইরাক, আফগানিস্তান, ইয়েমেনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অনেকেই সিরিয়ায় গিয়ে বাশারের পক্ষ হয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানিসহ পশ্চিমা দেশগুলো আসাদ সরকারবিরোধী। তাদের সঙ্গে তুরস্ক, সৌদি আরব, কাতারসহ অনেক আরব দেশ রয়েছে। জেরুজালেমভিত্তিক ইসরাইল সামরিক ওয়েবসাইট ‘ডিইবিকেএ ফাইল’ একটি তথ্য প্রকাশ করে উল্লেখ করে যে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, তুরস্ক, ইতালি সিরীয় বিদ্রোহীদের সামরিক বিশেষজ্ঞ, অস্ত্রশস্ত্র এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি সরবরাহের মাধ্যমে সহায়তা দিয়েছিল। তুরস্কে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করে সেখানে বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ দিত। এ সকল বিদ্রোহীর মধ্যে ছিল সিরীয় সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য, আসাদ সরকারবিরোধী কয়েকটি গ্রুপ এবং বিদেশী যোদ্ধা। কুর্দি ও আসাদ সরকারবিরোধী সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সের (এসডিএফ) সহায়তার জন্য ২০১৪ সাল থেকেই পশ্চিমারা সিরিয়ায় বিমান হামলা অব্যাহত রেখেছিল। ইরানের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইসরাইলও সঙ্গত কারণে পশ্চিমা জোটের সঙ্গে রয়েছে। বিংশ শতাব্দীর পুরোটা সময় মধ্যপ্রাচ্যে সংকট যত বেশি আলোচিত হয়েছে, অন্য কোনো সংকট এত বেশি আলোচনায় আসেনি। মধ্যপ্রাচ্য সংকট মূলত কেন্দ্রীভূত ছিল আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ইসরাইলের দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে। অনেকটা এই দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে হানটিংটন তাঁর বিখ্যাত তত্ত্ব ‘সভ্যতার দ্বন্দ্ব’ উপস্থাপন করেছিলেন। ফিলিস্তিন-ইসরাইল দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে তিনটি যুদ্ধের জন্ম হয়েছিল। যদিও সব  যুদ্ধে আরব রাষ্ট্রগুলো হেরে গিয়েছিল। 
২০১১ সালে গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলনকারীদের ওপর বাশার আল আসাদ সরকারের সহিংস হামলার পর শুরু হওয়া সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে ৫ লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। আসাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছেন। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ইরাকের মতো সিরিয়ায় একটি সামরিক আগ্রাসনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। লিবিয়ার গাদ্দাফির পতনের পর যক্তরাষ্ট্রসহ তার পশ্চিমা মিত্ররা ভেবেছিল, আরব বসন্তের ঢেউকে ব্যবহার করে সিরিয়াতেও তারা সফল হবেন। ২০১১ সালের অক্টোবর ও ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সিরিয়ার বিপক্ষে তারা দুটি প্রস্তাব উত্থাপন করে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল সিরিয়ায় নো ফ্লাই জোন প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু রাশিয়া ও চীনের ভেটো প্রদানের কারণে প্রস্তাব দুটি নিরাপত্তা পরিষদে পাস হয়নি। শেষ পর্যন্ত একটি সমঝোতা এবং সিরিয়া তার কাছে সংরক্ষিত সকল ধরনের রাসায়নিক অস্ত্র আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে ধ্বংস করার প্রতিশ্রুতি দিলে শেষ পর্যন্ত সেখানে যুদ্ধ এড়ানো গিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে ইরানকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে তারা চায় সিরিয়ায় ইরানি প্রভাবমুক্ত শাসন প্রতিষ্ঠা করা। লিবিয়ার মতো ন্যাটোকে ব্যবহার করে সিরিয়ায়ও আঘাত হানার চেষ্টা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সফল না হয়ে তারা বিদ্রোহীদের অস্ত্র, অর্থ ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।

২০২০ সালে তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যস্থতায় ইদলিবে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করেছিল সিরিয়া সরকার। এরপর সহিংসতা একরকম থেমে গেলেও মাঝেমধ্যে এ অঞ্চলে সংঘর্ষ, বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণের খবর পাওয়া যেত। তবে বুধবার এইচটিএস ও মিত্ররা নতুন করে অভিযানের ঘোষণা দেয়। তারা সরকার ও মিত্র মিলিশিয়াদের ওপর অঞ্চলটিতে উত্তেজনা বাড়ানোর অভিযোগ তোলে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, বিদ্রোহীরা দ্রুত অগ্রসর হয়েছে। কারণ, সিরিয়ার মিত্র ইরান ও হিজবুল্লাহ ইসরাইল হামলায় দুর্বল হয়ে পড়েছে। গাজা ও লেবাননের যুদ্ধ সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে নতুন করে সংঘাতের প্ররোচনা দিচ্ছে বলে গত মাসে সতর্ক করেছিল সিরিয়ায় নিযুক্ত জাতিসংঘের বিশেষ দূত গেইর পেডারসেন। তিনি জানান, সরকার নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোতে বড়সড় আক্রমণ চালিয়েছে এইচটিএস। এর জবাবে রাশিয়া কয়েক মাস পর আবার বিমান হামলা শুরু করেছিল রাশিয়ায়। আর সিরিয়ার সামরিক বাহিনী তাদের ড্রোন হামলা ও গোলাবর্ষণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়িয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পতন ঠেকানো সম্ভব হয়নি।
এদিকে গত এক বছরে কয়েক দফায় ইসরাইলের আগ্রাসনের শিকার হয়েছে সিরিয়া। লেবাননে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরপরই নতুন করে দেশটিতে হামলার হুঁশিয়ারি দিয়েছিল ইসরাইল। লেবাননের হিজবুল্লাহকে সহায়তার অভিযোগ তুলে সম্প্রতি সিরিয়ায় হামলার মাত্রাও বৃদ্ধি করেছিল দেশটি। ইসরাইল বলছে, হিজবুল্লাহ এখন সামরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। তেল আবিব হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, এমন অবস্থায় যদি হিজবুল্লাহকে আবারও শক্তিশালী হতে আসাদ সরকার যদি সহায়তা করে, তবে সিরিয়াকে চরম মূল্য দিতে হবে। আইডিএফের মুখপাত্র ড্যানিয়েল হ্যাগারি বলেছেন, হিজবুল্লাহর কাছে অস্ত্র সরবরাহের সকল ধরনের প্রচেষ্টাকে রুখতে আমরা সিরিয়া ভূখ-ে হামলা চালাব। গোষ্ঠীটিকে অস্ত্র সরবরাহের কোনো প্রচেষ্টা যদি তাদের নজরে আসে, সঙ্গে সঙ্গেই পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে তিনি জানান। হিজবুল্লাহর পুনর্গঠনে সিরিয়া সহায়তা করলে তাদের মূল্য দিতে হবে। ১৩ বছরের বেশি সময় ধরে গৃহযুদ্ধে জর্জরিত সিরিয়ায় লাখ লাখ মানুষ মানবেতর জীবন কাটাচ্ছিল। ২০১১ সালে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রীপন্থি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র মদত দিতে শুরু করেছিল। পরবর্তী সময়ে ইসলামিক স্টেটস (আইএস) জঙ্গিদের মোকাবিলায় পূর্ব সিরিয়ার ডেইর আজ-জাওয়ার প্রদেশ এবং উত্তর-পূর্বের হাসাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় সেনা মোতায়েন করেছিল পেন্টাগন। 
২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের পর সিরিয়া থেকেও বেশ কয়েকটি ঘাঁটি সরিয়ে নিয়েছিল বাইডেন প্রশাসন। সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যসহ আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলেছে। এই সুযোগকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশসমূহ- ইসরাইল, তুরস্কসহ পশ্চিমা বিশ^ সিরিয়ার ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব নিশ্চিত করার বিষয়ে তৎপর। বাশার আল আসাদ সরকারের পতনের পরপরই সিরিয়া নিয়ন্ত্রিত গোলান মালভূমি দখল করে নিয়েছে ইসরাইল। সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্রদের কৌশলগত সুবিধা হচ্ছে, সিরিয়া হয়ে লেবাননে হিজবুল্লাহ ও ফিলিস্তিনে হামাসের সহায়তা বন্ধ করা যাবে। ইসরাইল বলে রেখেছে, সিরিয়া আল কায়েদা দখল করে নিয়েছে এবং নিরাপত্তার জন্য ইসরাইল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত। সিরিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য রাশিয়া জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে জরুরি বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছে। এদিকে বাশারের পতনের পর মার্কিন বাহিনী সিরিয়ায় বিমান হামলা চালিয়েছে। আইএস গোষ্ঠীর স্থাপনা লক্ষ্য করে এসব হামলা চালানো হয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে। আসাদ সরকারের পতন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এক নতুন পালাবদল এনে দেবে। এর ফলে ইরান, ফিলিস্তিন, ইসরাইল, লেবানন, ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর রাজনীতি নতুন রূপ ধারণ করবে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

জোবায়ের আহমেদ

×