নতুন সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের গতিপথ এখন নানা চ্যালেঞ্জের আবর্তে। ইতোমধ্যে শতদিন পার হওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নানামাত্রিক অস্থিরতা ও আলোচনা, সমালোচনা সামলাতে হচ্ছে। নতুন আঙিনায় পা রাখা অত সহজসাধ্য বিষয় নয়। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অপসংস্কারকে সমূলে উৎপাটন করাও বেশ কঠিন কাজ। দেশের ক্রান্তিকালে উদীয়মান নতুন প্রজন্মের সময়োপযোগী আন্দোলন-সংগ্রাম নতুন পথের অনন্য দিশা তো বটেই। তবে নতুন-পুরনোর দ্বন্দ্ব-সংঘাত সহজে মিটে যাওয়ারও নয়। নতুন শক্তি নব উদ্দীপনায় সামনে অগ্রসর হলে মান্ধাতা আমলের হরেক জঞ্জালও মাথাচাড়া দেয়। এসব নতুন কিছু নয়। যুগ-যুগান্তরের এক অবধারিত, অনধিগম্য যাত্রা। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে কাঁটা বিছানো থাকে পথে পথে। তারপরও নতুন বাংলাদেশ ইতিহাসের গতিময়তায় এগিয়ে যাওয়া আবশ্যক।
চড়াই-উতরাই পার হওয়ার মিলিত দ্যোতনায় নিত্য যাপিত জীবনের চিত্রে উঠে আসছে হরেক অসঙ্গতিও। স্বস্তি আর অস্বস্তিতে সাধারণ মানুষের জীবন অনেকটাই নাকাল অবস্থায়। তারপরও রাস্তাঘাট এখন ততটা অনিরাপত্তার বেষ্টনীতে নেই বলা যায়। নির্ভয়ে, নিঃসঙ্কোচে অবলীলায় চলাফেরার তেমন কোনো ঘাটতি দৃশ্যমান নয়। কিন্তু পথের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে চিরস্থায়ী এক দাবানলের মতো। বিশেষ করে কর্ম ও প্রাণচঞ্চল রাজধানী ঢাকা নগরীর রাস্তায় বের হয়ে নির্দিষ্ট সময়ে না পৌঁছাতে পারা শুধু আজকের বিড়ম্বনা নয়, বহু দিনের পুরনো। যে কোনো দুঃসময় সহজে কমে না। বরং বাড়তে দেখা যায়। যেন এমনটিই নিয়মনীতির অনুষঙ্গ। বিপরীতে সুসময় কেমন যেন সহজে শেষ হয়ে যায় টের পাওয়ার আগে। ছাত্র আন্দোলনের অভ্যুত্থানে কাক্সিক্ষত অনেক কিছু স্বস্তিদায়ক হলেও বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় বিপন্ন হওয়ার দুরবস্থা কাটাতে সময় লাগছে। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দুরবস্থা পার করছে রাজধানীর সড়ক-মহাসড়ক। অলিগলিও বাদ নেই।
ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আজও প্রত্যাশিত চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে হিমশিম খাচ্ছে। সমতাভিত্তিক দেশ বিনির্মাণে হরেক পুঞ্জীভূত অসমতা হাজির হচ্ছে। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় দফায় দফায়, কারণে-অকারণে দাবি-দাওয়ার যে বিশাল হিড়িক তা সামাল দিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। প্রথমে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় যে কোনো কর্মজীবী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে ভাবতে হয় সময়মতো পৌঁছানো যাবে কি না। যানবাহন কিংবা হাঁটার পথ কোনোটাই স্বস্তিদায়ক নয়। তার মধ্যে আন্দোলনের মিছিল যেভাবে বিভিন্ন রাস্তাঘাটকে অবরোধ করে রাখতে দেখা যায়। তবে আগে এমনটি ছিল কি না তাও ভাববার বিষয়। চলতি বছরের জুলাই মাসব্যাপী যে আন্দোলন বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নভেম্বরের শেষ লগ্নে তা যেন আরও সম্প্রসারিত ও শাখা-প্রশাখায় আবর্তিত। আমরা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম ছাড়াও ১৯৯০ সালের এরশাদ হটাও গণআন্দোলন দেখেছি। সেসব আন্দোলনও গুরুত্বপূর্ণ ছিল একথা অনস্বীকার্য। সব আন্দোলনের সফলতায় আমরা লক্ষ্য অর্জনে কোনোভাবেই পিছু হটিনি। ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনের পর আমরা একটি নিয়মতান্ত্রিক, প্রণালীবদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় সফল নেতৃত্ব পাওয়া যুগ ও সময়ের অনির্বাণ দীপ্তি। ১৯৯১ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত লাগাতার সুষ্ঠু নির্বাচনে বিজয়ী রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া ইতিহাসের নির্মাল্য। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে একতরফা জবরদস্তিমূলক নির্বাচন কিংবা ক্ষমতা দখল সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ছিল না। বরং একনায়কতন্ত্রের বীজ বপনে অনাকাক্সিক্ষত অপশক্তির পুনরায় ঔদ্ধত্য আর ক্ষমতার দাপটে জাতি দিশাহারা, লক্ষ্যহীন আদর্শহননের ভিন্ন মাত্রায় অসহনীয়। যা ক্রমান্বয়ে নির্বাচনের মতো সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক সাংবিধানিক প্রক্রিয়াকে নয়ছয় করে সমূলে ক্ষতবিক্ষত করার দাপটের সঙ্গে পরাক্রমশালী হয়ে উঠতে সময়ক্ষেপণ করেনি মোটেও। সেটাও লাগাতার অপশাসনের সুদীর্ঘ পর্যায়ের দশ বছর। পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, বঞ্চনা, নিপীড়ন, অধিকার ও গণতন্ত্রহীনতার এক অসহনীয় দুর্যোগ। শুধু সরকারপ্রধান নয়, দলীয় রাজনীতির ক্ষমতায়ন আর দাপটে সব ক্ষেত্রকে কুক্ষিগত করার যে পাঁয়তারা সেটা জনগণকে অস্থিরতার শেষ ধাপে নিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুই বিঘে জমির কবিতায় চমৎকার বাণী আজও উল্লেখযোগ্য এক বার্তা। ‘রাজা যত বলেন, পারিষদ বলেন তার শতগুণ’Ñ সত্যিই মাত্র দুই বিঘে জমির জন্য কবিগুরু এমন সত্যটি উপলব্ধি করেছিলেন। কালের অভিযাত্রায় আমরা লক্ষ্য করছি কিভাবে সরকার প্রধানের চারপাশের পারিষদরা অন্যায়, অবিচারে নানাভাবে সাধারণ জনগণের ওপর চড়াও হয়। তাদের ইতিবৃত্তও ক্রমশ প্রকাশিত হতে দেখা যায়। বিগত সরকারের গডফাদারদের কারসাজি আর আড়ালে আবডালে থাকেনি। যাই হোক বিগত সময়ের লাগাতার দুঃশাসনকে কোন এক জায়গায় থামতে বাধ্য করতে ইতিহাসের দায়বদ্ধতা অবশ্যই ছিল। বাস্তব প্রেক্ষাপট তাই প্রমাণ করেছে। চলমান সরকারও স্বস্তিতে সময় কাটাতে হিমশিম অবস্থায়।
নির্বাচন জরুরি এক সাংবিধানিক প্রক্রিয়া। আবার দুঃসময়ে দেশের হাল ধরতে তাৎক্ষণিক সরকার গঠনও অনিবার্য। তবে সাম্প্রতিক নিত্য নতুন দাবি আর আন্দোলনে জনমনে অস্বস্তি সৃষ্টি করছে। অফিস-আদালতগামী কর্মজীবী মানুষ যাত্রাপথে দুরবস্থার মুখোমুখি হচ্ছেন। কয়েকদিন আগে চট্টগ্রামের তরুণ আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে হত্যা করার অভিযোগে বন্দরনগরী যেন উত্তাল সময় পার করছে। প্রতিরোধ, সমাবেশ আর বিক্ষোভ মিছিলে চট্টগ্রামের যে ছাত্র-জনতার ঢল তাও এক অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির চরম দুর্বিপাক। এমন নির্মম হত্যাকান্ডের বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে জোর প্রতিবাদ জানানো হয়। সঙ্গে সাম্প্রদায়ভিত্তিক সংগঠন ইসকনকে নিষিদ্ধেরও দাবি জানিয়ে রাজপথে নেমে আসে ছাত্র-জনতার ঢল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতাদের পক্ষ থেকে হত্যাকান্ডে সংশ্লিষ্টদের বিচারের আওতায় আনার দাবি করা হয়। অপরাধী যেই হোক না কেন কাউকে যেন ছাড় না দেওয়া হয় এমন দাবিও আসে। বিশেষ করে এমন কর্মকান্ডের প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি বিক্ষোভ মিছিলে প্রতিবাদমুখর। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হস্তক্ষেপও প্রয়োজন ছিল। তাই সময়ে তারাও মাঠে নামেন। মৌলবাদী সংগঠন ইসকনকে নিষিদ্ধ করতে সম্মিলিত কণ্ঠে আওয়াজও ওঠে। মঠ, মন্দির ও বৌদ্ধ বিহারে আইনি ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, অপরাধীদের চিহ্নিত করে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে আইনি কার্যক্রম চলমান থাকবে। সেখানে ধর্মীয় কোনো ভেদবুদ্ধি আমলে নেওয়া হবে না। সম্মিলিত সনাতন জাগরণ জোটের চিন্ময় দাশ ব্রহ্মচারীসহ অন্যান্য দোষী ব্যক্তির শাস্তির দাবিতে চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণ মুখরিত হয়।
নানামাত্রিক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা সার্বিক পরিস্থিতির জন্য মঙ্গলজনক নয়। নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর যে জোরালো আহ্বান তা উদ্ভূত অস্থির পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। প্রধান উপদেষ্টাও মনে করেন সব দলের জাতীয় ঐক্য এখন বেশি জরুরি। সংস্কার কাজ আর নির্বাচনের যথার্থ রাস্তা খুঁজে বের করে তা বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাওয়া এখন সময়ের দাবি। দেশের সার্বিক অবস্থা উপলব্ধিতে এনে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার আবশ্যক। নির্বাচনকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য করতে প্রয়োজনে অনেক কিছু ঢেলে সাজানো যেতে পারে। বিগত সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের নতুন সংস্কার প্রক্রিয়া দেশ ও জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এখনো বহু অপসংস্কার কাঠামোর অভ্যন্তরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে। সেসব দূর করাও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরাট চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনের মাধ্যমেই পরিষ্কার হবে সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা, প্রত্যয়, বিশ্বাসÑ যা কোনো স্বাধীন দেশের গঠন প্রক্রিয়ার নিয়ামক হিসেবে বিবেচিত। নির্বাচনের আনুষঙ্গিক কর্মযোগও সময় সাপেক্ষ বিষয়। সবার আগে দীর্ঘদিনের জটলা পাকানো ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা দরকার। অবশ্য এই কাজ যথেষ্ট সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ। অনেকে অতি সত্বর নির্বাচন দেওয়ার দাবি করছেন। আবার সঙ্গত কারণে পিছু হটছেন।
স্বনামখ্যাত, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান অত্যন্ত স্পষ্ট করে বললেন উচ্চাকাক্সক্ষী সংস্কার বাস্তবায়নে ৪-৫ বছর লাগতে পারে। কারণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কারের যে রূপরেখা দিচ্ছে তা সহজেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। তাই যৌক্তিক হবে সময়মতো একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা। অতঃপর জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার মূলত সংস্কার কার্যক্রমকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে পারে। যদিও নির্বাচিত সরকারের হাতে দায়িত্বভার আসতে এখনও যথেষ্ট সময় লাগবে। ইতোমধ্যে যে সব সংস্কার শুরু হয়েছে সেখানে যে দলই নির্বাচিত হবে তাদেরই পরবর্তীতে দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড এগিয়ে নেওয়া জরুরি। বিশেষ করে নানামাত্রিক বৈষম্য বিলোপ করা চাই। সে ক্ষেত্রে অতীতের নানাবিধ সাফল্য ও ব্যর্থতা বিবেচ্য বিষয়। সঙ্গে সামাজিক-রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা জরুরি। বাজার সিন্ডিকেট, অসম সামাজিক সুবিধা, অন্যায্য রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং রাষ্ট্র কর্তৃক অবিচার, অনিয়মের মতো বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেওয়া দরকার। এই বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ন্যায়সঙ্গত সমাজ গঠন প্রক্রিয়ায় বাজার অর্থনীতি, রাজনৈতিক ন্যায়পরায়ণতা আদর্শনিষ্ঠতা সচেতনভাবে উল্লেখ করেছেন। রাষ্ট্রীয় শাসন কাঠামোর অভ্যন্তরে অনাকাক্সিক্ষত অপ্রয়োজনীয় বিষয়ও ঝেড়ে ফেলা আবশ্যক। অর্থাৎ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বহু অন্যায্য সংস্কার কাঠামোর ভিতকে শক্তিহীনতার পর্যায়ে নিয়ে যায়। সেক্ষেত্রে জনগণের কাক্সিক্ষত সংস্কার এখন যুগের দাবি।
লেখক : সাংবাদিক
সংস্কার ও নির্বাচন
শীর্ষ সংবাদ: