বেগম রোকেয়া দিবসকে সামনে রেখে সিডনিতে পড়ুয়ার আসরের এবারের আয়োজনেও গিয়েছিলাম। শনিবার সন্ধ্যায় মেঘলা আকাশ আর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির ভেতর গাড়ি বোঝাই আমরা চার যাত্রী। অনুজপ্রতিম আল নোমান শামীম, ওর স্ত্রী আমাদের স্নেহধন্যা স্বাতী এবং অগ্রজ বন্ধু গামা আবদুল কাদের আর আমি। দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিসহ নানা বিষয়ে আলাপ আর তর্ক বিতর্কের পর গাড়ি থামল কফির নেশায়। এতে খানিকটা বিলম্ব না হলে পুরা অনুষ্ঠানটাই দেখা হতো আমার। তবে যেটুকু দেখেছি তাতে মনে হয়েছে, আমাদের সিডনির রোকেয়ারা অনেকদূর যাওয়ার রাস্তাটা প্রশস্ত করছে।
অনুষ্ঠানের বর্ণনা বা ভালোমন্দ মানে সমালোচনামূলক লেখা। আমি সেদিকে যাব না। বেশ ক’বছর আগে লেখক-সংগঠক রোকেয়া আহমদ আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল তাদের এমন একটি আয়োজনে। সেবার গিয়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। পরিচিত এই মুখগুলো আমাদের আত্মীয়তুল্য। নারীদের এই দিকটি আমার জানা ছিল না। তারা এত সংগঠিত আর প্রাণিত এই ভাবনাতেই আমার মন ভরে গিয়েছিল। এরপর আরও এক-দুবার যাওয়া হয়েছে। এবারের আয়োজনটির ভিন্নতা ছিল তাদের আন সাং হিরোজ নামে তুলে ধরা নারীদের নাম ও কর্মে। নামগুলো তুলে ধরছিÑ ঝাঁসীর রাণী লক্ষী বাঈ, সরোজিনী নাইডু, বেগম হযরত মহল, কিতুর রানী, মূলমতি, অরুণা আসফ আলী, এ্যানি, কাপ্তান লক্ষ্মী সেগাল, কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় এবং বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত। ধারণা করছি এরপর আর কিছু বলারই দরকার পড়ে না।
ভাবতে পারেন, দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে প্রতিকূল না হলেও দেশজ ভাবনা বা সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন একটা সমাজে বসবাস করে তারা কতটা আধুনিক? তাদের মন মননে এসব নারীর সঙ্গে থাকেন বেগম রোকেয়া। আমার মনে হয়েছে, বেগম রোকেয়া আমাদের জন্য এখন জরুরি চর্চার বিষয়। নানা কারণে আজ তিনিও খুব একটা শান্তিতে নেই। সেদিনকার অনুষ্ঠানে দেওয়ালের নানা জায়গায় রোকেয়ার ছবি দেখে বলেছিলাম, যারা চোখ থাকতেও অন্ধ বা বেগম রোকেয়ার ছবি দেখলে ভয় পায়, তারা জানুক এটাই নারী জাগরণের শক্তি। আজ বেগম রোকেয়া তাঁর কর্ম ও আদর্শে দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে পড়া বাংলাদেশী এক নারী। যে কথা বলছিলাম, সরোজিনী নাইডুর সঙ্গে চট্টগ্রামের যোগ ছিল। কবি নজরুল যখন চট্টগ্রামে সংবর্ধিত হন তখন সেখানে সরোজিনী নাইডুকেও সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তিনি চট্টগ্রামে রাজনৈতিক সভাতেও ভাষণ দিয়েছিলেন। সিডনির এই নারীরা তাদের অস্তিত্ব আর শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছে। আগেই বলেছি অনুষ্ঠানের কথা থাক। বলছি তাদের মনযোগ আর ভালোবাসার কথা। সেদিন তারা আমাদের বিজয় দিবসেেকও মনে রেখেছে। গৌরবময় বিজয় দিবসের প্রাক্কালে যখন এর কথা এর আদর্শ আর ভাবধারা প্রচার জরুরি তখন সিডনির একুশে একাডেমির পর পড়ুয়ার আসর বিজয় দিবসকে মনে রেখে আমাদের কৃতজ্ঞ করেছে।
নারী ও নর উভয়ে একটি বস্তু ও অঙ্গবিশেষ। যেমনÑ ‘দুটি হাত কিংবা কোনো শকটের দুইটি ‘চক্র’Ñ সুতরাং উভয়ে মিলিয়া হয় একই বস্তু। তাই একটিকে ছাড়িয়া অপরটি উন্নতি করিতে পারিবে না’- (মতিচূর, প্রথম খণ্ড)। রোকেয়া সাখাওয়াত বর্ণিত এ বাণী একটি সমাজ উন্নয়নের মূলসূত্র। সমাজ উন্নয়ন ও নারী উন্নয়নের বিষয়টি ওতপ্রোত জড়িত। নারীর ক্ষমতায়ন তাই আজ আর শুধু একটি আধুনিক প্রপঞ্চ নয়, বরং একই সঙ্গে বৈশ্বিক ও সর্বজনীন প্রবঞ্চনা। ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশের প্রথম নারীবাদী চিন্তাবিদ, দার্শনিক, সমাজ সংস্কারক ও নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো, মানসিকতা, সামাজিক কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, উগ্রবাদী, মৌলবাদী নারীবিদ্বেষী শক্তির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নারীমুক্তির জয়গান গেয়েছেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত। তিনি বৃত্তাবদ্ধ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর পর্দা নামক শৃঙ্খলের বেড়াজালে পড়া অবরোধবাসিনীদের অধস্তন, পরাধীন অবস্থা তুলে ধরেন নানা লেখনীতে। নারীর শারীরিক দুর্বলতা কাঠামো তত্ত্বকে গুঁড়িয়ে ফেলে, লিঙ্গবৈষম্যের শিকার নারীসমাজের মুক্তির লক্ষ্যে রোকেয়া নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের ধারণা প্রতিষ্ঠার এক নতুন সংগ্রাম শুরু করেন।
বাংলাদেশ ও বিশ্ব নারীর জন্য কল্যাণকর যে কোনো কাজে বেগম রোকেয়াকে দরকার। আমি মুগ্ধ যে, পড়ুয়ার আসর তাঁকে মনে রাখে এবং তাঁকে ধারণ করে। কারো নাম উল্লেখ না করেই বলি মার্জিত এই অনুষ্ঠানটির মান আরও ভালো হতে পারত। আবেগ আর মঞ্চ একাকার করে রাখা ভালো, কিন্তু তার জন্য দরকার সংগঠিত মেধা ও মনোনিবেশ। হয়তো তা ছিল কিন্তু তার স্ফুরণ আরও বেশি হতে পারত। তারপরও আমার ভালো লাগার দিকটা হচ্ছে ওদের পথ চলা।
‘চক্ষু থাকিতে অন্ধ যারা আলোকের দুনিয়ায়
সিন্ধু সেচিয়া বিষ পায় তারা অমৃত নাহি পায়।’
এরূপ অন্ধত্ব মোচনে শিক্ষার বিকল্প নেই। যেহেতু নারী ও পুরুষ সমাজ দেহের দুটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, সেহেতু সমাজ গঠনে উভয়েরই স্ব স্ব ক্ষেত্রে কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। আর এ দায়িত্ব বা কর্তব্য পালনে পুরুষের পাশাপাশি নারীকেও বাস্তবমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে, যা তাদের জীবন ও কর্মধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এমন ভাবনা যখন দেশের জন্য সমাজের জন্য জরুরি তখন সিডনির পড়ুয়ার আসর একের পর এক আয়োজনে আমাদের অন্তরকে ধৌত করে চলেছে। এবার তারা নবীন ও তারুণ্যকে যুক্ত করেছে অনুষ্ঠানে। এটাও চমৎকার দিক।
মনে রাখতে হবে বাঙালির জীবনে নারীর অবদান পুরুষের চেয়ে বেশি ছাড়া কম কিছু না। নারী যা পারে পুরুষ তা পারে না। বিপদে সংকটে এরাই পরিবার, দেশ ও সংসারকে বাঁচায়। পড়ুয়ার আসরের নারীরা তার এক একটি উজ্জ্বল তারকা। শেষ করব এই বলে, এখন দেখার যুগ, শোনার যুগ। দেখা বা শোনা খারাপ কিছু না। কিন্তু বেশি দেখতে গিয়ে আর শুনতে গিয়ে আমরা আমাদের মগজের বারোটা বাজিয়ে ফেলছি। আমাদের মন মগজ আর আগের মতো কাজ করে না। দুনিয়াব্যাপী এই সমস্যার সমাধানে পড়ার কোনো বিকল্প নেই। যে যত পড়বে বা পাঠ করবে সে তত এগিয়ে যাবে। দেখা, শোনা আর ডিলিট বা ভুলে যাওয়ার যুগে পড়ুয়ার আসর, দারুণ না? পড়ার বিষয়টা যারা ধারণ করে তাদের জয় তো সময়ের বিষয়। জয় হোক পড়ুয়ার আসরের।
সিডনির মেলব্যাগ
প্রবাসে পড়ুয়ার আসর
শীর্ষ সংবাদ: