একটি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের মধ্যে অন্যতম হলো তার নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। জন নিরাপত্তা কেবল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয় নয়, বরং এটি একটি সমাজের শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের ভিত্তি। বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় এই বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। বাংলাদেশের জন নিরাপত্তার চিত্র যদি আমরা পর্যবেক্ষণ করি, তবে দেখা যাবে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের অপরাধ যেমন ছিনতাই, খুন, নারী নির্যাতন, মাদক ব্যবসা এবং সাইবার অপরাধের খবর আমাদের সামনে আসে। এসব অপরাধের কারণে নাগরিকদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘিœত হচ্ছে এবং নিরাপত্তার বিষয়ে একটি বড় প্রশ্ন চিহ্ন তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে, আমরা কি আজ নিরাপদ? জন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমাদের কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত?
স¤প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারি, দেশের জন নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা দুর্বল। গত ৩ নভেম্বর নিখোঁজ হওয়া সিলেটের ছোট মেয়েটি মুনতাহার লাশ ১০ নভেম্বর উদ্ধার করা হয়। এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ এবং আইন-শৃঙ্খলার অবস্থা সম্পর্কে বড় ধরনের প্রশ্ন তোলে। এটি শুধুমাত্র একটি ঘটনা নয়, বরং প্রতিদিন দেশে এমন আরও অনেক ঘটনা ঘটে যা জন নিরাপত্তার সংকটকে তুলে ধরে। রাস্তার নিরাপত্তার বিষয়টিও আজ বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারীরা রাস্তায় চলাচলের সময় যৌন হয়রানি, বাজে মন্তব্য এবং বিভিন্ন ধরনের অবমাননার শিকার হন। গণপরিবহনে এমনকি রিকশায় বা অটোতে চলাচলের সময়ও নারীদের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে পুরুষ যাত্রীরা অসদাচরণ করেন, যা নারীদের জন্য রাস্তায় চলাফেরা আরও কঠিন করে তোলে। ফলে নারীরা বাইরে চলাচল করতে ভয় পান এবং তাদের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হয়।
তবে অপরাধ কেবল রাস্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বর্তমান সময়ে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসারের ফলে অপরাধের একটি নতুন ধারা দেখা দিয়েছে—সাইবার ক্রাইম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য চুরি, প্রতারণা, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হ্যাকিং, এবং গুজব ছড়ানো আজ খুব সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব অপরাধ কেবল ব্যক্তিগত ক্ষতি করছে না, বরং সমাজে অস্থিরতা এবং অনিরাপত্তার সৃষ্টি করছে।
একটি সমাজে আইন এবং এর যথাযথ প্রয়োগ জন নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রধান হাতিয়ার। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রেই এই প্রয়োগ সঠিকভাবে হচ্ছে না। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রায়ই দুর্নীতি বা রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কার্যকর ভ‚মিকা পালন করতে ব্যর্থ হতে দেখা যায়। অপরাধীরা অনেক সময় শাস্তি এড়িয়ে যায় এবং একই ধরনের অপরাধ আবারও ঘটায়। বিচার ব্যবস্থার ধীরগতি এবং আইনের ফাঁকফোকর অপরাধীদেরকে আরও সাহসী করে তোলে। জন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মাদক নিয়ন্ত্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মাদকের ব্যবহার এবং পাচার সমাজের যুব সমাজকে ধ্বংস করছে। সীমান্ত এলাকায় মাদকের প্রবাহ রোধে শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে, মাদকাসক্তদের পুনর্বাসনের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
দেশের জন নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নারীর প্রতি সহিংসতা একটি গুরুতর সমস্যা। নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে প্রচলিত আইনগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী হলেও এর প্রয়োগ প্রায়শই প্রশ্নবিদ্ধ। ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, এবং পারিবারিক সহিংসতার মতো অপরাধ প্রতিরোধে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ানো জন নিরাপত্তার আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। গুজবের কারণে সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি বিঘিœত হয় এবং সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। তাই সাইবার অপরাধ দমন এবং গুজব রোধে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। জন নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে পারে। সিসিটিভি ক্যামেরা, ড্রোন এবং অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধ পর্যবেক্ষণ এবং প্রতিরোধ করা সম্ভব। দেশের প্রধান শহরগুলোতে এমন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো উচিত। এছাড়া, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য তাদের প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত জ্ঞান বাড়ানো প্রয়োজন।
পুলিশ, র্যাব, এবং বিজিবি’র মতো বাহিনীকে আরও দক্ষ এবং স্বচ্ছ হতে হবে। অপরাধীদের দ্রæত শনাক্ত এবং গ্রেপ্তার করার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরদার করা উচিত। জন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নাগরিক সচেতনতার গুরুত্বও কম নয়। প্রতিটি নাগরিককে আইন মেনে চলতে এবং অপরাধ প্রতিরোধে ভ‚মিকা রাখতে হবে। অপরাধের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি, স্কুল-কলেজ পর্যায়ে জন সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে।
জন নিরাপত্তা একটি রাষ্ট্রের মৌলিক স্তম্ভ। এটি নিশ্চিত করতে না পারলে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার, যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, এবং জীবিকার সুযোগ বাধাগ্রস্ত হয়। একটি নিরাপদ পরিবেশ নাগরিকদের সৃজনশীলতা এবং কর্মদক্ষতা বাড়াতে সহায়ক ভ‚মিকা পালন করে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে জন নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সরকার, এবং নাগরিক সমাজকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এ ছাড়া, জন নিরাপত্তার জন্য প্রণীত আইনগুলো সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। বিচার ব্যবস্থার সংস্কার করে দ্রæত এবং ন্যায্য বিচার নিশ্চিত করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জন নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে নাগরিকদের মধ্যে আস্থা তৈরি করা। এটি কেবল সমাজকে অপরাধমুক্ত করবে না, বরং একটি উন্নত, সভ্য, এবং শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র গঠনে সহায়ক হবে।
দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে আমাদের এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। এ উদ্যোগের মধ্য দিয়ে একটি অপরাধমুক্ত, উন্নত এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। জন নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আমরা একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পারি।
শিক্ষার্থী, রাজশাহী কলেজ