২০১৮ সালে জাতিসংঘের ৭৩ তম সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য অনুযায়ী বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী ১.১ মিলিয়ন। তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো- রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ চলছে ১৯৬৭ সাল থেকে; ২০১৬ সাল পর্যন্ত অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ। এদের মধ্যে সামান্য কয়েকজন-ই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করছে, বাকি সব মিশে গেছে আমাদের বিভিন্ন লোকালয়ে।
সবমিলিয়ে বর্তমানে রোহিঙ্গার মোট সংখ্যা চৌদ্দ লাখ ছুঁই-ছুঁই কিংবা ছাড়িয়েছে। তাছাড়া, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ক্রমাগত চলছেই, যেমনটি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন- "২০২৪ সালের জুন-সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে আট হাজারের মতো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে"। বর্তমানে পুরোনো ও নূতন মিলিয়ে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা বারো লাখের বেশি।
বর্তমানে বাংলাদেশের বেকারত্বের সংখ্যা প্রায় ২৫ লা ৯০ হাজার! অতি ঘনবসতিপূর্ণ বিশাল জনসংখ্যার এই দেশ এমনিতেই ভুগছে বেকারত্বের অভিশাপে, তার ওপর শত বিলিয়ন ডলার ঋণের চাপে নাজেহাল ভঙ্গুর অর্থনীতির এ দেশে অন্য সংস্কৃতি থেকে আসা লক্ষ-লক্ষ রোহিঙ্গা; এ যেন আমাদের জন্য 'মরার উপর খাঁড়ার ঘাঁ'! রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দীর্ঘদিনের উপস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য মারাত্মক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আইন-শৃঙ্খলার অবনতি:
গত আট বছরে অপরাধের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে উখিয়া-টেকনাফে রোহিঙ্গা ক্যাম্প। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গারা নিজেদর মধ্যে নানা গ্রুপ, উপ-গ্রুপে বিভক্ত হয়ে হত্যা, ধর্ষণ, মানব পাচার, অপহরণ, মারামারি, চুরি, ডাকাতি, মাদক ব্যবসার মতো অপরাধে জড়িয়েছে। মূলত মাদক-বাণিজ্য ও এর টাকা ভাগাভাগিতে প্রাধান্য বিস্তার-ই এসকল অপরাধ জন্ম দিচ্ছে। এছাড়া, স্থানীয় বাসিন্দাদের বাড়িতে চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, অপহরণ এবং অপহরণের পর মুক্তিপন আদায়ও চলছে হর-হামেশা। রোহিঙ্গা-সৃষ্ট অস্ত্র ও মাদক কারবারে সয়লাব পার্শবর্তী এলাকাসমূহ। রোহিঙ্গাদের এসকল অপরামূলক কার্যে কোনঠাসা ও আতঙ্কিত স্থানীয় বাসিন্দারা; এ যেন নিজেদের ঘরেই পরদেশী স্থানীয়রা! শুধু তাই নয়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশ ও র্যাবের ওপর অতর্কিত হামলা সহ ছোট-বড় ৫৬ বার গোলাগুলির মতো আপরাধ সংঘটিত করেছে। ২০১৭ সালের আগস্ট হতে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত আট বছরে মোট ৩ হাজার ৮৭৪টি মামলায় আসামি হয়েছে ৮ হাজার ৬৮৯ রোহিঙ্গা; যার মধ্যে ৬৪ শতাংশ মাদক মামলা যার সংখ্যা ২৪৭৯টি, হত্যা মামলা ২৩৩টি, অস্ত্র মামলা ৪০৯টি, ধর্ষণ মামলা ১০৭, অপহরণ ১০৪, ফরেনার্স ট্যাক্ট ৪২, মানব পাচার মামলা হয়েছে ৩৮টি, ডাকাতি ৬২টি, বিশেষ ক্ষমতা আইনে ৭৬টি এবং অন্যান্য মামলা হয়েছে ৩১৪টি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির কুতুপালংসহ উখিয়া-টেকনাফের অন্যান্য শিবিরগুলো এখন অপরাধের প্রতিষ্ঠিত স্বর্গরাজ্য!
বৈদেশিক সহায়তা হ্রাস ঔ অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ:
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আবাস্থল নির্মাণে উজাড় হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার একর সংরক্ষিত বনভূমি; ফলে জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী ৩৯৭ কোটি ১৮ লাখ ৩৭ হাজার ৩৯৩ টাকার সমপরিমাণ জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয়েছে। দীর্ঘসময়ে শরণার্থীদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি এবং বিদেশি সাহায্য কমে আসায় বাংলাদেশ সরকারের ব্যয়ের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বছরে রোহিঙ্গা খাতে গড়ে সরকারের ব্যয় প্রায় ১২০ কোটি টাকা; যা আমাদের অর্থনীতিতে বিরাট প্রতিবন্ধক।
২০১৭ সালে ৩৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার চেয়ে পাওয়া গিয়েছিলো ৩১৪.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার; ২০১৮ সালে ৯৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার চেয়ে পাওয়া গিয়েছিলো ৬৮৮.১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার; ২০১৯ সালে ৯২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার চেয়ে পাওয়া গিয়েছিলো ৬৯২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার; ২০২০ সালে ১০৫৮ মিলিয়ন ডলার চেয়ে পাওয়া গেছে ৬৮৪ মিলিয়ন ডলার; ২০২১ সালে ৯৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার চেয়ে পাওয়া গেছে ৬৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার; ২০২২ সালে ৮৮১ মিলিয়ন ডলার সহায়তা চায়ে পাওয়া গেছে ৬০৫ মিলিয়ন মার্কি ডলার; এবং ২০২৩ সালে ৯২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার চেয়ে পাওয়া গিয়েছিলো ৪৩২.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এথেকে সহজেই বোঝা যায়, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিপরীতে বৈদেশিক অনুদান ক্রমান্বয়ে কমছে, বাংলাদেশের হাজার-হাজার কোটি টাকা ব্যায় হচ্ছে রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায়। বিশাল অঙ্কের এ চাহিদা মেটাতে বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত বাংলাদেশকে আরো বশি বৈদেশিক ঋণ গ্রহণে বাধ্য হচ্ছে। ১০০ বিলিয়ন ডলারের ঋণে জর্জরিত বাংলাদেশের পক্ষে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রতি বছর কোটি-কোটি ডলার ব্যয় বিরাট অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সার্বভৌমত্বের হুমকি:
সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামকে ভারতের অন্তর্ভুক্তির লালসার একটি ভিডিও নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বইতে দেখছি। এটা কি শুধুই লালসা নাকি রূপ নিতে পারে পরিকল্পনায়, এখনই সময় ভেবে দেখার। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশেপাশের এলাকাসমূহে বাংলাদেশিরা ইতোমধ্যে সংখ্যালঘুর তকমা ও চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তাছাড়া, রোহিঙ্গা সম্প্রদায় অতীব নিপীড়নের শিকার হলেও তাদের খুব-একটা নিষ্পাপ কিংবা দরবেশ ভাবার কোন সুযোগ নেই; অস্ত্র ও মাদক বাণিজ্য তাদের অনেকেরই পেশা। বাংলাদেশের মরণনেশা ইয়াবার সরবরাহকারী কিন্তু এই রোহিঙ্গা সম্প্রদায়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রতি পিস ইয়াবা পাওয়া যায় ২০-২৫ টাকায়! প্রতিবেশি দেশ ভারত চট্টগ্রামের শিল্প, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, অপার পর্যটন সম্ভাবনা, বিশাল সমুদ্রসীমার লালসা ও নিজেদেল রাষ্টের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর করতে এই বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে উস্কে চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্নের মাস্টারপ্ল্যান করলে তাতে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। আর চট্টগ্রাম বেহাত মানে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৮০ শতাংশ, শিল্প উৎপাদনের ৪০ শতাংশ এবং কর রাজস্বের ৫০ শতাংশ নেই, বিশ্বের সবচেয়ের বড় সমুদ্র সৈকত নেই, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বিমান ঘাঁটি, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গ্যারিসন এবং বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের বৃহত্তম ঘাঁটি নেই! তাছাড়া চট্টগ্রাম হাতছাড়া মানে বঙ্গোপসাগরের বিশাল সীমানা হারাবে বাংলাদেশ। তাই চট্টগ্রামে রোহিঙ্গা শিবিরে এবং এর আশপাশে প্রশিক্ষিত রোহিঙ্গা যোদ্ধা এবং তাদের অস্ত্রের উত্থান ও বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ হতে চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করার মাস্টারপ্ল্যান করতেই পারে ভারত; কারণ, এতে বাংলাদেশের যত ক্ষতি ভারতের লাভ তার চেয়ে বেশি! তাছাড়া, এটা ভুললেও চলবেনা যে, আগ্রাসী মনোভাবাপন্ন মিয়ানমার বাহিনীর নিশ্বাস সর্বদাই অনুভূত হয় বাংলাদেশের ঘাড়ে।
ভূ-রাজনীতির গ্যাঁড়াকলে বাংলাদেশ:
রোহিঙ্গা প্রত্যার্বনে মিয়ানমারের পক্ষে চীনের নির্লজ্জ অবস্থান ও ভারতের সদিচ্ছার অভাব এবং জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের অকার্যকরতার কারণ বুঝতে আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রতিবেশী দেশসমূহের আন্তদেশিয় সম্পর্ক বুঝতে হবে। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ মিয়ানমার, চীন ও ভারত উভয়ের সাথে স্থলসীমা সংযুক্ত। দীর্ঘ সময়ের সামরিক শাসন ও রাজনৈতিক দলসমূহের ক্রোন্দলে উত্তাল মিয়ানমারে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও বাণিজ্যে একক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছে চীন। চীনের এই প্রভাবে মিয়ানমারের আস্থা ধরে রাখতেই জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের স্বার্থে ভ্যাটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে চীন। অন্যদিকে, মিয়ানমারের রাজনীতিতে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে না পারলেও বাণিজ্যে ঠিকই সুবিধা লুফে নিচ্ছে ভারত। তাছাড়া, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের 'সেভেন সিস্টার্স' নামে খ্যাত অঞ্চলে স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহী দমন ও শৃঙ্খলা রক্ষায় মিয়ানমারের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করা ভারতের জন্য অপরিহার্য। তাই বলা যায়, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভূ-রাজনীতির গ্যাঁড়াকলে বাংলাদেশ।
ক. চীন-মিয়ানমার সম্পর্ক:
১৯৪৯ সালে বার্মা প্রথম অ-কমিউনিস্ট দেশ হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনকে স্বীকৃতি দেয়ার পর ১৯৫০ সালের ৮ জুন, মাও সেতুং আনুষ্ঠানিকভাবে বার্মা ও গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। এর পর হতে নানান করণে মিয়ানমার-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতি-অবনতি ঘটলেও ১৯৮৮ সালে গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভের সহিংস দমন-পীড়নের ফলে ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক ও পশ্চিমা চাপে কোণঠাসা মিয়ানমার চীনের সাথে গভীর কূটনৈতিক ও ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। প্রায় তিন দশক অটুট সম্পর্কের চীন নির্ভর মিয়ানমার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের সাথে কৌশলগত, বাণিজ্যিক ও সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং জাপানের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়নের মাধ্যমে অত্যাধিক চীন নির্ভরতা কমানোর প্রয়াস ঘটায়। কিন্তু, চীন-মিয়ানমার সম্পর্ক এতটাই উষ্ণ যে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একের পর এক ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে অটুট থাকে পক্ষপাৎদুষ্ট চীন। তাছাড়া, ২০২১ সালে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতি দেওয়ার চেষ্টাও ঠেকিয়ে দিয়েছে চীন। এ থেকে মিয়ানমারের সাথে চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কের দৃঢ়তা সহজেই অনুমানযোগ্য।
২০২২-২০২৩ অর্থবছরে চীন এবং মায়ানমারের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ১০ বিলিয়ন ইউএস ডলার ছাড়িয়েছে। যেখানে মিয়ানমারে চীনের রপ্তানি সাধারণত তেল, ইস্পাত এবং টেক্সটাইল পণ্য, অন্যদিকে চীনে মিয়ানমারের রপ্তানি পণ্য প্রাকৃতিক রাবার, কাঁচা কাঠসহ প্রাকৃতিক খনিজ।
খ. চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক:
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সাথে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের কিছু পূর্বে ১৯৬২ সালে -ভারত যুদ্ধের ফলে পাকিস্তানের মিত্রে পরিণত হয় চীন। ফলশ্রুতিতে, ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তান কে সমর্থন করে চীন এবং ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জাতিসংঘ সদস্যপদ পেতে চীন ভেটো দিয়েছিল।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাঁর শাসনামলে চীনের সাথে সামরিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন; তবে রাষ্ট্রপতি হোসেন মোহাম্মদ এরশাদের আমলে বেইজিং-ঢাকা সম্পের্কের পূর্ণতা পায়। এর পর হতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি না ঘটলেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল একমুখী। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার চীন হতে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ১৮.৬ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের পণ্য আমদানির বিপরীতে চীনে রপ্তানি হয় ৬৭৬ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। সংক্ষেপে বলা যায়, এক সময়ের বৈরী মনোভাবাপন্ন চীনের সাথে বাংলাদেশের বর্তমান কূটনৈতিক সম্পর্ক ভালো হলেও এতোটা মজবুত নয় যে চীন মিয়ানমারের স্বার্থ বিরোধী ন্যায় কার্যে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করবে; অন্যদিকে বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্য সম্পর্কে একচেটিয়া লাভবান হচ্ছে চীন।
গ. বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক:
আমাদের স্থলভাগের তিন দিকের প্রায় সবটাই পরিবেষ্টিত প্রতিবেশি দেশ ভারতে সাথে আমাদের স্বাধীনতা পর হতেই দেশটির সাথে কৃতজ্ঞতার কূটনীতি রক্ষা করছে বাংলাদেশ। দেশটির সাথে যেমন রয়েছে অসম বাণিজ্যিক সম্পর্ক, তেমনি রয়েছে কৃতজ্ঞতার কূটনীতিক সম্পর্ক, যেখানে লাভ কেবল এক পক্ষই ভোগ করেন। ভারতীয় সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা, ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তা চুক্তি, তিন বিঘা করিডোর, শিলিগুড়ি করিডোর, অর্থনৈতিক ট্রানজিট ও চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ভারতীয় সহায়তাসহ আরো কিছু স্থায়ী বিরোধ থাকলেও দেশটির প্রতি ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় সহায়তার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ বন্ধুসূলভ কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করে আসছে বাংলাদেশ। ভারত যেমনই একদিকে অসম বাণিজ্যিক সম্পর্কের লাভ ঘরে তুলছে, তেমনই বাংলাদেশের কৃতজ্ঞতার কূটনৈতিক সম্পর্কের ফায়দা লুটছে।
প্রায় ১৬ বিলিয়ন বার্ষিক বাণিজ্যের সম্পর্কে ভারতের রপ্তানি প্রায় ১৪ বিলিয়নের বিপরীতে বাংলাদেশের রপ্তানি কেবল ২ বিলিয়নের মতো। এ থেকে এটা স্পস্ট যে, ভারতের মতো বৃহত রপ্তানিকারক দেশ একক হাতে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে; অবশ্য এতে ভারতকে দোষারোপ করার কিছু নেই, আমাদের উৎপাদন অক্ষমতা জন্যেই ভারতীয় পণ্য আমদানিতে নির্ভর করতে হয় আমাদের।
গত চৌদ্দ বছরে প্রতি বছর গড়ে ১০১২ বাংলাদেশি হত্যা করছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষা বাহিনী (বিএসএফ)। বিগত আওয়ামী সরকারের শাসনামলে এর বিরুদ্ধে লক্ষণীয় রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গ্রনণ করেনি। অন্যদিকে, ফারাক্কা ও তিস্তা বাঁধ যেন বাংলাদেশের মরণ ফাঁদ! খরার মৌসুমে ভারত বাংলাদেশকে পানি বঞ্চিত করছে আবার ভরা মৌসুমে বাঁধ খুলে বন্যার জলে ভাসাচ্ছে। উভয় ক্ষেত্রে কৃষির ব্যপক ক্ষতি হচ্ছে এবং বন্যায় অবকাঠামোসহ জনজীবন বিপন্ন হচ্ছে।
বাংলাদেশ ১৯৭৬ ও ১৯৮৪ সালে যথাক্রমে নেপাল ও ভুটানের সাথে ট্রানজিট চুক্তি করলেও ভারতে ভূ-খন্ড ব্যবহারের অনুমতি না পাওয়ায় চুক্তিসমূহ কার্যকর হয়নি। অথচ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে ভারতকে 'অভ্যন্তরীণ নৌ-ট্রানজিট' দেয় বাংলাদেশ। পরবর্তীতে ২০১০ সালের স্থলপথে ট্রানজিট সুবিধাসহ ২০১৮ সালের চুক্তির ফলে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে সড়কপথে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনেরও অনুমতি পায় ভারত। বর্তমানে পাঁচটি রুটে বাংলাদেশ-ভারত ট্রেন চলাচল করে; যার মধ্যে তিনটি যাত্রীবাহী ইন্টারচেঞ্জ, বাকি দুটি পণ্যবাহী। বলার অবকাশ থাকেনা যে, এসকল ট্রানজিটের একচেটিয়া সুবিধাভোগী দেশ ভারত; লাভ তো দূরের কথা- আর্থিক ক্ষতিসহ, জনবল ব্যয় এবং চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে বাংলাদেশ। ২০১০ সালের চুক্তি অনুযায়ী প্রতি টনে বাংলাদেশ ট্রানজিট ফি পায় মাত্র তিনশ টাকা, যেখানে সংযোগপথ মেরামতসহ টন প্রতি ট্রানজিন ব্যয় ৪৯০ টাকা!
কাজেই, বাংলাদেশের সাথে অসম-বাণিজ্যে যেমনি ভারত লাভবান হচ্ছে, তেমনি কূটনৈতিকভাবেও বাংলাদেশের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাচ্ছে
ঘ. বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক:
প্রায় তিন দিক পরিবেষ্টিত বাংলাদেশের সাথে ভারত ব্যতিত মিয়ানমারই হলো পৃথিবীর একমাত্র দেশ যার সাথে আমাদের সীমানা সংযুক্ত। ২৭১ কিলোমিটার দীর্ঘ বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত ভূকৌশলগত কারণে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীনসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে যোগাযোগের জন্য স্থলপথে মিয়ানমারই বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ হতে পারে। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এ দেশটির সাথে বাংলাদেশের কৌশলগত সম্পর্ক নেই বললেই চলে; বরং বিভিন্ন সময়ে দেশটির সাথে ৫ বার আমাদের যুদ্ধে জড়াতে হয়েছ। এজন্য অবশ্য মিয়ানমারের দীর্ঘ সময়ের সামরিক শাসকদের হটকারী ও আগ্রাসী কার্য দায়ী।
ঔষধ শিল্পে মিয়ানমার বাংলাদেশের জন্য 'গোল্ডন ফিল্ড' হতে পারে। দু-দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক গভীর হলে বাংলাদেশের ঔষধের প্রধান আমদানিকারক দেশ মিয়ানমারে আরো বেশি ঔষধ রপ্তানি সম্ভব হবে। মনে রাখতে, আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারত দেশটিতে ঔষধ রপ্তানি করে প্রয়োজনের ৫৫-৫৭শতাংশ, যেখানে আমরা কেবল ৫ শতাশ। তাই, ঔষধ শিল্পে রপ্তানি আয়ের উৎস হিসেবে মিয়ানমার আমাদের জন্য অপার সম্ভাব্য একটি দেশ। মিয়ানমারে ক্যামিকেল রপ্তানিরও সম্ভাবনা হাতছানি দেয় আমাদের। তাছাড়া, মিয়ানমার হতে চালসহ অন্যান্য আমদানিযোগ্য খাদ্যশস্য আমদানি বৃদ্ধি করলে ভারত-বলয় থেকে কিছুটা স্বস্তি মিলতে পারে আমাদের। তবে মনে রাখা আবশ্যক যে, মিয়ানমারের সাথে বাণিজ্যে উদারনীতি অবলম্বন করলেও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কূটনীতি ও প্রশাসনে এ সম্পর্ক হতে হবে ইস্পাত-দৃঢ়।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের রূপরেখা :
রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে বটবৃক্ষের মতো আশ্রয় দানকারী চীনের মতে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতায় রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান সম্ভব; তবে বাংলাদেশকে এটি অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যে রোহিঙ্গা সমস্যা একটি আন্তর্জাতিক ইস্যু। বাংলাদেশ পররাষ্ট্রনীতিতে এতোটাও দক্ষ কিংবা প্রভাবশালী নয় যে প্রতিবেশি প্রভাবশালী দুই দেশ চীন ও ভারতের সহায়তা ছাড়াই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান করবে। এ সংকট সমাধানে বাংলাদেশকে চার থেকে পাঁচটি কৌশল একত্রে অবলম্বন করতে হবে।
প্রথমত , চীনের সাথে উদার কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। বাংলাদেশে বিনিয়োগে চীনকে প্রধান্য দিতে হবে যাতে চীন বুঝতে পারে বাণিজ্যে বাংলাদেশ মিয়ানমারের মতই 'উর্বর ভূমি' ও সমান গুরুত্ব বহন করে।
দ্বিতীয়ত , ট্রানজিট সুবিধা ও উত্তর-পূর্ব ভারতের স্বাধীনতাকামী 'সেভেন সিস্টার্স' খ্যাত রাজ্যসমূহ- অরুণাচল, আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মনিপুর, মিজোরাম ও মেঘালয় সহ ভাতৃরাজ্য সিকিম-এ নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা রক্ষায় বাংলাদেশেকে প্রয়োজন ভারতের। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রয়োজন শুধু বলিষ্ঠ নেতৃত্বের। কৃতজ্ঞতার বা দাসত্বের কূটনৈতিক সম্পর্ক নয়, ভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক হতে হবে ন্যায্যতার ভিত্তিতে 'গিভ এন্ড টেক পলিসি'। রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে বাংলাদেশকে সহায়তা প্রদানের শর্ত সাপেক্ষে ভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে।
তৃতীয় , জাতিসংঘের ৭৬তম সাধারণ পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ১০৭টি দেশের সম্মতিতে মিয়ানমার সরকারকে অবিলম্বে বাস্তুচ্যুত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার প্রস্তাব পাস হয়েছে। এই প্রস্তাব কার্যকর করতে জাতিসংঘের মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চালানো হত্যা, নির্যাতন-নিপীড়নের তথ্যানুসন্ধানে ১৬ সদস্যের প্রতিনিধি দলের প্রধান আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রধান কৌঁসুলি করিম খান বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়নের সাথে জড়িতদের শাস্তি প্রদানে আইনি লড়াইয়ের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে আশ্বস্ত করেন। তথাপি, বাংলাদেশকে মনে রাখতে হবে রোহিঙ্গা সংকট সৃষ্টির জন্য মিয়ানমারকে আইনের আওতায় আনলেই বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা হবে না; বরং রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনেই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্বার্থ সংরক্ষিত।
চতুর্থ , ড. ইউনূসের নেতৃত্বে 'রোহিঙ্গা সংকট সমাধান কমিশন', যার একমাত্র লক্ষ্য হবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে, ড. ইউনূস তাঁর আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগতা কাজে লাগিয়ে বৈশ্বিক বিশেষ করে সমর্থন অর্জন এবং এ সংকট সমাধানে তাদের সংযুক্ত করা।
পঞ্চম , বিসিআইএম ফোরাম (বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার ফোরাম ফর রিজিওনাল কো-অপারেশন)-এ চীনের চার ট্রিলিয়ন ডলারের মেগা পরিকল্পনায় বাংলাদেশের শর্ত সাপেক্ষে অংশগ্রহণ। বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ছাড়া বিসিআইএম-এর মেগা পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়া থেকে রক্ষার জন্য চীনকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চাপ সৃষ্টি করা।
লেখক: এস এম আশরাফ বিন রব
এ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা।
এসআর