ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

টরন্টোর চিঠি

আমরা কি ভুলকে ভুল ঠিককে ঠিক বলা ভুলে গেছি!

ড. শামীম আহমেদ

প্রকাশিত: ২০:৫৩, ৩ ডিসেম্বর ২০২৪

আমরা কি ভুলকে ভুল ঠিককে ঠিক বলা ভুলে গেছি!

বাংলাদেশে যে অরাজকতা দেখেছি আমরা, তা সবাইকে বিস্মিত করেছে

গত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশে যে অরাজকতা দেখেছি আমরা, তা সবাইকে বিস্মিত করেছে, মর্মাহত করেছে, আহত করেছে। যে তারুণ্য বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মূলে, যে তারুণ্য বাংলাদেশে সকল স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছে, তারাই যখন নির্বিচারে হাসতে হাসতে একজন আরেকজনকে গুলি করে, কুপিয়ে, পিটিয়ে মেরে ফেলছে, তখন সেটি জাতি হিসেবে আমাদের নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

আমাদের গর্বের তারুণ্য যখন রাস্তায় নেমে স্রেফ মতাদর্শের ভিন্নতা, রাজনৈতিক বিভেদ, ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি পুড়িয়ে ফেলে, নির্দ্বিধায় হাতে অস্ত্র তুলে নেয়, অন্য ধর্মের মানুষকে ঘৃণা করে, তখন সেটি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার প্রয়োজন বলে মনে করি। বাংলাদেশে প্রতিদিন যে ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, সেটি স্রেফ রাজনৈতিক বলে মনে করতে পারছি না। আমি মনে করি আমাদের জাতিগত মনস্তাত্ত্বিক বৈকল্য হয়েছে এবং এটি নিয়ে জরুরি আলাপ-আলোচনা শুরু করা দরকার। আবারও বলি, বিগত কিছুদিনে আমরা যে ভয়াবহ অরাজকতা প্রত্যক্ষ করেছি, তা আমাদের জাতির সামাজিক ও নৈতিক মেরুদ-ে গভীর চিড় ধরিয়েছে।

তরুণ প্রজন্মের মধ্য থেকে একসময় যে সৃজনশীল, ন্যায়পরায়ণ এবং সাহসী নেতৃত্বের আশা করা হতো, সেই প্রজন্মের একাংশ এখন নির্বিচারে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছে। তাদের হাতে অস্ত্র, চোখে হিংসা এবং মনে ভ্রান্ত ধারণাÑ সব মিলিয়ে এ যেন একটি জাতিগত সংকট। এই সংকটকে শুধু রাজনৈতিক বলে ব্যাখ্যা করা যথেষ্ট নয়। বরং এটি আমাদের পারিবারিক, সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দুর্বলতা এবং নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের প্রতিফলন।

মানবাধিকার গবেষক এবং শান্তি আন্দোলনের কর্মী মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বলেছিলেন, ‘Injustice aûwhere is a threat to justice everywhere.’ অর্থাৎ, সমাজে ন্যায়বিচারের অভাব যদি দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে ওঠে, তাহলে সেই সমাজ দ্রুত সংকটময় অবস্থার দিকে ধাবিত হয়। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে মনে হয়, এই অবস্থা কেবল প্রাতিষ্ঠানিক বা রাজনৈতিক নয়; এটি পারিবারিক শিক্ষার অবক্ষয়ের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।
পরিবার মানবসন্তানের প্রথম বিদ্যালয়। মনোবিজ্ঞানী জন বোল্বি তার অঃঃধপযসবহঃ ঞযবড়ৎু-তে ব্যাখ্যা করেছেন, শিশুরা তাদের পরিবারের সঙ্গে যে মানসিক বন্ধন গড়ে তোলে, তা তাদের ভবিষ্যতের আচরণগত এবং নৈতিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে এই পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়েছে। আমি আমার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করছিলাম দেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে। ছাত্রÑ যাদের মূল কাজ রাষ্ট্রগঠন, নিজেদের চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধন, ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার অধ্যাবসায়ে নিয়োজিত থাকা, তারা কেন এমন নৃশংস ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠবে! কেন একজন মানুষকে আঘাত করার পর তাদের মধ্যে অনুশোচনা হবে না?

কেন তাদের মনে হবে না তারা ভুল কাজ করছে? মানুষের সামাজিক ও আচরণগত স্বাস্থ্যবিজ্ঞান নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা, শিক্ষার্থীদের ‘শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশ’ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো এবং সাধারণ জ্ঞান থেকে আমার মনে হচ্ছে যে, বাংলাদেশের মানুষের পারিবারিক শিক্ষায় একটা বড় ধরনের বিচ্যুতি হয়েছে গত কয়েক দশকে। মানুষকে শ্রদ্ধা করতে হবে, সালাম দিতে হবে, সম্মান করতে হবে, শ্রেণিবৈষম্য করা যাবে না, আঘাত করা যাবে না, মিথ্যা বলা যাবে নাÑ এই খুব সাধারণ বিষয়গুলো আমরা মূলত পরিবার থেকেই শিখি।

রাস্তায় নেমে রাষ্ট্রীয় সম্পদে আগুন দেওয়া, মানুষকে লাঠি হাতে পিটিয়ে মেরে ফেলে উল্লাস করা, তাদের জীবন নিয়ে ইয়ার্কি-মশকরা করা, প্রাণীদের কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলার মতো কাজগুলো করতে গেলে হাত কেঁপে ওঠার যে বিষয়টা, সেটা মূলত পারিবারিক শিক্ষা থেকেই আসে। সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে, বিছানা গুছিয়ে পড়তে বসা, মাগরিবের আজানের সময় ঘরে ফেরা, প্রতিদিন বিকেলে নিয়ম করে খেলাধুলা করা, কায়িক পরিশ্রম করা, বাবা-মা’র কথা শোনাÑ এই বিষয়গুলো ঐতিহাসিকভাবেই আমরা মেনে এসেছি, যা আমাদের ঠিক কাজ থেকে ভুল কাজের পার্থক্য করতে শিখিয়েছে, গুরুজনদের নির্দেশ শুনতে, মানতে শিখিয়েছে।

এটি সত্য যে, নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের পর প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের চিন্তাচেতনার পরিবর্তন হবে, হতে পারেÑ এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু জীবনের শুরুটা শৃঙ্খলার মধ্যে বেড়ে ওঠা জরুরি। ছোটকালে আমরা দেখেছি বাবা-মা আমাদের যেকোনো ভুল কাজের জন্য তিরস্কার করতেন। কোনো একটা ভুল কাজ করলে আমরা সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতাম যে, এর কী শাস্তি হতে পারে সেটি চিন্তা করে! আমি খেয়াল করেছি গত কয়েক দশকে অনেক বাবা-মাই সন্তানের নানা অন্যায্য, অগুরুত্বপূর্ণ কাজকে অনেক সময় অহেতুক প্রশংসা করে গেছেন, অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়েছেন, ভুল কাজকে গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন।

সন্তান মাঠে-ঘাটে-স্কুলে কোনো অন্যায় কাজ করলে তারা তাদের শাসন তো করেনইনি, বরং তাদের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন, তাদের অন্যায়ের পক্ষে লড়াই করেছেন। ফলশ্রুতিতে একটা পুরো জেনারেশন ভুল কাজের সঙ্গে সঠিক কাজের পার্থক্যগুলো বুঝে উঠতে পারেনি, তাদের মধ্যে ‘মুই কী হলাম’Ñ এই অভিব্যক্তি পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। আমাদের প্রজন্ম শিখেছে নিয়মের মধ্যে বেড়ে উঠতেÑ বাবা-মার কঠোর তত্ত্বাবধানে জীবনযাপন করা, ভুল করলে শাসন পাওয়া এবং ঠিক কাজের জন্য প্রশংসিত হওয়া। কিন্তু বর্তমান সমাজে এই শৃঙ্খলা ভেঙে গেছে। শিশুরা এখন পারিবারিক দিকনির্দেশনার অভাবে ভুল কাজেও প্রশংসা পায়। শিশুরা যখন দেখে তাদের বাবা-মা তাদের অন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ায়, তখন তাদের নৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, পারিবারিক নৈতিকতা এবং নিয়মিত অভ্যাসের অভাবে শিশুরা ভবিষ্যতে সহিংস আচরণ এবং অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ে। আরও নানাভাবে পরিবারগুলোর বন্ধন দিন দিন ভুল পথে পরিচালিত হয়েছে, পারিবারিক বন্ধন গড়ে ওঠেনি, মিথ্যা অহং এবং ভুল শিক্ষার মধ্য দিয়ে একটা প্রজন্ম হিংস্র হয়ে বেড়ে উঠেছে। পারিবারিক মূল্যবোধের অভাব মূলত তাদের এই পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছে। 
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একবার বলেছিলেন, ‘শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে মানুষ বানানো।’ কিন্তু বর্তমান সময়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এই আদর্শ থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। পরিবারের পর মানুষ সবচেয়ে বেশি যেখানে সময় কাটায়, সেটি হচ্ছে তার প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানÑ ইস্কুল! এই ইস্কুল বাংলা, ইংরেজি, আরবি নানা মাধ্যমের হয়, সেখানে শিশুরা দিনের অন্তত ৮ ঘণ্টা সময় কাটায়। কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুরা আবাসিক, সেখানে তাদের দিনের নয় কেবল, জীবনেরই একটি বড় সময় কাটে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুরা কী শিখছে সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা গত কয়েক দশকে দেখেছি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।

শিক্ষাদীক্ষায় নৈতিক মূল্যবোধের বিষয়গুলো উপেক্ষিত হয়েছে। আমাদের সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমরা যাদের সান্নিধ্য পেয়েছি, এখনকার শিশুরা সেটি পায় কিনা সেই প্রশ্নও থেকে যায়। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতো শিক্ষককে এক সময় কলেজ পর্যায়েই পাওয়া যেত, এখন ওই মানের শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়েও পাওয়া যায় না। আমাদের শিশুরা এখন না শিখছে গণিত, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা; না শিখছে যুক্তি, বিনয়, শ্রদ্ধা, অহিংসার মতো নিতান্ত সাধারণ মূল্যবোধের বিষয়গুলো। ব্রিটিশ দার্শনিক জন লকের মতে, মানুষ জন্মগতভাবে একটি ঃধনঁষধ ৎধংধ (খালি পাতা), এবং তাদের পরিবেশ এবং শিক্ষা তাদের জীবনকে রূপ দেয়।

কিন্তু আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নৈতিক শিক্ষা এবং মানবিক মূল্যবোধের ওপর জোর কমে গেছে। শিশুরা স্কুলে বই-পুস্তকের বাইরে বাস্তব জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি পায় না। ইউনেস্কোর ২০২৩ সালের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক ও সামাজিক শিক্ষার অভাব একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি আরও প্রকট। কারণ, আমাদের শিশুরা ছোটবেলা থেকেই যুক্তি, মানবিকতা এবং ন্যায়পরায়ণতার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত।
আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করেছি, আমাদের শিশুরা বড় হওয়ার সময় ভুল কাজের প্রশংসা পাচ্ছে, ভুল কাজকে সঠিক জেনে বড় হচ্ছে এবং বেড়ে ওঠার পর তাদের এই ধারণা আর পরিবর্তিত হচ্ছে না। আমরা রাত জেগে এলাকা পাহারা দেওয়ার জন্য, চোর-ডাকাত খেলার জন্য, রাস্তায় নেমে লাঠি হাতে ট্রাফিক কন্ট্রোলের জন্য, সড়ক অবরোধ করে দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য তাদের প্রশংসা করছি। রাত জেগে ভিডিও গেমস খেলার জন্য, ব্যস্ত সড়কে স্টান্টবাজি করার জন্য, ভিন্ন সংস্কৃতিকে অন্তরে ধারণ করে শো-অফ করার জন্য তাদের মাথায় তুলে নাচছি।

আমাদের শিশুদের বিতর্ক প্রতিযোগিতা, গল্প বলা বা লেখা প্রতিযোগিতা, কবিতা আবৃত্তি, হারমোনিয়াম বাজানো, তবলায় বোল তোলা, বাঁশির সুর শুনে মুগ্ধ হওয়া, ছবি আঁকা, গান গাওয়া, জুমার পর বাসায় ডেকে গরিব মানুষকে নিজ হাতে খাবার বেড়ে খাওয়ানো, বৃদ্ধদের রাস্তায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া, ঘরের কাজে বাবা-মাকে সাহায্য করা, কুকুর-বেড়াল পোষার মতো নৈতিক ও মানবিক কাজে উৎসাহিত করছি না। সংযুক্ত করছি না। আমরা ভুল কাজের প্রশংসা করছি, তিরস্কার করছি না। আমরা তাদের ভুল আর সঠিকের মধ্যে বিভাজনটা শেখাচ্ছি না। তারুণ্য সিস্টেমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, নিয়ম-কানুন ভাঙবে, স্বৈরশাসনের পতন ঘটাবে এটি প্রত্যাশিত, বাস্তব।

কিন্তু একই সঙ্গে তারা ভুল থেকে শিক্ষা নেবে, ঠিক আর ভুলের পার্থক্য জানবে, অন্যায়কে প্রশ্ন করবে, ন্যায়কে অন্তরে ধারণ করবে– এটিও একটি সভ্য দেশে স্বাভাবিক কামনা। কোনো এক বিস্ময়কর কারণে আমাদের দেশে এটি আর ঘটছে না। এমন অনিয়ম-অন্যায় যে অন্য দেশে হয় না, তা নয়। কিন্তু আমাদের নিজেদের দেশ নিয়ে আগে ভাবতে হবে এবং মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা, নিজের দেশের সম্পদ ধ্বংস করে ফেলার মধ্যে আজকের তারুণ্য যে উন্মত্ত আনন্দ পাচ্ছে, যে বিকৃত উল্লাস তাদের বিনোদন হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং সেটিকে ভুল হিসেবে চিহ্নিত করতে না শিখিয়ে উৎসবের যে আমেজ আমরা তাদের জন্য তৈরি করছি, সেটি জাতি হিসেবে আমাদের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

ভুল কাজকে প্রশংসিত করা এবং সঠিক কাজকে অবহেলা করার যে সংস্কৃতি আমাদের সমাজে গড়ে উঠেছে, তা অত্যন্ত ভয়াবহ। জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আমরা শিখতে পারি যে, ছোটবেলা থেকেই শিশুদের ভুল এবং সঠিকের পার্থক্য শেখানোর জন্য বিশেষ কর্মসূচি থাকা উচিত। বিখ্যাত জাপানি শিক্ষাবিদ সুকু জোহার মতে, শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত নৈতিক নেতৃত্বের বিকাশ। কিন্তু আমরা শিশুকে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় না পাঠিয়ে তাকে লাঠি হাতে ‘মিছিলের নেতৃত্ব’ দেওয়ার প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। এতে তাদের মধ্যে অহংকার এবং হিংস্রতার বীজ রোপিত হচ্ছে।
আমাদের দেশের এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন আনা দরকার। প্রথমত, পরিবারকে শিশুদের মানবিক মূল্যবোধ শেখানোর দায়িত্ব নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈতিক শিক্ষা এবং মানবিক গুণাবলির বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে। এডমন্ড বার্ক বলেছিলেন, ‘ঞযব ড়হষু ঃযরহম হবপবংংধৎু ভড়ৎ ঃযব ঃৎরঁসঢ়য ড়ভ বারষ রং ভড়ৎ মড়ড়ফ সবহ ঃড় ফড় হড়ঃযরহম.’ তাই আমাদের সবার উচিত, এই সমস্যাগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং সমাধানের পথ খোঁজা। জাতি হিসেবে আমাদের ভুলকে ভুল বলা এবং সঠিককে সঠিক বলার সাহস ফিরিয়ে আনতে হবে।

আমাদের দেশপ্রেমের ধারণাতেও একটা আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। দেশপ্রেমের সংজ্ঞা যেন বাংলাদেশকে ভালোবাসায় নয়; আমাদের দেশপ্রেম নিহিত ভারত অথবা পাকিস্তান প্রেমে, কানাডা অথবা সৌদি প্রেমে, নতুবা মুসলমান বা হিন্দুর প্রতি ঘৃণায়। আমরা আমাদের সব সমস্যা রাজনৈতিক ভাবতে ভাবতেÑ পারিবারিক মূল্যবোধ, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং ভুলকে ভুল ও ঠিককে ঠিক বলার ও ভাবার যে খুব স্বাভাবিক ধারণাটিÑ সেটিকেই গত কয়েক দশকে তিলে তিলে ধ্বংস করে ফেলেছি। জাতি হিসেবে আমরা যদি আমাদের শিকড়ে ফিরে না যাই, পরিবার থেকে পরিবর্তনের সূত্রপাত না করিÑ তাহলে যে পতনের সূত্রপাত হয়েছে; সেটি থেকে উত্তরণ আমাদের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

আমাদের দেশপ্রেমের ভিত্তি হতে হবে মানবিক মূল্যবোধে, প্রতিহিংসা নয়। যদি আমরা এখনই সচেতন না হই, তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের পতন এক অনিবার্য ভবিষ্যৎ হয়ে দাঁড়াবে। পরিবর্তন সম্ভব, কিন্তু তা শুরু করতে হবে পরিবার থেকে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নৈতিকতা এবং মানবিকতার আলোয় আলোকিত করার দায়িত্ব আমাদের সবার।

৩ ডিসেম্বর ২০২৪

[email protected]

×