ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথের শুভ বিবাহ

স্বপন কুমার দাস

প্রকাশিত: ১৯:১২, ৮ ডিসেম্বর ২০২৪

রবীন্দ্রনাথের শুভ বিবাহ

ব্রিটিশ শাসিত ভারতে যশোর ছিল একটি সমৃদ্ধ মহকুমা। শিক্ষা-দীক্ষা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে তখন যশোরের বেশ নামডাক ছিল। এ মহকুমারই শেষপ্রান্তে ফুলতলা ছিল একটি বর্ধিষ্ণু জনপদ। এ জনপদের একটি গ্রাম দক্ষিণডিহি। সৌম্য শান্ত নিরিবিলি এ গ্রামেরই এক বালিকাকে বিয়ে করে রবীন্দ্রনাথ তার প্রলম্বিত কুমার জীবনের অবসান ঘটান। কবিগুরুর শ্বশুরবাড়িটি আজও অক্ষত রয়েছে এ গ্রামে। এ বাড়িকে কেন্দ্র করেই প্রতিবছর কবিগুরুর জন্মজয়ন্তী উদ্যাপন করা হয়। বসে মেলা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষরা পীরালি করতেন। কিন্তু অর্থবিত্ত আর ক্ষমতা থাকার কারণে তারা নিজেদের মতো করে চলতে পারতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিগ্রহ পূজা পরিত্যাগ করে নিরাকার ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করায় পুত্রদের জন্য পুত্রবধূ এবং কন্যাদের জন্য জামাতা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তাই পীরালিরা নিজেদের মধ্যে, এমনকি নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য হয়েছিলেন।
সেকালে ঠাকুরবাড়ির পুত্রদের ১৯-২০ এবং কন্যাদের ১২-১৩ বছর বয়সের মধ্যে বিয়ে হতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অত্যন্ত সুপুরুষ। দেশ-বিদেশের বাঙালি-অবাঙালি পরিবারের বহু পাত্রীর সঙ্গে তার বিয়ের কথাবার্তা হলেও শেষ পর্যন্ত কোনো সম্বন্ধই স্থির হয়নি। ওইসব কারণে রবীন্দ্রনাথকে ২৩ বছর বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। শেষমেশ ঠাকুরদের এস্টেটের কর্মচারী দক্ষিণডিহি নিবাসী বেণীমাধব রায় চৌধুরীর ৯ বছর ৯ মাস বয়সী কন্যা ভবতারিণী দেবীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বাংলা ১২৯০ সনের ২৪ অগ্রহায়ণ (৯ ডিসেম্বর, ১৮৮৩) জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে এ বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের পর ঠাকুরবাড়ির রীতি অনুযায়ী ভবতারিণী দেবীর নতুন নামকরণ হয় মৃণালিনী দেবী।
কনে দেখা উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ, দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, বউদি জ্ঞানদা নন্দিনী ও কাদম্বরী দেবী, ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীসহ আত্মীয়-অনাত্মীয় নিয়ে খুলনার ফুলতলার দক্ষিণডিহিতে আসেন। পাত্রী দেখে রবীন্দ্রনাথ বিয়ের সম্মতি দেন। প্রাথমিক আশীর্বাদপর্ব শেষে তারা কলকাতা ফিরে যান। পাত্রী দেখা উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ দক্ষিণডিহি এসেছিলেন, সে কথাটি কোথাও উল্লেখ করেননি। তবে ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবী তার স্মৃতিকথায় তা লিখে যান।
রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হয়েছিল সাদামাটাভাবেই। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির বসার ঘরটি সাজানো হয়েছিল বিয়ের জন্য। বাসরঘর বসে তিনতলায়, যা আগে থেকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের মা সারদাসুন্দরী দেবী নিজ ছোট পুত্রের বিয়ে দেখে যেতে পারেননি। পিতা  দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কনিষ্ঠ পুত্রের বিয়ের সময় মুশৌরিতে অবস্থান করছিলেন। পারিবারিকভাবে বিয়ের কোনো নিমন্ত্রণপত্র ছাপানো হয়নি। তাই কবি নিজ হাতে দুলাইন লিখে ঘনিষ্ঠজনদের মাঝে নিমন্ত্রণপত্র বণ্টন করেছিলেন। তবে বিয়েতে বিভিন্ন পদের খাবারের আয়োজনের কমতি ছিল না। ৬০ প্রকার পদ দিয়ে আমন্ত্রিত অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয়েছিল।
ফুলতলা দক্ষিণডিহি গ্রাম নিবাসী বেণীমাধব রায় চৌধুরীর প্রায় দশ বছর বয়স্ক বালিকা ভবতারিণী, ঠাকুরবাড়িতে যার নামকরণ হয় মৃণালিনী দেবী, বিয়ের পর রবীন্দ্রনাথের মতো বড় মাপের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছিলেন নিজ সহজাত প্রতিভার গুণে। ঠাকুরবাড়ি এসে তিনিও ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন এবং ঠাকুরবাড়ির আদবকায়দা রপ্ত করেছিলেন। ক্রমে তিনিও এক অসাধারণ নারী হয়ে উঠেছিলেন। ভবতারিণীর সঙ্গে বিয়ের সময় ছোট ভাই নগেন্দ্রনাথ রায় ঠাকুরবাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলেন। পরে রবীন্দ্রনাথ জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব পেলে শ্যালক নগেন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়ে যান। নগেন্দ্রনাথই জমিদারির আয়-ব্যয়ের হিসাব-নিকাশ রাখতেন।
নগেন্দ্রনাথ রায় ঠাকুরবাড়িতে থাকা-খাওয়ার সুবাদে তাদের রুচি ও আভিজাত্য সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি দক্ষিণডিহিতে একটি সুরম্য বাড়ি নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। রবীন্দ্রনাথও চাচ্ছিলেন দক্ষিণডিহিতে তার নামের সঙ্গে মানানসই একটি বাড়ি নির্মিত হোক। তিনি গোপনে নগেন্দ্রনাথকে এ জন্য এক হাজার টাকা দান করেন। অবশেষে তিনি ১৮৯০ সালে প্রায় এক বিঘা সম্পত্তির ওপর একটি দ্বিতল বাড়ি নির্মাণ করেন। বাড়িটি নির্মিত হলে এটি রায় বাড়ি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। কবির শাশুড়ি দাক্ষায়ণী দেবী মাঝে মধ্যে এ বাড়িতে এসে থাকতেন। রবীন্দ্রনাথ দেশের বাইরে গেলে কবিপত্নীও সন্তানদের নিয়ে এ বাড়িতে এসে থাকতেন। বাকি সময় বাড়িটি অব্যবহৃত পড়ে থাকত। বাড়িটির নিচতলায় একটি বড় কক্ষ এবং দোতলায় তিনটি কক্ষ আছে। বাড়ির ভেতর দিয়ে ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি বর্তমান। ছাদ থেকে পুরো গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। এক কক্ষ বিশিষ্ট রান্না ঘরটি রয়েছে মূল ভবন থেকে সামান্য দূরে। বাড়িটির সামনে রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনী দেবীর আবক্ষ ভাস্কর্য বর্তমান।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর দক্ষিণডিহি গ্রামের রামনারায়ণ রায় চৌধুরীর কন্যা শাকম্ভরী দেবীকে (পরে সারদাসুন্দরী দেবী) বিয়ে করেন। সে কারণে দক্ষিণডিহি রবীন্দ্রনাথের মাতুলালয়ও বটে। মাতুলালয় থাকার কারণে রবীন্দ্রনাথ শৈশবে একবার দক্ষিণডিহি আসেন। পরে মেয়ে দেখা উপলক্ষে তিনি আরেকবার আসেন। জনশ্রুতি আছে, বিয়ের পর কবি আরও একবার দক্ষিণডিহির শ্বশুরবাড়িতে আসেন। তবে জমিদারি থাকার কারণে তার সঙ্গে শিলাইদহ, শাহজাদপুর, পতিসরের যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এবং এসব স্থানে থেকে তিনি যেসব সাহিত্যকর্ম রচনা করেছিলেন, দক্ষিণডিহির ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটেনি। নগেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী মাঝে মধ্যে দক্ষিণডিহি এসে জমিজমার খোঁজ নিতেন। ’৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর তিনিও আর আসেননি। ’৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর তাদের আত্মীয়স্বজনরাও নানা কারণে দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান। ফলে রবিঠাকুরের শ্বশুরবাড়িসহ জায়গাজমি অরক্ষিত পড়ে থেকে এক সময় বেদখল হয়ে যায়। ইতিহাস থেকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসে দক্ষিণডিহি।
শেষমেশ এগিয়ে আসেন ফুলতলার সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মীরা। তারা বাড়িটি দখলমুক্ত করে একে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র (রবীন্দ্র কমপ্লেক্স) করার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলেন। দক্ষিণডিহি নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি, স্মারকলিপি প্রদান, মানববন্ধন ইত্যাদি কর্মসূচি তারা পালন করেন। তারা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে প্রতিবছর দক্ষিণডিহিতে কবিগুরুর জন্মজয়ন্তী ঘটা করে উদ্যাপন শুরু করেন। এ আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন মানিক সাহা, অধ্যাপক মু. কায়কোবাদ, খেলাফত হোসেন বাচ্চু, মুস্তাফিজুর রহমান, দেবরঞ্জন সেন, আবদুর রাজ্জাক রাজা, শেখ লুৎফর রহমান, বিধান দাশগুপ্ত প্রমুখ।
অবশেষে টনক নড়ে প্রশাসনের। এগিয়ে আসেন খুলনার জেলা প্রশাসক কাজী রিয়াজুল হক। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ৪০ বছর পর দখলমুক্ত হয় রবীন্দ্র-মৃণালিনী স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি। ১৯৯৫ সালের ১৪ নভেম্বর তিনি বাড়িটির দ্বার উন্মোচন করেন। এরপর স্থানীয় রবীন্দ্রপ্রেমীদের উদ্যোগে প্রতিবছর এ বাড়ির আঙ্গিনায় ধুমধামের সঙ্গে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উদ্যাপন শুরু হয়। মেলা বসে। প্রথমে দিনব্যাপী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯৯ সালে দক্ষিণডিহি বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি লাভ করে। শিলাইদহ, পতিসর, শাহজাদপুরের পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে দক্ষিণডিহিতে উদ্যাপন শুরু হয় রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী।
২০১৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব ড. মোহাম্মদ আলী সরকারি কাজে খুলনা আসেন। কাজ শেষে তিনি যশোর বিমানবন্দরে যাচ্ছিলেন ঢাকা ফেরার জন্য। ড. মোহাম্মদ আলীর  সুলেখক ও গবেষক হিসেবে সুখ্যাতি আছে। তিনি যশোর বিমানবন্দর যাওয়ার পথে গাড়ি ঘুরিয়ে দক্ষিণডিহি রবীন্দ্রনাথের শ^শুরবাড়ি দেখার জন্য রওনা হন। ঘুরে ঘুরে পুরো বাড়ি দেখেন তিনি। বাড়ির সামনে খালি জায়গায় পাপড় ভাজতে দেখে বাড়িটি সংরক্ষণ করার জন্য এর চারপাশ দিয়ে একটি উঁচু প্রাচীর নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। বাড়িটি রবীন্দ্রনাথের বইপত্র দিয়ে আকর্ষণীয় করার জন্য একটি প্রকল্প দেওয়ার জন্য তৎকালীন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ডিজি শিরিন আখতারকে বলেন। ডিজি অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প পেশ করলে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ হয়। এখন বাড়িটি সংরক্ষিত আছে এবং নিচতলা ও উপরতলা রবীন্দ্রনাথের দুর্লভ বই ও ব্যবহার্য জিনিস দিয়ে সাজানো হয়েছে দর্শণার্থীদের জন্য।
লেখক : সাংবাদিক
[email protected]

×