ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

নতুন আতঙ্ক জিকা ভাইরাস

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

প্রকাশিত: ২১:৩৯, ৩ ডিসেম্বর ২০২৪

নতুন আতঙ্ক জিকা ভাইরাস

শীত আসতে না আসতেই মশার উপদ্রপ শুরু হয়েছে  আর মশার উপদ্রপ মানেই ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুর আশঙ্কা বর্তমানে এই দুই রোগের সঙ্গে ভয় ধরাচ্ছে মশাবাহিত আরও একটি রোগ, জিকামশার কামড়েই সৃষ্ট একটি রোগ হল, জিকা এই রোগের উপসর্গ সাধারণ ফ্লু- মতো জ্বর দিয়েই এই রোগের প্রকাশ হয়আর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় জিকা ভাইরাসে গত তিন মাসে আক্রান্ত জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন ভাইরাস ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশা থেকেই ছাড়ায় বলে জানা গেছে গত বছরও ভাইরাসে আক্রান্ত পাঁচজন রোগী শনাক্ত হয়েছিলেন চিকিৎসা নেওয়ার পর তারা এখন ঝুঁকিমুক্তজানা গেছে, দেশে প্রথম জিকা ভাইরাস শনাক্ত হয় ২০১৪ সালে জিকার পাশাপাশি ঢাকা শহরে এখন চিকুনগুনিয়ায়ও অনেক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন সেইসঙ্গে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে মৃত্যু ডেঙ্গু, জিকা, চিকুনগুনিয়া- তিনটি রোগই ছড়ায় এডিস মশার মাধ্যমে

জিকা ভাইরাস কী?

এক ধরনের মশাবাহিত রোগ হল জিকা ভাইরাস ডিজিজ এডিস মশা থেকেই এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে এই রোগ অতটা মারাত্মক নয় ঠিকই তবে প্রেগনেন্ট মহিলারা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে বড় ক্ষতির আশঙ্কা থেকে যায় যেখানে সন্তানের মস্তিষ্কের বিকাশ ঠিক হয় না ফলে সন্তানের মস্তিষ্কও হয় তুলনামূলক ছোট

শনাক্তকরণ নামকরণ

 বর্তমানে নতুনভাবে বিস্তার লাভ করা রোগটি ১৯৪৭ সালে প্রথম উগান্ডার জিকা নামক বনাঞ্চলের বানরের মধ্যে শনাক্ত হয় ১৯৫২ সালে উগান্ডা তানজানিয়াতে মানুষের মাঝে প্রথম রোগের সংক্রমণ ঘটে ডেঙ্গু চিকুনগুনিয়ার মতো এটি প্রধানত এডিস মশা বাহিত রোগ পরবর্তীকালে ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে রোগটি আফ্রিকা এশিয়া মহাদেশে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে এবং মাইক্রোনেশিয়ার ইয়াপ দ্বীপে ২০০৭ সালে প্রথম বড় ধরনের প্রাদুর্ভাব পরিলক্ষিত হয় ব্রাজিলে ২০১৫ সাল থেকে চলে আসা জিকা প্রাদুর্ভাব নিয়ে গবেষণা চলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি বলে ঘোষণা করেছে

 কী ভাবে ছড়িয়ে পড়ে জিকা ভাইরাস?

কোনও সংক্রমিত এডিস মশা সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ালে তিনি জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন সংক্রমিত ব্যক্তির সঙ্গে শারীরিক ঘনিষ্ঠতার মাধ্যমেও এই রোগ ছড়াতে পারে এমনকী প্রেগনেন্সির সময় মায়ের শরীর থেকে ভ্রূণেও সংক্রমিত হতে পারে এই ভাইরাস গর্ভাবস্থায় এই ভাইরাস শরীরে হানা দিলে একাধিক জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে গর্ভপাতের আশঙ্কা বাড়ে সময়ের আগেই প্রসব হতে পারে তাই এই ভাইরাস থেকে প্রেগনেন্ট মহিলাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে

 লক্ষণ জেনে রাখুন

এমনিতে জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে সেইভাবে কোনও লক্ষণ প্রকাশ  হয় না তাই প্রথম দিকে রোগীকে দেখে কোনও বোঝারও উপায় থাকে না এদিকে কোনও লক্ষণ দেখা দিলেও তা সংক্রমণের -১৪ দিন পরেই প্রকট হয় আর সেসব লক্ষণ অন্যান্য ভাইরাল ইনফেকশনের মতোই খুব সাধারণ যেমন জ্বর, জয়েন্টে ব্যথা, মাথা ব্যথা এবং দুর্বল বোধ হওয়া এদিকে কনজাংটিভাইটিস, ব়্যাশও দেখা দিতে পারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে, এসব লক্ষণ - দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়

 জিকা ভাইরাসের ঝুঁকির কারণ

* অরক্ষিত যৌনতা * যেখানে জিকা প্রাদুর্ভাব রয়েছে সেসব এলাকায় ভ্রমণ করা * জিকা আক্রান্ত এলাকায় অবস্থান করা * রক্তদান

এমনকি আপনি যদি

চিকিৎসা পদ্ধতি

জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সুস্থ হতে এখনও পর্যন্ত কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি নেই লক্ষণ বুঝেই অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ওষুধ দিয়ে  থাকে এমনকি এই সময় জয়েন্টে ব্যথা, মাথা ব্যথা এবং দুর্বলতা হলে চিকিৎসকেরা বিশ্রামের কথা বলেন আর বেশি করে পানি পানের কথা বলেন যতেœ থাকলেই এই রোগকে হারানো সম্ভব তবে বাড়াবাড়ি হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে

জিকা ভাইরাস নির্ণয়

জিকা সংক্রমণ শনাক্ত করতে রক্ত প্রস্রাব পরীক্ষা এবং অন্যান্য পরীক্ষাগার পরীক্ষা

আল্ট্রাসাউন্ড (ইউএসজি পরীক্ষা):

গর্ভবতী জিকা-আক্রান্ত মায়েদের জন্য আল্ট্রাসাউন্ড (প্রতি থেকে সপ্তাহে) সুপারিশ করা হয় দ্য ইউএসজি পরীক্ষা ভ্রূণে মাইক্রোসেফালি এবং ইন্ট্রাক্রানিয়াল ক্যালসিফিকেশন সহ ভ্রূণের মস্তিষ্কের বিভিন্ন ব্যাধি সনাক্ত করতে পারেঅসহরড়পবহঃবংরং: অনাগত শিশুর জিকা ভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণগুলির জন্য অ্যামনিওটিক তরল পরীক্ষা করা হয়

 প্রতিরোধের উপায়

. ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অবশ্যই ঘরে থাকতে হবে, যতটা সম্ভব বিশ্রাম নিতে হবে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে

. গর্ভবতী নারীদের ভ্রমণ থেকে বিরত থাকতে হবে, বিশেষ করে সংক্রমিত এলাকায়

. জিকা ভাইরাস থেকে সংক্রমণ প্রতিরোধের একমাত্র উপায় হলো মশার কামড়ের ঝুঁকি কমানো যেহেতু মশা প্রধানত দিনের বেলায় কামড়ায়, তাই ঘরের আশপাশ পরিষ্কার রাখুন

. যেসব পাত্র বালতি খালি আছে, তাতে পানি জমে মশা বংশবৃদ্ধি করছে কি না তা পরীক্ষা করুন

. ফুলহাতা জামাকাপড় পরুন, বিশেষ করে বাইরে যাওয়ার সময়

. যদি আপনি এমন এলাকায় থাকেন যেখানে মশার প্রকোপ বেশি সেখানে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ রাখুন মশা-মাছি তাড়ানোর জন্য ওষুধ প্রয়োগ করুন

. ফোটানো/বিশুদ্ধ পানি পান করুন, ঘরে তৈরি তাজা খাবার খান বাইরের খাবার এড়িয়ে চলুন

. জ্বরের চিকিৎসার জন্য অ্যাসপিরিন ব্যবহার করবে না যদি উপসর্গগুলো দুদিনের বেশি সময় ধরে চলতে থাকে, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন

. জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীকে অবশ্যই ঘরে থাকতে হবে এক্ষেত্রে এমন ঘরে থাকতে হবে, যেখানে বায়ু চলাচল করতে পারে

১০. হাত দিয়ে নাক মুখ স্পর্শ করা এড়িয়ে চলুন ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখুন

১১. যতটা সম্ভব ঘন ঘন হাত ধুতে হবে

১২. দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাদের, তারা ভাইরাল সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে বেশি ভিড়ের মধ্যে না যাওয়াই ভালো

পরিশেষে বলতে চাই, সঠিক রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা নিলেই অধিকাংশ রোগই সেরে যায় আবার, কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে সহজেই এসব রোগ প্রতিরোধ করা যায়তাই আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখলেই বেশিরভাগ রোগ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব 

লেখক : চিকিৎসক

 

×